মানুষকে মানুষের কাছে ফিরে যেতে হলে মনে পড়বেই শঙ্খ ঘোষকে

রোশনি কুহু চক্রবর্তী

Updated By: Apr 21, 2021, 04:00 PM IST
মানুষকে মানুষের কাছে ফিরে যেতে হলে মনে পড়বেই শঙ্খ ঘোষকে

রোশনি কুহু চক্রবর্তী

 শঙ্খ ঘোষ। ‘‘দু হাত তোমার স্রোতে সাক্ষী থাকো, সন্ধ্যানদীজল।’’ ঠিক সন্ধ্যার শান্ত উপহারের মতো একটা মানুষ। শোকের সায়র উজিয়ে জীবনজমিতে প্রার্থিত পলি খুঁজে চলার কাজ এসেছে আজ। তাই স্নেহভাজন সুনীলের দিকশূন্যপুরে পাড়ি জমিয়েছেন একটু আগে। কিন্তু শব্দ যেমন থেকে যায়, ঠিক তেমনই রয়ে গিয়েছেন, রয়ে যাবেন শঙ্খ ঘোষ। আকাশের মতো বিরাট এই মানুষটি শুধু যে কবিতা, শুধু যে গদ্য, শুধু যে চিন্তা কিংবা যাপনের এক ভিন্ন অর্থ তা কিন্তু নয়। এই নামের সঙ্গে যেন আরও অনেক কিছু জড়িয়ে। কবির কথা ধার করে বলতে গেলে ‘‘শূন্যতাই জানো শুধু, শূন্যের ভিতরে এত ঢেউ আছে, সে কথা জানো না।’’

মানুষকে মানুষের কাছে ফিরে যেতে হলে মনে পড়ে শঙ্খ ঘোষের কথা। বাঙালির বাক-সংস্কৃতির চেহারা বদলের অন্যতম একজন কারিগর শঙ্খ ঘোষ। স্যার। ‘ভিন্ন রুচির অধিকার’ অধিকার নিয়ে সওয়াল করার মানুষ। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়. বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করা মানুষটি বিনয়ের অপর নাম, এমনটা বললেও বিন্দুমাত্র ভুল হবে না। ইনিই কিন্তু লেখনীর জোরে বলতে পারেন,‘‘রবীন্দ্রনাথের সমস্ত রচনাতেই আসলে দুটো তল পরস্পর স্পৃষ্ট হয়ে আছে। একদিকে সমাজকে সে ছুঁয়ে যাচ্ছে, অন্যদিকে একেবারে সেই আমির কাছে সে পৌঁছে যাচ্ছে।’’

 

 

প্রতিটা মুহূর্তে, প্রতিটা পদক্ষেপে বারবার অন্যায়ের বিরুদ্ধে সরব হয়ে কবি-গদ্যকার মানুষটি কলম ধরেছেন। কলম ধরেছেন ছোটদের জন্যও, একাধিক কবিতা এবং গল্পই তার প্রমাণ। সেখানে এক অদ্ভুত সারল্যের ছোঁয়া। এই মানুষটি সরব হওয়া মানে উচ্চকিত স্বর নয়, তারও প্রমাণ দিয়েছেন বারবার। গলার স্বর নীচু হলেও তা যে দৃঢ়, বুঝতে শিখিয়েছেন।

‘‘আরও কত ছোট হব ঈশ্বর, ভিড়ের মধ্যে দাঁড়ালে! আমি কি নিত্য আমারও সমান, সদরে, বাজারে, আড়ালে?’’ এভাবেই বারবার মৌলবাদকে প্রতিহত করতে চেয়েছেন।

মঞ্চে ভাষণ দিতে তিনি খুব একটা পটু নন, বারবার বলতেন এ কথা। কিন্তু বিনয়ী কবিই গণতন্ত্রের স্বার্থে সারাজীবন কথা বলেছেন। সমাজকে ছুঁয়ে থাকতেন বলেই অনায়াসে লিখেছেন, ‘‘লেখা যখন লেখা হয় না’’। বলতে পারেন. ‘‘প্রতিবেশীকে চিনুন’’। কিন্তু আমরা কী করেছি? এই সময়ের অন্যতম প্রজ্ঞাবান মানুষ, অসামান্য কবি শঙ্খ ঘোষকে অসম্মান করেছিল ‘ক্ষমতা’। আমরা ‘‘কোন দল, তুমি কোন দল’’ ভাবতে ভাবতে সময় পেরিয়ে গিয়েছে। উনি কিন্তু অটল, অবিচল রয়েছেন প্রতিনিয়ত।

অবিভক্ত বাংলার কুমিল্লায় শঙ্খবাবুর জন্ম ১৯৩২ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি। ১৯৫১ সাল। কবির বয়স তখন সবে ১৯। কোচবিহারে খাদ্যের দাবিতে একটি মিছিলে ১৬ বছরের এক কিশোরীর মৃত্যু হয় পুলিসের গুলিতে। সে খবর শুনে যন্ত্রণার্ত কবি লিখলেন, যমুনাবতী-‘‘নিভন্ত এই চুল্লিতে মা, একটু আগুন দে....’’ এই কবিৃতার জন্য নিন্দিত হলেন অগ্রজপ্রতিম বুদ্ধদেব বসু, সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কাছে। কিন্তু কলমের আগুনকে বিক্রি হতে দিলেন না। 

