মন খুললেন মদন (পর্ব-১)
'গণ জামাইষষ্ঠী'
স্থান- ভবানীপুর ইউনাইটেড ইয়ুথ ফোরাম
সময়- ৬ টা
তারিখ- ৩১ মে
মেনু- গন্ধরাজ ফুচকা, 'সম্প্রীতি ফুড'-চিকেন বিরিয়ানি, মটন চাপ, আইসক্রিম
ব্যবস্থাপনায়- দেশপ্রেমিক ক্লাব সংহতি কিন্তু সব কিছুই আসলে মদন মিত্র
জামাইষষ্ঠীর আয়োজনের ব্যস্ততার ফাঁকে কথা বললেন ২৪ ঘণ্টা ডট কমের প্রতিনিধি সৌরভ পালের সঙ্গে।
প্রশ্ন- হঠাৎ কেন গণ জামাইষষ্ঠী আয়োজনের কথা ভাবলেন?
মদন মিত্র- 'সম্প্রীতি জামাইষষ্ঠী'। একই দিনে একই সঙ্গে জামাইষষ্ঠী আবার রমজানের ইফতার। বিভিন্ন জায়গায় আমরা গণবিবাহ দিই। যেদিন গণবিবাহ দেওয়া হয় সেদিন আমরা শাড়ি, জামা, গয়না, খাট-পালঙ্ক সবই দিই। কিন্তু তারপর কী হল? যেমন গত ৬ মাস আগেই 'আলোয় ফেরা' বলে একটি সংগঠন ১৫২টি মেয়ের গণবিবাহ দিয়েছিল। এটা ওয়ার্ল্ড রেকর্ড। এদের মধ্যে ২৫ জন ছিল খ্রিস্টান, ৪০ জন ছিল মুসলমান আর বাকি সবাই হিন্দু। এদের মধ্যে বেশির ভাগটাই আদিবাসী। সুন্দরবন, ট্যাংরাখালি, বসিরহাট, মীনাখা, ঝাড়গ্রাম, বিনপাহাড়ী, ঝিলমিল, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া এই সমস্ত হদ্দ গ্রামীণ অঞ্চল থেকেই বেশিরভাগ এসেছে। এই যে এদের বিয়ে হল, তারপর এদের স্বামীরা এদের কী করে রাখল? খেতে দিল, পরতে দিল না ভাগিয়ে দিল, এর কোনও খবরই আমরা পাই না। জানার চেষ্টা করলাম, যে ওরা কেমন আছে। তারপর একটা রিপোর্ট পেলাম। সবাই যে খুব ভাল আছে, তেমনটা নয়। এমন অনেক ক্ষেত্রেই জানতে পেরেছি বিয়ের পরের দিনই স্বামী গয়না নিয়ে পালিয়েছে, বউকে দেখেও না। তখনই ঠিক করলাম, একটা বার্তা দিতে হবে। যারা গণবিবাহ দিচ্ছেন, তারা গয়না, খাট-পালঙ্ক না দিয়ে যদি মুরগি, ছাগল দেন বা ছোট্ট একটা ধানি জমি উপহার দেন, যাতে সংসারটা চলে। আমরা ঠিক করেছি জামাইষষ্ঠীতে সদ্য বিবাহিতদের ওয়াশিং মেশিন দেব, ইস্ত্রি দেব। ধোপার জীবিকা নির্বাহ করেও যাতে জীবনটা চলে। অনেককে সেলাই মেশিনও দেব। ওদের নিরাপত্তার জন্য আমরা মেডিক্লেম করে দিচ্ছি। সাইকেল দেওয়ার কথাও ভাবছি। আমরা চাইছি গোটা বিষয়টা যেন একটা নেটওয়ার্কের মধ্যে দিয়ে চলে। আর সেই জন্যেই আমরা একটা 'দেশপ্রেমিক ক্লাব সংহতি' তৈরি করেছি। গোটা বেঙ্গলে আমরাই এটা মনিটর করছি।
দিল্লি আর লুধিয়ানা থেকে দু'জন সোশ্যাল ওয়ার্কার রিসার্চার আসছে এই অনুষ্ঠানে। এই অনুষ্ঠানের শুভ সূচনা করবে ২২ বছরের একটি ছেলে, শুভজিৎ।
প্রশ্ন- কে এই শুভজিৎ?
