হৃদয় ভরা টিফিন-বাটি, কথা-বলা খাবার

পূর্ণিমা চাঁদের মধ্যে যে কবি খুঁজে পেয়েছিলেন রুটির সাদৃশ্য, সে সময় থেকে এযুগের ফারাক প্রায় ছয় দশক। সময় এখন গদ্য থেকে পদ্যের দিকে এগিয়েছে। খাবারের শব্দার্থ বদলেছে। পাল্টেছে রূপ-রস-গন্ধ। মানুষের উদর ও মনের যোগাযোগের সেতু হতে পারে স্বাদু খাবার, এমন করে কি কেউ কখনও ভেবেছিল? রীতেশ বাত্রার এ ছবির নির্মাণে টাকা জুগিয়েছেন দেশি-বিদেশি এক ঝাঁক প্রযোজক। যাদের মধ্যে ঊজ্জ্বল নাম- করণ জোহর ও অনুরাগ কাশ্যপ।

Updated By: Sep 25, 2013, 06:08 PM IST

শর্মিলা মাইতি

ছবির নাম- দ্য লাঞ্চবক্স
রেটিং- ****1/2
পূর্ণিমা চাঁদের মধ্যে যে কবি খুঁজে পেয়েছিলেন রুটির সাদৃশ্য, সে সময় থেকে এযুগের ফারাক প্রায় ছয় দশক। সময় এখন গদ্য থেকে পদ্যের দিকে এগিয়েছে। খাবারের শব্দার্থ বদলেছে। পাল্টেছে রূপ-রস-গন্ধ। মানুষের উদর ও মনের যোগাযোগের সেতু হতে পারে স্বাদু খাবার, এমন করে কি কেউ কখনও ভেবেছিল? রীতেশ বাত্রার এ ছবির নির্মাণে টাকা জুগিয়েছেন দেশি-বিদেশি এক ঝাঁক প্রযোজক। যাদের মধ্যে ঊজ্জ্বল নাম- করণ জোহর ও অনুরাগ কাশ্যপ।

ঠিক কোনখান থেকে এ ছবির শুরু ঠিক ঠাহর করতে পারলাম না। তার আগেই দর্শকের সিট থেকে ঢুকে পড়লাম স্বাদ-বিশ্বে। ডাব্বাওয়ালার ঝাঁকির ভেতরে পরিব্রাজক হয়ে চলতে শুরু করলাম মন-খারাপের দিস্তা হয়ে। এমন কাহিনিও কি বলা যায়? পায়রার পায়ে বাঁধা পড়ে নয়, উড়ে যাওয়া মেঘের সারি হয়ে নয়, চিঠি চলেছে রুটির ভাঁজে। নাম-না-জানা কারওর কাছে।
ইন্টারনেট-বিবর্তনের যুগে এমন ছবি! বিশ্বাস হঠাত্ থমকে দাঁড়ায়। কান ফেস্টিভালে একমাত্র পুরস্কৃত ভারতীয় ছবি যা এই ক`দিন আগেও অস্কার নমিনেশন তালিকায় জোর প্রতিযোগিতা চালিয়েছে। ঠিক কোন হৃদয়তন্ত্রীতে টান দিলে, এইরকম একটি নির্ভেজাল প্রেমের ছোটগল্প কখন দেশকালসীমা ছাড়িয়ে পৃথিবীর সকলের হয়ে যায়। এমন এক সম্পর্কের বন্ধন যা শুরু হয় পেট থেকে। ছবির অবশ্যম্ভাবী এক ধ্রুবপদ হয়ে ওঠে খাদ্য। সুস্বাদু ও সুগন্ধী। দৃশ্যত যা, তার চেয়েও বেশি গূঢার্থ বহন করে চলে যে।

