গায়ক হেমন্তকে ছাপিয়ে যাওয়াই সুরকার হেমন্তের সব চেয়ে বড় কৃতিত্ব
রাগটা ঠিক যতটুকু দরকার, ততটুকুই ব্যবহার করতেন। আবার ফিরে এসে অন্য পথে চলে যেতেন।
জয় সরকার
গায়ক হিসাবে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের বিশ্বজোড়া নাম। হেমন্ত মানেই সুন্দর গায়কি, জোরালো কণ্ঠস্বর। তাঁর খ্যাতির আড়ালে লুকিয়ে তার গায়কসত্তা। আমি যখন সুরকার হিসাবে কাজ শুরু করলাম, বুঝলাম, আসলে তাঁর গায়কির আড়ালে ঢাকা পড়ে গিয়েছে এক বিখ্যাত সুরকার। সঙ্গীত পরিচালক হিসাবে আমার কাছে সুরকার হেমন্ত মুখোপাধ্যায় অনেক বড়।
তিনি এমন এক সুরকার, যাঁর শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের শিক্ষা ছিল না। তিনি নিজেই একথা বহুবার বলেছেন। কিন্তু তাঁর সুর শুনে কেউ তা ধরতে পারবেন না। তিনি যেভাবে তাঁর কম্পোজিশনে রাগ ব্যবহার করতেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (Rabindranath Tagore) ছাড়া আর সেই ধরনের প্রয়োগ অন্য কোথাও দেখিনি। কেন রবীন্দ্রনাথের উদাহরণ দিলাম, তা বলি। ধরা যাক, রাগ একটা রাস্তা, যে পথ দিয়ে গানকে যেতে হয়। আর ঠিক তার ভিতর থেকেই তৈরি হয় সুর। হেমন্তের সুরেও রাগ সেই রাস্তা ধরে হেঁটেছে। কিন্তু তিনি কখনই তাঁর গানকে গণ্ডিতে বেঁধে ফেলেননি। বরং গানটিকে তার নিজের মতো করেই চলতে দিয়েছেন। তবে কখনও সহজ পথেও হাঁটেননি। হাঁটলেও তা কঠিন পথেই তৈরি করেছেন।
আরও পড়ুন: ২ মাসে সম্পূর্ণ ভোলবদল উদিত-পুত্রর, করোনা আক্রান্ত হওয়ার পর ফিরলেন নতুন লুকে
যে কোনো সুরকারেরই প্রথম চ্যালেঞ্জ থাকে গানের মুখড়াটা ভাল করে তৈরি করা। মুখড়াটা ভাল করে তৈরি হয়ে গেলেই অন্তরা আরও ভাল করার চ্যালেঞ্জটা নিজের থেকেই বেড়ে যায়। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের ক্ষেত্রে এটাও প্রযোজ্য। তিনি অনায়াসে বিচরণ করতেন সব দিকে । রাগটা ঠিক যতটুকু দরকার, ততটুকুই ব্যবহার করতেন। আবার ফিরে এসে অন্য পথে চলে যেতেন। এভাবেই সুর করতেন তিনি। শোনা যায় তাঁর সুরে গান গাওয়া মান্না দে'র (Manna Dey) কাছেও বেশ কঠিন ছিল।
সলিল চৌধুরীর (Salil Chowdhury) গান শুনলে বুঝবেন, তা পশ্চিমি সঙ্গীতের অনবদ্য সৃষ্টি। আমাদের গান-বাজনার মধ্যে পাশ্চাত্য ধ্রুপদী সঙ্গীতের প্রভাব খুব বেশি। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় কিন্তু সেই পথে হাঁটেননি। তবে তাঁর কিছু গানে এমন রাস্তা পাওয়া যায়। হেমন্ত আসলে যে কোনো ছবির ভাষা খুব সুন্দর বুঝতেন। তাই সুরকার হিসেবে তাঁর এত সাফল্য। তাঁর সুরের মধ্যে আবেগ, নিষ্ঠা, শিক্ষা, মনসংযোগ এবং যত্ন থাকত বলেই বিপুল সংখ্যক কাজ করেও তিনি এত সাফল্য অর্জন করেছেন। একটু অন্য দিকে গিয়ে লোকগানের কথাও বলতে পারি। তিনি এমনই এক মানুষ ছিলেন যাঁর মনের মধ্যেই এক বাউল বাস করত। আর তার হাত ধরেই তাঁর ভিতর থেকে উঠে এসেছিল 'জীবনপুরের পথিক রে ভাই' গানটা।
কেবল বাংলায় নয়, মুম্বইতেও দাপিয়ে বেড়িয়েছেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। নিমেষেই কী ভাবে গান তৈরি করে ফেলতেন, সেই টেকনিক এখনও সকলের অজানা।
শুধু সিনেমার ভাষা নয়, সঙ্গীতপ্রেমী শ্রোতাদের মনও বুঝতে পারতেন এই শিল্পী। তিনি সব সময় বলতেন, গান এমন ভাবেই তৈরি করতে হবে, যাতে শ্রোতারা তা গুনগুন করে গাইতে পারেন। গাইতে গিয়ে তাঁদের যেন কঠিন না মনে হয়। তবেই সেই গান সকলের মনে থেকে যাবে। তাঁর তৈরি পুজোর গান কিশোরকুমার যখন গেয়ে ওঠেন তখন তা কালজয়ী একটি গান হয়ে থেকে যায়। যে কোনও পুজোর প্যান্ডেলে এই গান আজও শোনা যায়।
খারাপ লাগে, হেমন্তর মহালয়ার গান কেউ সেভাবে শুনতে পেলেন না। উত্তমকুমার-বিতর্কে (Uttam Kumar) যা একবছর চলেই বন্ধ হয়ে গেল। তবে যেটা অনেকেই জানেন না, তা হল, এখনও ষষ্ঠীর দিন ভোরে অল ইন্ডিয়া রেডিয়োয় এই গান বাজে। গায়ক হেমন্তকে ছাপিয়ে যাওয়াই সুরকার হেমন্তের সব চেয়ে বড় কৃতিত্ব। সেখানেই বাজিমাত করেন এই শিল্পী।
নিজের গায়কসত্তা থেকে বেরিয়ে এসে নিজেকে সম্পূর্ণ ভেঙেছেন এই সুরকার। তবেই না ভৈরবী রাগ থেকে বেরিয়ে শুদ্ধ গান্ধার ছুঁয়ে ফের রাগে ফিরে এসেছেন তিনি! সরল প্রগ্রেশন খেলানোর রাজা যে তিনিই!
(Zee 24 Ghanta App : দেশ, দুনিয়া, রাজ্য, কলকাতা, বিনোদন, খেলা, লাইফস্টাইল স্বাস্থ্য, প্রযুক্তির লেটেস্ট খবর পড়তে ডাউনলোড করুন Zee 24 Ghanta App)
আরও পড়ুন: জন্মদিনে ১০টি কেক কাটলেন উত্তম কুমারের নাতি, 'Cycling shoe' দিলেন Devlina