মদন মিত্র- পৃথিবীর দশ ওয়ান্ডার বয়দের মধ্যে ও একজন। ব্রাজিল বিশ্বকাপের থিম থেকে শুরু করে যাবতীয় প্ল্যানিং করেছিল যে দশ জন, তাদের মধ্যে একজন হল শুভজিৎ। বার্সেলোনার লোগো ডিজাইন করার পর মেসি নিজে ওকে ডেকে নিয়ে গিয়ে মাঠে বসিয়ে ম্যাচ দেখিয়েছে।
প্রশ্ন- এত বড় একটা সোশ্যাল ম্যাসেজ, অথচ সোশ্যাল মাধ্যমকেই ব্যবহার করলেন না, কেন?
মদন মিত্র- (কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর) এটা আমরা একটা কারণে করিনি, সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচার করলে এত ম্যাসিভ আপ্রোচ আসত, প্রথম বছরে সেটা সামলাতে পারতাম না। আমরা এবছর যাদের যা যা দেব সেটা ভাল জিনিসই যাতে হয়, সেদিকে খেয়াল রেখেছি। আগামী বছর আরও বড় করে চিন্তা ভাবনা করব।
প্রশ্ন- ব্যাপক জনপ্রিয়তা সত্বেও নিজে কেন সোশ্যাল মাধ্যম ব্যবহার করেন না?
মদন মিত্র- (মৃদু হাসি হেসে) না না আমাদের একটা ফেসবুক পেজ আছে, 'মদন মিত্র ছিল, আছেন, থাকবেন' (২ লক্ষ গ্রুপ মেম্বার)। আমি এটা মূলত করি না, নিজেকে গ্লোরিফাই না করার জন্যই। আমি চাই, দলই হাই প্রোফাইলড থাকুক।
প্রশ্ন- (উত্তর থামিয়ে পাল্টা প্রশ্ন) দলের অনেকেই তো নেট দুনিয়ায় বেশ অ্যাকটিভ... আপনি নিজে কেন অন্তরালে?
মদন মিত্র- (মদন মিত্র সুলভ ভঙ্গিতে) আমি দলের থেকে একটু লো প্রোফাইলই থাকতে চাই। সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং মানেই হাইপ্রোফাইল। (যদিও নিজে ৬টি স্মার্ট ফোন ব্যবহার করেন, তার মধ্যে দুটি অ্যাপেল। সবকটি ফোনেই ইন্টারনেট রয়েছে, ই-মেল, হোয়াটসঅ্যাপেও ভীষণ অ্যাকটিভ।) বড় বড় লোকেরা থাকেন।
প্রশ্ন- এই কথাটার মধ্যে কি শ্লেষ রয়েছে?
মদন মিত্র- না। (হাসি) না, না কোনও শ্লেষ নেই। কোনও কিচ্ছু নেই।
প্রশ্ন- (আড্ডা থেকে একেবারে ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে সরাসরি রাজনীতির প্রসঙ্গে) ৩৪ বছর সিপিআই(এম)-এর সঙ্গে লড়াই করেছেন। বর্তমান সময়ে যেভাবে বিজেপি যে ভাবে থাবা বসাচ্ছে, তাতে লড়াইটা কি আরও কঠিন?
মদন মিত্র- (একেবারেই মদন মিত্র সুলভ উত্তর নয়, যেটা বললেন তাতে মনে হল সাইড কাটিয়ে গেলেন) আমি রাজনীতি থেকে অনেকটা দূরে তো, তাই বলতে পারব না।
প্রশ্ন- আপনার রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা কী বলে? লড়াইটা কীভাবে করতে হবে? এখানে 'সম্প্রীতি জামাইষষ্ঠী' হবে, ইউপিতে তো 'অ্যান্টি রোমিও স্কোয়াড' প্রেম যুগলদের ধরে ধরে বেধড়ক পেটাচ্ছে, কী বলবেন?
