বিদ্যার অনবদ্য `কাহানি`

এতদসত্ত্বেও আপনি প্রশ্ন করতেই পারেন `কেন দেখব এই ছবি?` এই ছবি ক্ল্যাসিক নয়। কাল্ট ছবি হয়ে ওঠার দাবিদারও নয় মোটেই। বেশ কিছু জায়গাতে কার্যকারণগত অসঙ্গতিও চোখে পড়তে পারে। তবে দু`ঘণ্টা দশ মিনিটের জন্য আদ্যোন্ত স্মার্ট, অসম্ভব বুদ্ধিদীপ্ত এবং বেশ জটিল একটা জিগস` পাজ্‌ল সল্ভ করার ছবি যদি দেখতে চান তবে এ ছবি `মাস্ট ওয়াচ`।

Updated By: Mar 12, 2012, 10:40 PM IST

শময়িতা চক্রবর্তী

কালীঘাট মেট্রো প্ল্যাটফর্মের হলদে বিপদসীমার ধারে সাতমাসের অন্তঃসত্ত্বা এক মহিলা। পরের ট্রেনের অপেক্ষায়। ট্রেন আসতে মিনিট খানেক বাকি। এমন সময় কাঁধে আলতো টোকা। ঘাড় ঘোরালেন গর্ভবতী। গোবেচারা, একগাল হাসি নিয়ে এক নিপাট ভদ্রলোকের উৎসুক মুখ।
'নমস্কার ম্যাডাম, আপনি কি বিদ্যা বাগচি?'
ফুল স্পিডে ট্রেন ঢুকছে প্ল্যাটফর্মে।
'হ্যাঁ।'
মেট্রো লাইনে সজোরে এক  ধাক্কা।
কাট।
ইন্টারভাল।
মাল্টিপ্লেক্সের নরম কুর্সির আরাম ততক্ষণে অসহনীয় হয়ে উঠেছে। নম্রতা রাও-এর নিখুঁত এডিটিং-এ শুরু থেকেই টুকরো টুকরো গল্প ছড়িয়ে পড়েছে দর্শকদের সামনে। আমাদের মনের মধ্যে চলছে বেশ জটিল একটা জিগস' পাজ্‌ল সল্ভ করবার দুর্বার প্রয়াস। সঙ্গে ছিল হঠাত্‌ সাংঘাতিক কিছু ঘটে যাওয়ার পূর্বাশঙ্কা। বিরতিতে যাওয়ার আগের এই শটটাই 'কাহানি'-কে পশ্চিমী থ্রিলারগুলোর সঙ্গে টেক্কা দেওয়ার যাবতীয় রসদ জুগিয়ে দিল।
এরকম টানটান উত্তেজনা, প্রতিমুহূর্তের একের পর এক 'রেড হেরিংস' যে এই ছবির ইউএসপি ততক্ষণে বোঝা হয়ে গিয়েছে। চেনা ছকের তোয়াক্কা না করে, একবারের জন্যও হোঁচট না খেয়ে অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে গেছে 'কাহানি'-র কাহিনি।  তবে অন্যান্য থ্রিলারের সঙ্গে এই ছবির একটা মৌলিক তফাত আছে। সাধারণত অন্যান্য থ্রিলারগুলো সাসপেন্স তৈরির জাগতিক চাপের কাছে নতি স্বীকার করে ছবিতে মন ঢালতে ভুলে যায়। ফলে, টানটান উত্তেজনা থাকলেও প্রাণহীন হয়ে পরে অনেক ক্ষেত্রেই।

