'মিত্র অশোক'

আইনজীবী যারা প্রশ্ন করাই তাদের পেশা। যুক্তি-তক্কো দিয়েই এজলাসে জয় হাসিল করাই আইনজীবীদের কাজ। প্রশ্নের পাল্টা প্রশ্ন। সারাদিন প্রশ্ন করে করেই যাদের দিন কাটে তাদেরই যদি প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়? 'বাঘা বাঘা প্রশ্নবিদদের যুক্তি-তক্কে বাঘ মরেনি, যার প্রশ্নে বাঘ মরল তাঁর সামনেই প্রশ্নের ভান্ডার নিয়ে হাজির ২৪ ঘণ্টা ডট কমের প্রতিনিধি। অপর প্রান্তের যে ব্যাক্তিটি উত্তর দেবেন তাঁর নাম অশোক মুখার্জি (মদন মিত্রের জামিন যার যুক্তিতে এলো), প্রশ্ন নিয়ে সৌরভ পাল।  

Updated By: Nov 1, 2015, 06:58 PM IST
'মিত্র অশোক'
ছবি: বাপন সাউ

কলকাতা: আইনজীবী যারা প্রশ্ন করাই তাদের পেশা। যুক্তি-তক্কো দিয়েই এজলাসে জয় হাসিল করাই আইনজীবীদের কাজ। প্রশ্নের পাল্টা প্রশ্ন। সারাদিন প্রশ্ন করে করেই যাদের দিন কাটে তাদেরই যদি প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়? 'বাঘা বাঘা প্রশ্নবিদদের যুক্তি-তক্কে বাঘ মরেনি, যার প্রশ্নে বাঘ মরল তাঁর সামনেই প্রশ্নের ভান্ডার নিয়ে হাজির ২৪ ঘণ্টা ডট কমের প্রতিনিধি। অপর প্রান্তের যে ব্যাক্তিটি উত্তর দেবেন তাঁর নাম অশোক মুখার্জি (মদন মিত্রের জামিন যার যুক্তিতে এলো), প্রশ্ন নিয়ে সৌরভ পাল।  

মদন মিত্র। রাজ্যের মন্ত্রী। অপরাজিত ৩২৪*। জেলে কাটিয়েছেন মাত্র ৬১ দিন। হাসপাতালেই কাটিয়েছেন ২৬৩ দিন। সারদা রিয়েলটি মামলায় গ্রেফতার হন তৃণমূলের এই হেভিওয়েট নেতা। বসন্ত পেরিয়ে আরও একটা বসন্ত দোরগোড়ায়। শেষ পর্যন্ত জামিন মঞ্জুর হল মন্ত্রী মশাইয়ের। ৮ বার নিম্ম আদালতে জামিনের আর্জি খারিজ। এক বার জামিনের আর্জি খারিজ করেছে উচ্চ আদালত। ১০ নম্বর বারে জামিনে মুক্তি (শর্ত সাপেক্ষ-জমা থাকবে পাসপোর্ট, যেতে পারবেন না রাজ্যের বাইরে।) ১০ নম্বর ফুটবলের মঞ্চে সব সময়ই শিরোনামে। তবে যার যুক্তির জয়ে জামিনে এস এস কে এম হাসপাতালের গদি ছেড়ে ভবানীপুরের বাসগৃহে পৌঁছোলেন মন্ত্রী মশাই তিনি একেবারেই লোকচক্ষুর আড়ালে। কত আইনজীবী এলেন আর গেলেন, টাকাও খসলো কিন্তু লাভের লাভ কিছুই হয়নি। ৩২৪* দিনের ইনিংসে ১০ নম্বর প্লেয়ার হলেন 'পেলে ভক্ত' 'সম্রাট অশোক'। সম্রাটই তো বটে। প্রাক্তন আইনমন্ত্রী 'কপিল মুনি' যে কর্ম সাধনে অসফল সেখানে এক বাঙালির যুক্তিতে 'আইনি জয়'। মদন মিত্র অবশ্য বলছেন, "মানুষের জয়, সত্যের জয়"। ৩১ অক্টোবর  ৩ টে বেজে ২০ মিনিট থেকে সময়টাও যেন কেমন হুশ হুশ করে বেরিয়ে যাচ্ছে। আইনজীবী রুবি মুখার্জি ও 'ক্যামেরা দাদা' বাপন দা'র সূত্র ধরেই পৌঁছলাম আইনজীবী অশোক মুখার্জির বাড়ি। সাক্ষাৎকারের জন্য। প্রশ্ন পত্র তৈরি। সামনে স্যার অশোক মুখার্জি। ক্ষমা করবেন, সাক্ষাৎকারটা হল না, হল ক্লাস। স্যারেরা যখন বলেন ছাত্ররা গুণমুগ্ধ হয়ে শোনে, এটার ব্যাতিক্রম হল না। প্লেটে মিষ্টি আর খাতায় প্রশ্ন, তারপর-