তাঁর কলমে সম্পর্ক এক অন্যমাত্রার ভাষা নিয়ে এল। ‘‘হাতের ওপর হাত রাখা খুব সহজ নয়, সারাজীবন বইতে পারা সহজ নয়, এ সব সহজ কিন্তু কে না জানে, সহজ কথা টিক ততটা সহজ নয়’’

অন্যদিকে, মরিচঝাঁপি থেকে সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম বারবার তিনি প্রতিবাদের স্বর হয়ে উঠেছিলেন অজান্তেই। গণহত্যার প্রতিবাদে লিখলেন, ‘‘তুমি আর নেই সে তুমি।’’ লিখলেন উল্টোরথ। সরস্বতী পুরস্কারের বিরাট অঙ্কের টাকা দান করে দিলেন, প্রথমে যদিও অসম্মত হয়েছিলেন পুরস্কার গ্রহণে। এখন চোখ বুজে রয়েছেন মূল্যবোধের মূর্ত প্রতীক যে মানুষটি, তার কলম প্রতিবাদে অবিচল ছিল আজীবন। দেশের, সময়ের, অসহিষ্ণু পরিস্থিতিতে কয়েকদিন আগেও লিখেছেন, ‘‘এখনও পরীক্ষা চায় আগুন সমাজ, এ মাটি আমারও মাটি। সে কথা সবার সামনে কীভাবে প্রমাণ করব আজ।’’

কিন্তু এই প্রতিবাদের সূত্রপাত কবে? তখন ৯ বছর বয়স চিত্তপ্রিয় ঘোষ ওরফে শঙ্খ ঘোষের। বাবা মণীন্দ্রনাথ ঘোষের ছিল বদলির চাকরি, বাবা ছিলেন রবীন্দ্র অনুরাগী। রবীন্দ্রনাথের তখন ৮০ বছর। সেউ উপলক্ষে ‘মুক্তধারা’ নাটকে প্রথম অভিনয় করলেন। ১২ বছর বয়সে পড়ে ফেললেন প্রমথনাথ বিশীর ‘শান্তিনিকেতন’। দেশভাগের বেদনাদায়ক স্মৃতি রবীন্দ্রনাথের শেষযাত্রার দৃশ্য ভুলতে পারেননি শঙ্খ। রবীন্দ্রনাথকে জানার আগ্রহ ক্রমশ যেন বেড়েই চলে। কবিতা লেখার শুরু ঠিক সেভাবেই কিশোর বয়সে। যদিও নিজে কখনও সেগুলিকে কবিতা বলে মনে করেননি জ্ঞানপীঠ সম্মানপ্রাপক মানুষটি। বলেছেন,‘‘শব্দহীন’’ হতে,‘‘নীরব’’ হতে। 

 

‘‘লেখ আয়ু, লেখ আয়ু। চুপ করো শব্দহীন হও’’। লিখেছেন ‘মেঘের মতো মানুষ’, বৃষ্টি, জল কিংবা ভূমধ্যসাগরের মতো কিছু লেখা। পদ্মভূষণ থেকে দেশিকোত্তম, জ্ঞানপীঠ থেকে সাহিত্য অ্যাকাডেমি প্রতিটি পুরস্কার যেন মাথা নত করেছে সরস্বতীর বরপুত্রের কাছে। পাঠকদের কেউ বলবেন, ‘বাবরের প্রার্থনা’, কেউ বলবেন ‘মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে’, কেউ বলবেন ‘ধুম লেগেছে হৃত্কমলে’। আসলে শঙ্খ ঘোষের লেখা-সে তো এক সমুদ্র জল। সেই সমুদ্রের জলে অবগাহন করতে হয় বারবার। তবু সাধ মেটে না। এমন একজন ঋজু মানুষ, যিনি বাংলা ভাষার অন্যতম প্রতিনিধি, ভরসা। তাই তরুণ কবি অনায়াসে লেখেন, ‘‘শঙ্খ ঘোষের নাম শোনেনি, এমন কেউ তোমায় যদি প্রোপোজ করে কী করবে?’’

বাংলা সাহিত্যে শুদ্ধতার পর্যায়ক্রমিক ধারা বয়ে নিয়ে গিয়েছেন শঙ্খ ঘোষ। নিজে বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছেন। ছাত্রছাত্রীদের মধ্যেও সম্পৃক্ত করেছেন সেই আবহ। অনায়াসে লিখেছেন, ‘‘ঘৃণা নেই, নেই তঞ্চকতা, জীবনযাপনে আজ যত ক্লান্তি থাক, বেঁচে থাক শ্লাঘনীয় তবু’’। তাই আজকের পর থেকে বিরুদ্ধ মত নিয়ে নিঃসঙ্কোচে আর কারও কাছে যেতে পারব না আমরা। শুধু অস্থির সময়ে মনে রয়ে যাবে, ‘‘আছি,তবু ভাঙা এই দেশকাল নিয়ে আজও আছি। এর চেয়ে বড় কিছু হয়?’’

.