ইলা। বছর ত্রিশের যে-গৃহবধূ প্রতিটি দিন গুজরান করে খাওয়ার পরে রাঁধা আর রাঁধার পরে খাওয়া দিয়ে। মুম্বইয়ের মধ্যবিত্ত ঘরকন্নার প্রতিভূ সে। রান্নায় নতুন মশলা মিশিয়ে নতুন স্বাদ, নতুন পদ তৈরি করে ডাব্বা ভরে দিয়েও স্বামীর পেট থেকে হৃদয়ের ঠিকানা কোনওদিনও যোগাড় করতে পারে না যে। জামা-কাপড় কাচতে গিয়ে স্বামীর শার্টের ঘ্রাণ থেকে বুঝে নিতে পারে, স্বামী অন্য মহিলায় আসক্ত। তবু নীরবে গিলতে থাকে এই গোটা জীবন। টুকরো টুকরো কাগজে লিখে জানায় তার অদেখা অনুরাগীকে। অতএব ভুল ঠিকানায় চলে যাওয়া লাঞ্চবক্স একদিন এক মুঠো প্রেমের স্বীকৃতি নিয়ে আসে। যার কাছ থেকে সেই স্বীকৃতি আসে, তাঁর জীবনে এখন অপরাহ্নের আলো। ফার্নান্ডেজ। দীর্ঘ ৩৫ বছরের চাকুরিজীবনেও ছেদ পড়তে চলেছে। “ভুল” ডাব্বাভরা, রন্ধন পটিয়সী গৃহবধূর হাতে রান্না-করা পদের সুস্বাদ পৌঁছয় তাঁর হৃদয়ে। সেই শুরু সম্পর্কের।
গোটা ছবি জুড়ে খাবারের বলিষ্ঠ অথচ নিঃশব্দ উপস্থিতি, এর আগে কোনও ছবিতে এত সফলভাবে এক্সপেরিমেন্ট করা হয়েছে কিনা জানা নেই। এমনকী, সেই গৃহবধূর যে-সব মশলা সাপ্লাই আসে উপরওয়ালা আন্টির কাছ থেকে। দড়ি-বাঁধা ঝুড়ি নেমে আসে সময়ে সময়ে। এমন চরিত্র, যাকে কোনওদিন দেখা যায় না। প্রায় দৈববাণীর মতো উপর থেকে ভেসে আসে গলা, অনুঘটকের মতো চালনা করে সম্পর্ককে। খাবারই নিয়ন্ত্রণ করে সম্পর্ক ও আবেগকে। অফিসে নতুন জয়েন করা অনভিজ্ঞ সেই ছেলেটি, কাজ শেখার জন্য ছটফট করে। যে-চেয়ারটিতে সে বসবে ফার্নান্ডেজের রিটায়ারমেন্টের পর, তাকে বশ করে সেই খাবার দিয়েই। ইলার পিতৃবিয়োগের পর শোকগ্রস্ত মা (লিলেট দুবে) বলেন, “এখন বড় খিদে পাচ্ছে, পরটা খেতে ইচ্ছে করছে...” কী আশ্চর্য নিস্তব্ধ বেদনার সেই অনুভূতি!

নিমরত কউর এ ছবির আবিষ্কার। বিনা মেক-আপে, কখনও আই-ব্রো প্লাক পর্যন্ত না করে স্ক্রিনে এসেছেন তিনি। অপূর্ব সুন্দরী। এত সাবলীল, স্বচ্ছন্দ অভিনয় যে খুব ভুল না হলে, ভারতীয় ছবির ইতিহাসে স্মরণীয় নায়িকাদের সারিতে ইনি অচিরেই জায়গা করে নেবেন। অপূর্ব অভিনয় ইরফান খানের। বলাই বাহুল্য। বৃদ্ধ বয়সের ধীরতা, স্থৈর্য যেভাবে প্রতি মুহূর্তে ফুটিয়ে তুললেন, না দেখলে বিশ্বাস হয় না।
ভাল লাগে নওয়াজউদ্দিন ও ইরফানের যুগলবন্দি। শেষ হলেও শেষ না হওয়ার এক অনুভূতি ছড়িয়ে থাকে মনে-প্রাণে। ডাব্বাওয়ালাদের কোরাস কানে বাজতে থাকে। ছোটগল্পের অলিগলি দিয়ে যাদের জীবনের ধারাপাতও উঠে এসেছে।
রীতেশ বাত্রার লাঞ্চবক্স, সব মিলিয়ে দর্শকের যে খিদেটা মেটায়, তাকে আমরা এক কথায় উপবাসভঙ্গও বলতে পারি!

.