স্যার, ৩২৪ দিন পর মদন মিত্রের জামিন। কতটা কঠিন লড়াই ছিল?
আইনি পক্রিয়ার প্রত্যেক পদক্ষেপকেই আমরা মনে করি কঠিন লড়াই। কিন্তু দীর্ঘায়িত হয় যখন সে লড়াই তখন তার মাত্রা অর্থাৎ তার গুরুত্ব আসতে আসতে বাড়তে থাকে। স্বাভাবিক ভাবেই মদন মিত্রের মামলার ক্ষেত্রে, এমন একজন ব্যাক্তি যার পদাধিকার বা সামাজিক প্রতিষ্ঠার জন্য বা যে কারণেই হোক, এমন একটা মামলা, যে মামলার সমাজে বিশাল একটা এফেক্ট আছে।এই ধরনের মামলার ক্ষেত্রে ৩২৪ দিনের যে দীর্ঘ লড়াই এবং প্রাথমিক ভাবে লড়াইয়ের শেষে জামিন, তা আমাদের কাছে স্বস্তিদায়ক।

এর আগেও তো অনেকে এই মামলা লড়েছেন। তারা 'ব্যার্থ' হয়েছেন। তারা পারলেন না, আপনি করে দেখালেন। আপনার জয়ের রসায়নটা কী?
পারলেন না আর পারলেন, আইনি জগতে এইভাবে বিভাজন হয় না। কারণ প্রত্যেকটা মামলার ফ্যাক্ট, পরিস্থিতি এবং গুরুত্ব আলাদা হয়। প্রতিনিয়ত একটা মামলা 'চেঞ্জ অব সারকামস্ট্যানসেস'(পরিবর্তিত অবস্থা)-এর মধ্যে দিয়ে এগোয়, এমন পরিস্থিতিতে তার যে বিভিন্ন রূপ আসে, বিচারকও সেই মামলায় গুরুত্ব আরোপ করে দেখেন। যেমন- একজন লোক হয়ত প্রথম ১০ দিন জেল কাস্টোডিতে আছেন। সেক্ষেত্রে বিচারক মনে করছেন যে, ১০ দিন মানে প্রাথমিক অবস্থা, অতএব এক্ষেত্রে আইনি যা বক্তব্য যাই থাক, জামিন দেওয়া ঠিক হবে না। আবার দেখা গেল, ১০০ দিন একজন লোক কাস্টোডিতে আছেন, তারপরও যদি তেমন তথ্য না পাওয়া যায় তাহলে একটা লোকের বিরুদ্ধে 'পার্সোনাল লিবার্টি কার্টেল' করা যাবে কিনা তা দেখতে হবে। এটাই হল 'চেঞ্জড সারকামস্ট্যানসেস'। অতএব এই ধরনের মামলায় বিচারক ও আইনজীবীর মধ্যে বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গী কাজ করে। সেক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে এটা বলা যেতে পারে, 'চেঞ্জড সারকামস্ট্যানসেস' আমি তুলে ধরতে পেরেছি। যেটার জন্য হয়ত আমি জয় লাভ করেছি।

সিবিআই মন্ত্রীর জামিন খারিজের আর্জি নিয়ে উচ্চ আদালতে যাবে। আপনার 'পরিবর্তিত প্ল্যান' কি?
না, নিয়ম হচ্ছে যে 'প্রসিকিউশন' বা সিবিআই তাদের আইনগতই অধিকার আছে। তারা 'বেল ক্যানসেলেশন' করার জন্য যেতে পারেন। সেক্ষেত্রে জেলা আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে হাই কোর্টে যেতে হবে। হাইকোর্টে গেলে 'ক্যানসেলেশন অব বেল'-এর জন্য তারা দরখাস্ত করবেন এবং কি গ্রাউন্ডে ক্যানসেলেশন চাইছেন, সেটা দেখাতে হবে। সেই পিটিশন ফাইল করার পর আমাদের ক্লাইন্ট অর্থাৎ মদন বাবুর ওপর নোটিস হবে। নোটিশ আর দরখাস্তের কপি সেটা পাবার পরেই আমরা আমাদের সিদ্ধান্ত নেব। লিগাল ফ্যাক্টগুলো দেখতে হবে, কোনটায় কোর্টে লড়াই করতে সুবিধা হবে আমাদের।

এই জয়ের পর মদন মিত্রের সঙ্গে নিশ্চয়ই কথা হয়েছে? কীভাবে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করলেন মন্ত্রী?
একটা মানুষ দীর্ঘদিন আটকে আছেন, এই জয়ের পর আনন্দে আপ্লুত। ভীষণ ভাবে আপ্লুত। এইটুকু বুঝতে পারলাম। দীর্ঘ দিন পর আবার নিজের পরিবারের সঙ্গে থাকতে পারবেন, মানসিক যে 'মেন্টাল ট্রমা' সেটা আর থাকছে না। অসুস্থ রয়েছেন, ডাক্তাররা নিয়মিত চেক-আপ করছেন। তবে আনন্দে আপ্লুত হয়েছেন। তাঁর পরিবারও আমাদের কৃতজ্ঞতা জানিয়েছে।