মদন মিত্র- দেখো বিবেকানন্দ যখন সারা পৃথিবীতে প্রমাণ করলেন, হিন্দু ধর্মই শ্রেষ্ঠ ধর্ম, তখন তিনি একবার গো-মাতা রক্ষা কমিটির অনুষ্ঠানে গিয়েছিলেন। গিরিধারি লাল ছিলেন ওই কমিটির সভাপতি। স্বামীজি বললেন যে, তোমাদের সংস্থার কাজ কী? তো, ওরা বলল আমাদের নামের মধ্যেই তো আমাদের কাজ। গো-মাতার সংরক্ষক আমরা, গো-মাতার সেবা করি। গরু আমাদের মা। গরুর কষ্ট হলে দেখি, গরুকে খাওয়াই। তখন স্বামীজি বললেন, খুব ভাল। দারুণ কাজ। কিন্তু ধর, যদি গরু না হয়ে মানুষ হয়। মানুষ মরে যাচ্ছে, মানুষ বিপদে পড়েছে, তাহলে? তখন ওরা বলল না না। আমাদের মানুষের জন্য কোনও স্কিম নেই। কারণ গো-মাতাকেই আমরা নিজের মা বলে মনে করি। তখন স্বামীজি বললেন, তুমি ঠিকই বলেছ। যদি গরুকে নিজের মা মনে না করতে তাহলে তোমাদের মতো তো সন্তান হত না। এটা স্বামীজির উক্তি। তাহলে তোমাদের মত এত গরু হত না। (কটাক্ষের সুরে এভাবেই বিজেপিকে বিঁধলেন মদন মিত্র)
প্রশ্ন- হিন্দুত্ব অস্ত্রে কীভাবে বিজেপিকে ঠেকাবেন?
মদন মিত্র- ব্যাপারটা হচ্ছে আমি হিন্দু সন্তান। আমার মায়ের ও'নেগেটিভ রক্ত ছিল। মা তখন খুব অসুস্থ, ডাক্তার বলল ১৫ মিনিটের মধ্যে ও'নেগেটিভ রক্ত লাগবে, না হলে মা'কে বাঁচানো যাবে না। আমি তখন ছাত্র-যুব নেতা। আমার কাছে রক্ত জোগাড় করা কোনও ব্যাপার না। কিন্তু আমি কোথাও পাচ্ছি না ও'নেগেটিভ রক্ত। পাগলের মত ঘুরছি। তখন আমাদের হকার ইউনিয়নের চারজন মুসলিম ভাই এসে বলল আমাদের রক্ত নাও, আমাদের রক্ত ও'নেগেটিভ। আমি ওদের রক্ত নিয়েই মায়ের প্রাণ বাঁচালাম। তখন কি আমি ভাবব রক্তে কে মুসলিম, কে হিন্দু!
আমি নিজে কামারহাটিতে দুর্গা পুজো করি। সমস্ত মুসলিম ছেলেরাই তো পাহারা দেয়। সুতরাং আমরা এসব মানি না। আমাদের কাছে উৎসব মানেই সম্প্রীতি। জামাইষষ্ঠীতে সানাইটা মুখার্জি বাড়ির লোক বাজাবে না বিসমিল্লা খানের পরিবার বাজাবে এটা দেখার বিষয় নয়। এটাই আমাদের সংস্কৃতি।
হিন্দুরা গরুকে অন্য চোখে দেখে। আবার মুসলিমরা শুকর খায় না। তা বলে কি হিন্দু-মুসলিম পাশাপাশি বসে একই হোটেলে খেতে পারবে না? আপনি জোর করে কারোর ওপর কিছু চাপিয়ে দিচ্ছেন কিনা সেটা দেখতে হবে।
প্রশ্ন- এই 'আপনি'টা কে?
মদন মিত্র- আপনি মানে আপনি। মানে ম্যানেজমেন্ট।
প্রশ্ন- ম্যানেজমেন্ট মানে মোদী?
মদন মিত্র- সেটা ঘটনাচক্রে নরেন্দ্র মোদী...। এই যে কাল মমতা ব্যানার্জি বলেছেন যে আমরা গরুকে আটকাবো না, এটাকে আমি একজন হিন্দু পরিবারের ছেলে হয়েও সমর্থন করছি। গরু কাটার যে অর্ডিন্যান্স জারি হয়েছে তা বাংলায় চলবে না। তাতে যদি আমায় গুলি খেতে হয় খাবো।
পরের পর্বের জন্য চোখ রাখুন ২৪ ঘণ্টা ডট কমের পাতায়।