গল্পস্বল্প: প্রেম, দাম্পত্য, বিচ্ছেদ- তসলিমাকে নিজের হাতে গড়েছিলেন কবি রুদ্র
দুই কবির সাংসারিক জীবন সুখের হয়নি। ১৯৮৬ সালে বিচ্ছেদ হয় তাঁদের। তবে, শহিদুল্লাহের আমৃত্যু বন্ধুত্বের সম্পর্ক ছিল তসলিমার
সোমনাথ মিত্র
এই কলমেই লেখা হয়েছিল,
“স্বাধীনতা- সে আমার স্বজন হারিয়ে পাওয়া একমাত্র স্বজন,
স্বাধীনতা- সে আমার প্রিয় মানুষের রক্তে কেনা অমূল্য ফসল।
ধর্ষিতা বোনের শাড়ি ওই আমার রক্তাক্ত জাতির পতাকা।”
এই কলমেই লেখা হয়েছিল,
তোমাদের বিশ্বাসী স্রষ্টার কলিজা
ছিঁড়ে ফেলে পান করি এক বুক রক্ত।
ধর্মের কন্ঠনালী ভেঙ্গে
পান করি দুর্গন্ধ পুঁজ-
বিষাক্ত এ পাপিষ্ঠ মুখে।
এই কলমেই লিখেছিলেন,
বিশ্বাসের তাঁতে আজ আবার বুনতে চাই
জীবনের দগ্ধ মসলিন।
আবার এই কলমেই লিখলেন
ভালো আছি, ভালো থেকো আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখো...ভিতরে বাহিরে অন্তরে অন্তরে আছো হৃদয় জুড়ে।
সেই কলম বাংলাদেশী কবি রুদ্র মহম্মদ শহিদুল্লাহের। কখনও বিদ্রোহী, কখনও মেহনতী, কখনও শুধুই প্রেমিক। এক হাতে নজরুল, এক হাতে রবীন্দ্রনাথ। ‘মানুষের মানচিত্র’ আঁকতে চেয়েছিলেন। চাষা, রাখাল, তাঁতি, মুচি, মেথর, মাঝি এরাই কবির প্রিয় চরিত্র। এক জায়গায় লিখছেন, আমাদের কৃষকেরা শূন্য পাকস্থলী আর বুকে ক্ষয়কাশ নিয়ে মাঠে যায়। আমাদের নারীরা ক্ষুধায় পীড়িত। হাড্ডিসার। লাবন্যহীন। আমাদের শ্রমিকেরা স্বাস্থ্যহীন। আমাদের শিশুরা অপুষ্ট, বীভত্স-করুণ। তিনি চেয়েছিলেন, ইসলাম ধর্ম পরিত্যাগ করে ‘মানব ধর্মে’ দীক্ষিত হতে। উকিলের সঙ্গে কথাও বলেন। এত তাড়াতাড়ি মৃত্যু দরজায় এসে কড়া নাড়বে হয়তো ভাবেননি। তাই আর শরীরকে ‘ধর্মান্তর’ করা হয়ে ওঠেনি। কিন্তু তাঁর কবিতা পেরেছিল। ভীষণরকম। ধর্ম, দেশের বেড়াজাল পেরিয়ে বিশ্বজনীন হয়ে উঠেছিল মাত্র ৩৪ বছর বয়সী রুদ্র মহম্মদ শহিদুল্লাহের কবিতা। আজই এই দিনেই বড্ড অসময়ে চলে গিয়েছিলেন তরুণ প্রতিশ্রুতিমান বিদ্রোহী-রোমান্টিক কবি শহিদুল্লাহ।
জন্ম ১৯৫৬ সালে বরিশালে। পড়াশুনা বরিশালেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় স্নাতক। কবিতা চর্চা স্কুল পড়ার সময়ই। দশম শ্রেণিতে পড়তে পড়তে তাঁর প্রথম কবিতা প্রকাশ পায় দৈনিক ‘আজ়াদ’ পত্রিকায়। ‘আমি ঈশ্বর আমি শয়তান’। ছোটোবেলা থেকেই সাহিত্য অনুরাগী শহিদুল্লাহ। একবার ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়াকালীন, সিনেমা দেখতে যাওয়ার নাম করে দিদার ট্যাঙ্ক থেকে কিছু টাকা চুরি করেন শহিদুল্লাহ ও মামাতো ভাইয়েরা। পরে শহিদুল্লাহের সিদ্ধান্তে ওই টাকায় তৈরি হয় লাইব্রেরি। নাম দেওয়া হয় ‘বনফুল লাইব্রেরি’। আবার ভীষণ অভিমানীও ছিলেন তিনি। দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়েন যখন, স্কুলে এক আবৃত্তি প্রতিযোগিতায় নাম দিয়ে প্রথম হন। তাঁর বাবা ওই স্কুলের পরিচালন সমিতির সভাপতি ছিলেন। সন্তান প্রথম হওয়া সত্ত্বেও, প্রথম পুরস্কারটি অন্যজনকে প্রদান করেন তিনি। বাবা পুরস্কার বাবদ তাঁকে অনেক বই কিনে দিয়েছিলেন। অভিমানী ছোট্ট শহিদুল্লাহ ফিরিয়ে দেয় বাবার সেই ‘পুরস্কার’।
যৌবনে শহিদুল্লাহ বেপরোয়া। বাউণ্ডুলে। আড্ডাবাজ। প্রাণবন্ত। ঠোঁটের কোণে অবিরাম হাসির ঝলক। কিন্তু কবিতার প্রতি ততটাই সংযত, শান্ত, অন্তর্মুখী। একগাল জমাট দাড়ি, কোঁকড়ানো চুল, পঞ্জাবি জিন্স পরা ছিপছিপে যুবকটি কত প্রেয়সীর হার্টথ্রব। কবি শামসুর রহমান বলেন, এই তরুণ কবির মধ্যে এক ধরনের বাউণ্ডুলেপনা ছিল, যা তাঁকে সুস্থির হতে দেয়নি। নিজেকে পুড়িয়েছেন আতশবাজির মতো। যখন প্রেমে মশগুল, তাঁকে ধরে কে? ডানায় ভর করে বেশ কিছুদিন উধাও।
ব্যাপার কী প্রশ্ন করলে বলতেন, প্রেমে পড়েছি দোস্ত।
এক তরফা?
