Buddhadeb Guha: শেষবার যখন ওঁর সঙ্গে আমার দেখা হল, উনি আমায় দেখতে পাননি!
স্বপ্নময় চক্রবর্তী ও আবুল বাশারের মতো তৎকালীন তরুণ লেখককেও চিঠি লিখে উৎসাহ দিতেন তিনি।
জয় গোস্বামী
সেটা ১৯৯০ সাল। আমি 'আনন্দ পুরস্কার' পাই। তখন আমার ৩৫ বছর বয়স। পুরস্কার প্রদানের দিন পুরস্কার নিয়ে আমি মঞ্চ থেকে নেমে আসতেই দেখি লাল পাঞ্জাবি পরা একজন অপূর্ব সুদর্শন পুরুষ আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। আমি তো তাঁকে চিনতে পারছি না। উনি আমাকে বললেন, তুমি কি আমায় চিনতে পারছ? আমার নাম বুদ্ধদেব গুহ। সঙ্গে সঙ্গে আমি পায়ে হাত দিয়ে ওঁকে প্রণাম করলাম। আসলে আমি আমার ষোলো-সতেরো বছর বয়স থেকে ওঁর লেখা পড়ে আসছি। আমি ৫০ বছর ধরে ওঁর লেখার সঙ্গে পরিচিত।
ওঁর সব চেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য, উনি কোনও দল তৈরি করে যাননি। আমরা সচরাচর যেমন দেখি, সাহিত্যিকদের ক্ষেত্রে, কেউ কেউ একটা দল তৈরি করে যান। যে দলটা তাঁর মহিমা কীর্তন করে। অনেক সময়েই এটা বাংলা সাহিত্যে হয়। কিন্তু বুদ্ধদেব গুহর তেমন কোনও দল ছিল না। সংশ্লিষ্ট লেখকের প্রয়াণের পরে সেই দলটিই পরবর্তী সময়ে লেখকের ধ্বজা বহন করে নিয়ে চলে। কিন্তু তিনি ছিলেন একাকী। তাঁর সঙ্গী ছিল তাঁর লেখার চরিত্ররা, তাঁর অরণ্য, তাঁর জঙ্গল, তাঁর নদী, তাঁর সঙ্গীত, তাঁর চিত্রকলা। তিনি একাকী এবং পূর্ণ। সঙ্গীতে পূর্ণ, সাহিত্যে পূর্ণ, প্রকৃতিপ্রেমে পূর্ণ, চিত্রকলায় পূর্ণ।
আরও পড়ুন: Buddhadeb Guha: নব্য বাংলা সাহিত্যের অদ্বিতীয় 'অরণ্যপুরুষ' বুদ্ধদেব
আর একটা আশ্চর্য ব্যাপার দেখেছি। তিনি নতুন লেখকদের খুব উৎসাহ দিতেন। আমার ক্ষেত্রে যেমন বলতে পারি, এমনও হয়েছে ওঁর ধারাবাহিকে তিনি আমার কবিতা পুরোপুরি তুলে দিয়েছেন। ওঁর 'অববাহিকা', 'চান ঘরে গান' উপন্যাসেও আমার কবিতা উদ্ধৃত করেছিলেন। সেটা তখন আমার মতো এক তরুণ বয়সী লেখকের পক্ষে যে কতটা উৎসাহব্যঞ্জক ছিল, তা আজ ভাষায় প্রকাশ করে কী ভাবে বলব! সত্যিই! তিনি খুবই প্রেরণা দিয়েছিলেন আমাকে।
অন্যদের ক্ষেত্রেও এটা দেখেছি। দেখেছি, একটি পত্রিকায় প্রকাশিত আবুল বাশারের একটি লেখা পড়ে তিনি সংশ্লিষ্ট পত্রিকার দফতরে চিঠি লিখছেন। চিঠিতে তাঁকে বলছেন-- তোমার লেখা আমার ভাল লেগেছে, তুমি আরও ভাল লেখো। তিনি স্বপ্নময় চক্রবর্তীকেও চিঠি লিখে উৎসাহ দিয়েছেন। ওঁর থেকে বয়সে ছোট এমন অনেক লেখককেই তিনি লেখা ভাল লাগলে তাঁদের চিঠি লিখতেন। এই গুণ তো সবার থাকে না। সেই সময় তিনি একজন প্রতিষ্ঠিত সাহিত্যিক। অথচ তখনও তিনি নতুন লিখতে আসা আবুল বাশারকে চিঠি দিয়ে উৎসাহ দিয়েছেন! ওঁর চিঠির প্যাডটিও ছিল খুব সুন্দর-- জঙ্গল আঁকা। উনি মনে করতেন, তরুণ লেখকদের উৎসাহ দেওয়া দরকার। এবং দিতেনও।