'সাসপেন্ডেড তৃণমূল সাংসদ' কুণাল ঘোষের হয়ে লড়বেন?
আমরা তো প্রফেশনাল ম্যান (পেশাদার)। কেন লড়ব না? নিশ্চয়ই লড়ব।

এই জয়ের পর 'দিদিমণি'র ফোন পেয়েছেন?
 না এখনও পায়নি। (কথার মাঝেই প্রশ্ন-দলের অন্যান্য নেতার ফোন...) হ্যাঁ। অনেকেই ফোন করেছেন।

মন্ত্রী মদন মিত্র যেভাবে জামিন পেলেন ঠিক একই আইনি লড়াইয়ে কুণাল ঘোষ জামিন পাবেন? কি মনে হয়?
আইনজ্ঞ হিসেবে আমার মনে হয়, নিশ্চয়ই সম্ভাবনা আছে। পাওয়া উচিত।

আচ্ছা এই আইনি লড়াইয়ে কোথাও কি মনে হয়েছে সিবিআই আপনাকে একটা 'লুজ বল', আর সেখানেই আপনি ছক্কাটা মারলেন?
না। বলটা বোলারের হাতে। যে বোলার ভাল প্লেয়ার, দক্ষ প্লেয়ার সে কখনই হঠাৎ একদিন মাঠে নেমে লুজ বল করবে না। কিন্তু যদি দেখা যায় যে, ব্যাটসম্যান অনেক আত্মবিশ্বাস নিয়ে মাঠে নেমেছে সেখানে বোলারকে অনেক সময় নিজেকে কন্ট্রোল করতে হয়। যদি কোর্টটা খেলার মাঠ হিসেবেই ধরি, আর ব্যাটসম্যান-বোলার হিসেবে যদি চিহ্নিত হই তাহলে বোলার হয়ত বুঝতেও পেরেছিলেন যে আজকে বোলিং যত কঠিনই করি না কেন খুব একটা সুবিধা হবে না।

সাক্ষাৎকারে এই প্রশ্নটা ছিল না। খেলার প্রসঙ্গ যখন উঠলই, একটা ছোট্ট প্রশ্ন। ফুটবল পছন্দ করেন?
হ্যাঁ। (হাসি মুখে)

১০ নম্বর প্লেয়ার হিসেবে কাকে পছন্দ করেন?
(প্রশ্ন শেষ করার আগেই স্বতঃস্ফুর্ত উত্তর) পেলে। (কাকতালীয় হলেও এটাই সত্যি, ৮ বার নিন্ম আদালাত, এক বার উচ্চ আদালত, ১০ নম্বর বারে গোলটা কিন্তু আপনিই করলেন) উত্তরে কেবলই হাসি আর হাসি।

(আবার 'এজলাসে') একটা প্রশ্ন বারবারই মদন মিত্রের আইনজীবীরা মামলা চলাকালীন করেছেন, ' মন্ত্রিত্ব ছেড়ে দেবেন মদন মিত্র'। এটা কি আদৌ সত্যি?
হ্যাঁ। তিনি বলেছেন, 'আমার স্বাধীনভাবে কাজ করার ক্ষেত্রে মন্ত্রিত্ব বাঁধা হলে আমি অবশ্যই মন্ত্রিত্ব ছেড়ে দেব। কারণ মানুষ যদি আমাকে ভালবাসে, তাহলে আমি আবার কর্মক্ষেত্রে নেমে আমার জায়গা অর্জন করতে পারব'। এটাই বলেছিলেন তিনি। 'মন্ত্রিত্বটা বড় জিনিস নয়' আমাদের কাছে এটাই প্রকাশ করেছিলেন তিনি।

'ক্লাস' থেকে পাওয়া অজানা কিছু তথ্য- পেশায় আইনজীবী হলেও পড়াতে ভালবাসেন অশোক মুখার্জি। নকশাল আমলে সিটি কলেজে অধ্যাপনা করতেন। ছাত্র ছিলেন চেতলা বয়েজ স্কুলের। কিছুদিন নিজের স্কুলেই শিক্ষকতা করেছেন। এলএলবি-টা করাই ছিল, এরপর ১০০ বছর ধরে বাবা-জ্যাঠারা যা করে এসছেন তাতেই এলেন। হ্যাঁ। আইনজীবীর পেশায়।

নীতি কথা দিয়েই ১ ঘণ্টার একটা ক্লাস শেষ করা যাক- স্যারের কথাতেই,"Society is Dynamic, law is ever changing"।

.