সহাস্যে উত্তর, কৃষ্ণ দিয়েছে ডাক, রাধা কি মুখ ফেরাতে পারে!
সেই রাধা কি লেখিকা তসলিমা নাসরিন, জানা নেই। কবির সঙ্গে তসলিমা নাসরিনের পরিচয় লেখালেখির সূত্রে। রুদ্রের লেখার ভীষণ অনুরাগী ছিলেন পেশায় চিকিত্সক তসলিমা। চিঠি চালাচালি থেকে প্রেম, তারপর পরিণয়। রুদ্রের বিয়ে তাঁর পরিবার মেনে নেয়নি। বেশ চলছিল তাঁদের দাম্পত্য জীবন। তসলিমাও ততক্ষণে তরুণ কবি হিসাবে পরিচিতি পেয়ে গেছেন। তসলিমার লেখা নিয়ে শহিদুল্লাহ এক জায়গায় বলছেন, তাঁর লেখায় অগভীর ছুঁয়ে যাওয়া হলেও ভাষা মেদহীন। বেশ জোরালো। মোটেই মেয়েলি গন্ধ নেই।
তবে, তসলিমার ‘পুরুষ বিদ্বেষী’ লেখা নিয়ে কঠোর সমালোচনাও করেছিলেন রুদ্র মহম্মদ। তসলিমার এই বিদ্বেষের কারণ হিসাবে নিজেকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে রুদ্র লেখেন, প্রথমত দায়ী রুদ্র মহম্মদ শহিদুল্লাহকে আমি মোটামুটি সকল পুরুষদের পক্ষ থেকে তীব্র নিন্দা ও প্রচণ্ড ধিক্কার জানাচ্ছি। আশা করছি, এরপর আপনার ক্ষুরধার লেখনি থেকে পুরুষেরা রেহাই পাবে। আপনি বরং সৃজনশীল লেখার ব্যাপারে সিরিয়াস হন।
দুই কবির সাংসারিক জীবন সুখের হয়নি। ১৯৮৬ সালে বিচ্ছেদ হয় তাঁদের। তবে, শহিদুল্লাহের আমৃত্যু বন্ধুত্বের সম্পর্ক ছিল তসলিমার। এক স্মৃতিকথায় তসলিমা জানাচ্ছেন, সতেরো বছর বয়স থেকে রুদ্রকে চিনি। রুদ্র আমার সমস্ত চেতনা জুড়ে ছিল। জীবন-জগত্ চিনিয়েছে রুদ্র। একটি একটি করে অক্ষর জড়ো করে কবিতা শিখিয়েছে সে। তবে, শেষের দিকে তিক্ততার সম্পর্ক তৈরি হয় তাঁদের মধ্যে। রুদ্রের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগও এনেছিলেন তিনি। রুদ্রের জীবনযাপনই তাঁদের সম্পর্কে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
বিবাহ-বিচ্ছেদের পর রুদ্র আরও ‘মুক্ত জীবন যাপন’ করেন। শরীরের উপর দিনের পর দিন অযত্নে, গভীর অসুখে পড়েন তিনি। অনিয়মিত খাওয়া দাওয়ায় পাকস্থলীতে ক্ষত তৈরি হয়। তসলিমা বলছেন, তা বলে কবিতাকে কখনও অযত্ন করেননি। কবিতায় ছাপ পড়েনি শরীরের যন্ত্রণা। রুদ্রের শেষ জীবন কেটেছে একাকী। অসহায়। কিন্তু, তাঁর আড্ডা থেমে থাকেনি। ১৯৯১ সালে ২১ জুন নিজের বাড়িতেই মারা যান রুদ্র মহম্মদ শহিদুল্লাহ। কবিতা, প্রবন্ধ, গানে ছোট্ট জীবনটাকে অসীম তারে বেঁধেছেন। অনেকেই বলেন স্ত্রী তসলিমাকে উদ্দেশ্য করে তাঁর লেখা, ‘ভাল আছি ভাল থেকো’ গানটি। এই গানের সুর দিয়েছেন নিজেই। রুদ্রের মৃত্যুর পর ‘ফিরে আসুক রুদ্র’ শীর্ষক লেখায় তসলিমা বলছেন, রুদ্রকে আমি খুব কাছ থেকে দেখেছি। দেখেছি দূর থেকেও। রুদ্র সেই মানুষ, যে কোনও দূরত্ব থেকেও ভালোবাসা যায়। ভালোবাসা যায় বলেই আজও আকাশের ঠিকানায় চিঠি লেখেন কবি রুদ্র মহম্মদ শহিদুল্লাহ। আশ্রয় খোঁজেন প্রেমিকার নিবিড় ছোয়ায়...