সেরার লড়াই নয়, প্রতিভার স্বীকৃতি
সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রের উজ্জ্বল কিছু ব্যক্তিত্বের সঙ্গে সম্পূর্ণ অপরিচিত কিছু মানুষের বিশেষ কীর্তি একই মঞ্চে তুলে ধরার নামই ২৪ ঘণ্টা `অনন্য সম্মান`। ২০০৮ সালের পয়লা বৈশাখের দিন যাত্রা শুরু অনন্য সম্মানের। প্রতি বছরই সাহিত্য, অভিনয়, ক্রীড়া, শিল্প-বিভিন্ন ক্ষেত্রের বিশিষ্ট কিছু মানুষের পাশাপাশি ২৪ ঘণ্টা সম্মানিত করে এমন কয়েকজনকে, যাঁরা কোনওভাবেই বিখ্যাত নন।
সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রের উজ্জ্বল কিছু ব্যক্তিত্বের সঙ্গে সম্পূর্ণ অপরিচিত কিছু মানুষের বিশেষ কীর্তি একই মঞ্চে তুলে ধরার নামই ২৪ ঘণ্টা `অনন্য সম্মান`। ২০০৮ সালের পয়লা বৈশাখের দিন যাত্রা শুরু অনন্য সম্মানের। প্রতি বছরই সাহিত্য, অভিনয়, ক্রীড়া, শিল্প-বিভিন্ন ক্ষেত্রের বিশিষ্ট কিছু মানুষের পাশাপাশি ২৪ ঘণ্টা সম্মানিত করে এমন কয়েকজনকে, যাঁরা কোনওভাবেই বিখ্যাত নন।
প্রচারের আলোয় আসেননি কোনওদিনই। নেই ভক্তকূলও। কিন্তু, নিজের নিজের কাজের মাধ্যমে কোনও না কোনভাবে সমাজকে সমৃদ্ধ করেছেন এঁরা প্রত্যেকেই। শুধমাত্র সদিচ্ছার দ্বারা প্রতিকূলতাকে জয় করে সমাজকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। অনন্য সম্মানের জন্মলগ্ন থেকে প্রতিবছরই এরকম `অনন্য সাধরণ` কিছু মানুষকে স্বীকৃতি জানিয়ে আসছে ২৪ ঘণ্টা।
২০১২ সালে অনন্য সম্মানের দাবিদাররা হলেন-
বিশেষ সম্মান:
বরুণ বিশ্বাস: গাইঘাটা থানার সুটিয়া এলাকার বাসিন্দা ছিলেন বরুণ বিশ্বাস। পেশায় শিক্ষক বরুণ শিক্ষকতা করতেন কলকাতার মিত্র ইন্সটিউশনে। চুরি, ডাকাতি, ধর্ষণ অধ্যুষিত সুটিয়া এলাকাকে জনগণের বাসযোগ্য করে তোলার দাবিতে ২০০২ সালে গড়ে তুলেছিলেন সুটিয়া প্রতিবাদী মঞ্চ। সঙ্গী ছিলেন কিছু সহ নাগরিক। গ্রামের মানুষকে প্রতিবাদ করার সাহস জোগানো এবং আদালতের দ্বারে পৌঁছে দেওয়াই ছিল প্রতিবাদী মঞ্চের লক্ষ্য। বরুণের নেতৃত্বে প্রতিবাদী মঞ্চের উদ্যোগে আদালতে ওঠে সুটিয়া গণধর্ষণ মামলা। শাস্তি হয় অপরাধীদের। দীর্ঘদিন ধরে আতঙ্কে জর্জরিত সুটিয়ার সাধারণ মানুষ আবার করে স্বাভাবিক ভাবে বাঁচতে শেখেন। বরুণের উদ্দ্যোগে একজোট হন। কিন্তু দুষ্কৃতীরা জেলের ভিতর থেকেই প্রতিহিংসার ছক কষে। গত ৫ই জুলাই স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথে গোবর ডাঙ্গা স্টেশনে গুলিবিধ্ব হন বরুণ। দুষ্কৃতীরা তাঁকে হত্যা করে। অসমসাহসী এই মানুষটির কৃতিত্বকে কুর্নিশ জানাচ্ছে ২৪ ঘণ্টা। অদম্য সাহসের জন্য এবারের বিশেষ অনন্য সম্মান প্রয়াত বরুণ বিশ্বাসকে।