'কাহানি' আলাদা। কারণ এ ছবি এমন এক মহিলার গল্প যিনি কেবলমাত্র স্বামীকে খুঁজতে কলকাতায় উড়ে এসেছেন তাই নয়, তিনি অন্তঃসত্ত্বা। স্বামীকে খুঁজতে গিয়ে একের পর এক মানসিক প্রতিকূলতার পাহাড় বিদ্যা বাগচিকে পেরোতে হয়েছে সাতমাসের অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার শারীরিক ক্লান্তি নিয়েই। এক কথায় সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া কলকাতাই তাঁকে শিখিয়েছে কীভাবে একলা চলতে হয়। সেতুর সিনেমাটোগ্রাফিতে ফুটে উঠেছে চেনা কলকাতার 'কাব্যে উপেক্ষিত' ছবি। এই সিনেমাতে রাগ, ভয়, অভিমান, সারল্য, আক্ষেপ, প্রেম সহ আরও যত রকমের আবেগের অভিব্যক্তি হতে পারত তার প্রত্যেকটাই কলকাতার রোড-সাইড শটে বাঁধা পড়ে গেছে।
তবে গল্পের গতি যদি রাজধানী হয় তবে অভিনয়ের সাবলীলতা এছবির হৃদয়পুর। প্রায় প্রত্যেকের অভিনয়ই অনবদ্য। সাদা উর্দির পুলিস 'কাম' গোবেচারা প্রেমিকের চরিত্রকে পরমব্রত ধীরে ধীরে 'কাল্ট ক্যারেক্টর' করে ফেলছেন। তবে আলাদা করে দুজনের কথা না বললেই নয়। প্রথমজন, আইবি অফিসার খানের ভূমিকায় নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকি। দুর্মুখ, উদ্ধত, অসংবেদনশীল অথচ কর্তব্যনিষ্ঠ এবং অসম্ভব ব্যক্তিত্বসম্পন্ন, বলিষ্ঠ চরিত্রে নওয়াজউদ্দিন অসাধারণ।
দ্বিতীয়টি, আপাত দুর্বল, গোবেচারা ইন্স্যুরান্স এজেন্ট তথা অম্লানবদন ভাড়াটে খুনির চরিত্রে শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়। আকর্ণবিস্তৃত হেসে একের পর এক শিকারকে অবলীলায় খুন করেও নিজের আত্মরক্ষার পরিসরে যে নিতান্তই অসহায়। বব বিশ্বাসের চরিত্র এযাবত্‌কালে শাশ্বতর সেরা অভিনয়গুলির শীর্ষস্থানেই থাকবে।

বিদ্যা বাগচির চরিত্রে বিদ্যা বালন ঠিক নিজে অভিনয় করেননি। বলা ভাল, অভিনয় করছিল তাঁর চারপাশ। ইশ্‌কিয়া, নো ওয়ান কিল্‌ড জেসিকা, দ্য ডার্টি পিকচার-এর পর কাহানি-তে সিনেমার সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয় করলেন তিনি। এবং আরও একবার বুঝিয়ে দিলেন কেন তিনি কেন্দ্রীয় নারী চরিত্রে সেরা। 'টিনসেল টাউন'-এর চিরাচরিত 'গ্ল্যামর কুইন' কনসেপ্টটাকে এক লহমায় ভেঙে গুঁড়িয়ে সম্পূর্ণ নতুন একটা অন্যধারার আইডিয়া নির্মাণ করলেন। বাণিজ্যিক ছবিতে একে অনন্যসাধারণ না বলে উপায় নেই। শুধু স্ক্রিপ্টে নয়, নতুন করে তাঁর শরীর নির্মাণের ঝুঁকিও নিয়েছেন তিনি। তাঁর স্পর্ধাকে কুর্নিশ জানানোর ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না এই কলম।
থ্রিলারে সঙ্গীতের ভূমিকা ঠিক যতখানি হওয়া উচিত তার এক বিন্দুও কমবেশি করেননি সুজয়। অমিতাভ বচ্চনের গলায় ভাঙা ভাঙা উচ্চারণে 'একলা চলো রে'-র ব্যবহার অনবদ্য।
এতৎসত্ত্বেও আপনি  প্রশ্ন করতেই পারেন 'কেন দেখব এই ছবি?' এই ছবি ক্ল্যাসিক নয়। কাল্ট ছবি হয়ে ওঠার দাবিদারও নয় মোটেই। বেশ কিছু জায়গাতে কার্যকারণগত অসঙ্গতিও চোখে পড়তে পারে। তবে দু'ঘণ্টা দশ মিনিটের জন্য আদ্যন্ত স্মার্ট, অসম্ভব বুদ্ধিদীপ্ত এবং বেশ জটিল একটা জিগস' পাজ্‌ল সল্ভ করার ছবি যদি দেখতে চান তবে এ ছবি 'মাস্ট ওয়াচ'।

.