যে পত্রিকায় আমি কাজ করতাম, সেখানে আমার দফতরে একদিন একটা ফোন এল। আমার সহকর্মী বললেন-- বুদ্ধদেব গুহ তোমায় খুঁজছেন। আমি ফোন ধরলাম। তিনি বললেন, দেখো, তোমার অফিসের কাছেই আমার অফিস। ওয়াটারলু স্ট্রিটে। তুমি বাড়ি যাওয়ার আগে আমার সঙ্গে দেখা করে যেও। আমি গেলাম। দোতলায় ওঁর অফিস। দেখি, সেখানে বসে উনি গান ধরলেন। আমায় জিগ্যেস করলেন কোথায় থাকো? বললাম।
তারপর দেখি একদিন সাদা পাঞ্জাবি-পাজামা পরে চলে এসেছেন আমার বাড়ি। চারিদিকটা একেবারে আলো হয়ে গেল সেদিন। তিনি এলেন। এক কাপ চা খেলেন। আমার স্ত্রী লুচি-তরকারি করে দিলেন, খেলেন। তারপর হঠাৎই গান ধরলেন। কেউ তাঁকে গাইতে অনুরোধ করেনি। অথচ তিনি গাইলেন। তিনি সেদিন ১২টা'র মতো গান গেয়েছিলেন। গানগুলি আমার স্ত্রী টেপে রেকর্ডও করে নিয়েছিলেন সেদিন। তাতে অতুলপ্রসাদী ছিল, রবীন্দ্রসঙ্গীত ছিল, পুরাতনী গান ছিল-- 'আমি বাঁধিনু তোমার তীরে তরণী আমার'-- এটা অতুলপ্রসাদের গান, পুরাতনী 'লুকিয়ে ভালবাসব তারে জানতে দিব না'। তিনি তিনজনের কাছে গান শিখেছিলেন-- জর্জ বিশ্বাস, চণ্ডীদাস মাল, শুভ গুহঠাকুরতা।
গান শোনার অভিজ্ঞতার ক্ষেত্রে আর একটি কথা বলি। আমার যিনি ডাক্তার তাঁর স্ত্রী বুদ্ধদেব গুহকে মাঝেমাঝেই তাঁর বাড়িতে আমন্ত্রণ করতেন। সেই ভদ্রমহিলা আমাদেরও তাঁর বাড়িতে ডাকতেন। সেখানে বুদ্ধদেববাবু গান গাইতেন। এই রকম আসরে আমি ওঁর গান একাধিকবার শুনেছি।
বুদ্ধদেববাবুর সঙ্গে আমার শেষ দেখা কলকাতার এক অডিটোরিয়ামে। সেখানে আমি দ্বিতীয় সারিতে বসে আছি। দেখি লাল পাঞ্জাবি পরে হাতে লাঠি নিয়ে বুদ্ধদেব গুহ আসছেন, ওঁর সঙ্গে অন্য লোক আছেন, ওঁকে সাহায্য করছেন। ওঁকে দেখেই আমি এগিয়ে গিয়ে প্রণাম করলাম। এবং সামনে দাঁড়ালাম। তিনি বললেন-- কে তুমি? আমি বললাম, আমি জয়। তিনি প্রশ্ন করলেন, জয় গোস্বামী? আমি বললাম, হ্যাঁ। তখন তিনি দারুণ উচ্ছ্বসিত। তুমি কেমন আছো? আমার স্ত্রীর খোঁজ নিলেন। তারপর বললেন, আমি আসলে চোখে দেখতে পাই না। একটা আবছা মতো দেখছি তোমায়।
আমার এটা কষ্ট যে, আমার সঙ্গে ওঁর শেষ সাক্ষাতে তিনি আমায় দেখতে পাননি!
(Zee 24 Ghanta App : দেশ, দুনিয়া, রাজ্য, কলকাতা, বিনোদন, খেলা, লাইফস্টাইল স্বাস্থ্য, প্রযুক্তির লেটেস্ট খবর পড়তে ডাউনলোড করুন Zee 24 Ghanta App) (অনুলিখনে সৌমিত্র সেন)
আরও পড়ুন: Buddhadeb Guha: বুদ্ধদেব গুহর প্রয়াণে শোকপ্রকাশ বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ও সূর্যকান্ত মিশ্রের