জীবনকৃতি সম্মান:
মান্না দে: যতদিন বেঁচে থাকবে আড্ডাপ্রিয় বাঙালির কফি হাউস, ততদিন বেঁচে থাকবে মান্না দের গান। ছ'দশকেরও বেশি সময় ধরে আপামর ভারতীয় স্রোতাকে তাঁর কণ্ঠের জাদুতে মন্ত্রমুগ্ধ করে রেখেছেন এই কিংবদন্তী কণ্ঠশিল্পী। বলিউড থেকে টলিউড, ঠুমরি, টপ্পা, ধ্রুপদ,খেয়ালের সীমারেখা ছাড়িয়ে পাশ্চাত্য গান, সঙ্গীতের সব অলিগলিতেই তাঁর অবাধ সাবলীল যাতায়াত। নব্বই পেরিয়েও তিনি চির যুবক, চির আধুনিক। এই বয়সেও তাই নতুন করে রবীন্দ্র সঙ্গীতের অ্যালবাম করা নিয়ে মেতে ওঠেন। সারা জীবন পেয়েছেন বহু পুরস্কার। ২০০৭ সালে পান দাদাসাহেব ফালকে। এবারের ২৪ ঘণ্টার অনন্য জীবনকৃতি সম্মান এই কিংবদন্তী গায়ককে।
এই বছরের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অনন্য সম্মান প্রাপকরা হলেন,
সঙ্গীত- পদ্মবিভূষণ পণ্ডিত শিবকুমার শর্মা
জম্মু-কাশ্মীরের লোকবাদ্যযন্ত্র সন্তুরকে প্রাদেষিকতার গণ্ডি ছাড়িয়ে বিশ্বের দরবারে প্রতিষ্ঠিত করেছেন পণ্ডিত শিবকুমার শর্মা। পঞ্চাশের দশক থেকেই সুরেলা এই বাদ্য যন্ত্রটি নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা শুরু করেন তিনি। একে নিয়ে যান লোকত্তর এক উচ্চতায়। ১৯৫৬ সাল থেকে শুরু করেন চলচ্চিত্রে সঙ্গীত পরিচালনার কাজ। ষাটের দশকে জুড়ি বাঁধেন আর এক কিংবদন্তী ,বংশীবাদক হরিপ্রসাদ চউরাশিয়ার সঙ্গে। সুর দেন একাধিক হিন্দী সিনেমার চিরস্বরণীয় গানের। সারা জীবন অক্লান্ত পরিশ্রমের সাথে তাঁর অতুলনীয় প্রতিভার মিশ্রণ ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের জগতকে সমৃদ্ধ করেছে। বিশ্বের দরবারে ভারতীয় বাদ্যযন্ত্র সন্তুরকে আলাদা আসন দিয়েছে। এবারের সঙ্গীতে অনন্য সম্মান পণ্ডিত শিবকুমার শর্মাকে।
সাহিত্য- শ্রী অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়
নীলকন্ঠ পাখির খোঁজের ছিন্নমূল মানুষের হাহাকার ভাষা পায় তাঁর লেখনীর হাত ধরে। জীবন প্রবাহে আলো আঁধারে অনন্ত মানুষের মুখ তাঁর ভাষায় বাঙ্ময়। অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের কলমে বাংলা সাহিত্য বার বার ঘুরে ফিরে আসে মানুষের বাঁচার আর্তি। বঙ্কিম পুরস্কার , মানিক স্মৃতি পুরস্কার , সাহিত্য একাদেমি সহ অজস্র পুরস্কারে ভূষিত অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়কে তাঁর সাহিত্য কৃতীর জন্য ২৪ ঘণ্টার অনন্য সম্মান।
অভিনয়- সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়
থিয়েটার মঞ্চ থেকে রূপোলি পর্দা, বাংলা দর্শকদের স্মৃতিতে তিনি সাম্রাজ্ঞী। উত্তম-সুচিত্রা জুটি যতই জনপ্রিয় হোক, তাঁর সঙ্গেই সবথেকে বেশি ছবিতে অভিনয় করেছেন মহানায়ক। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জানিয়েছেন তাঁর সমসাময়িক যতজন নায়িকার সঙ্গে অভিনয় করেছেন তাঁদের মধ্যে তর্কাতীত ভাবে শ্রেষ্ট অভিনেত্রী তিনিই। সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়। তাঁর ব্যক্তিত্ব, তাঁর অভিনয় শৈলী, তাঁর বিশাল অবদানকে ২৪ ঘণ্টার কুর্নিশ।
ক্রীড়া- শ্রী বদ্রু ব্যানার্জি
তাঁর নেতৃত্বে প্রথম ডুরান্ড কাপ জেতে মোহন বাগান। ক্লাব স্তরে অনবদ্য পারফরম্যান্সের জন্য ১৯৫৬-এ মেলবোর্ন অলিম্পিকে ভারতের অধিনায়ক নির্বাচিত হন। মোহনবাগান রত্ন সম্মানে সম্মানিত এই কিংবদন্তি ফুটবলার বদ্রু ব্যানার্জিকে ২৪ ঘণ্টার অনন্য সম্মান।
সমাজসেবা- মহ: আবদুল ওহাব ও সাবিত্রী পাল
এই বছরের অনন্য সাধারণ প্রাপকরা,
শুভঙ্কর বিশ্বাস- উপস্থিত বুদ্ধি ও সাহসের জোরে মায়ের লাল শাড়ি দেখিয়ে চলন্ত ট্রেন থামিয়ে বহু প্রাণ বাঁচায় তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র শুভঙ্কর। দিনটা ছিল ২০১১ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর।
মঞ্জুরী ভাস্কর- বাড়ি বাড়ি কাজ করে দিন গুজরান করতেন অভাবী মঞ্জুরী। হঠাত্ই ভারত্তোলনের অনুশীলন দেখে উত্সাহিত হয়ে ওঠেন। লুকিয়ে প্র্যাকটিস করে ভারতের সর্ব শক্তিমান মহিলা খেতাব পান মঞ্জুরী। কিন্তু, এখনও বাড়ি বাড়ি কাজ করেই পেট চালাতে হয় তাঁকে।
করিমুল হক- অ্যাম্বুলেন্সের অভাবে অসুস্থ মাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে পারেননি। চোখের সামনেই মারা যান মা। সেই দংশনেই নিজের মোটর বাইকে চাপিয়ে মুমুর্ষ রোগীদের হাসপাতাল পৌঁছে দেন চা বাগান শ্রমিক করিমুল হক। স্বপ্ন, পয়সা জমিয়ে একটি অ্যাম্বুলেন্স কেনা।
বিশ্বজিত্ বিশ্বাস- ট্রেনে হকারির টাকা জমিয়েই গড়ে তুলেছেন অনাথ আশ্রম। ৪ জন দিয়ে শুরু। এখন ১৪ বছরের ১১ জন ছেলেমেয়ের স্থায়ী ঠিকানা সেই আশ্রম।
সুভাষিনী দেবী- সব্জি বিক্রি করে তৈরি করেছেন একটা আস্ত হাসপাতাল। ছেলে কাজ করত চায়ের দোকানে। সুভাষিনী দেবীর স্বপ্ন ছিল ডাক্তার হবে ছেলে। হোমে পড়াশোনা করে মায়ের স্বপ্নপূরণ করেছে ছেলে। মেয়ে নার্স। তাঁরাই এখন চালান মায়ের হাসপাতাল। দু:স্থদের জন্য বিনামূল্যে চিকিত্সা ছাড়াও রয়েছে আধুনিক অস্ত্রপচারের ব্যবস্থাও।
ভবেশ দাস এবং অর্চনা দাস- আয়লায় অনাথ হয়ে যাওয়া ৩০ জন শিশুকে নিয়েই এই দম্পতি গড়ে তুলেছেন তাঁদের সুখের সংসার।