প্রাণ ও প্রাণহীনের আলাপচারণ
এ ছবির রিভিউ একটু পেছন দিক থেকে শুরু করা যাক। খুব ভুল না বললে, এটাই ছিল এ বছরের শেষ বহু-প্রতীক্ষিত ছবি। কেন ছবিটার রিলিজ ডেট পিছোচ্ছিল, তার সঠিক কারণ জানা নেই। আমির খান এবং প্রোডিউসররা এ ছবি নিয়ে একটু দোটানায় ছিলেন, এমনটা ধরে নেওয়া যায়। কীভাবে মার্কেটাইজ করলে শেষ অবধি ছবি মার খাবে না, এমন সাপ-লাঠির সমীকরণ নিয়ে চিন্তা ছিল বোধহয়। প্রোমোশনের রকমসকম দেখে সেটাই অনুমেয়।
শর্মিলা মাইতি
তালাশ
রেটিং- ****
এ ছবির রিভিউ একটু পেছন দিক থেকে শুরু করা যাক। খুব ভুল না বললে, এটাই ছিল এ বছরের শেষ বহু-প্রতীক্ষিত ছবি। কেন ছবিটার রিলিজ ডেট পিছোচ্ছিল, তার সঠিক কারণ জানা নেই। আমির খান এবং প্রোডিউসররা এ ছবি নিয়ে একটু দোটানায় ছিলেন, এমনটা ধরে নেওয়া যায়। কীভাবে মার্কেটাইজ করলে শেষ অবধি ছবি মার খাবে না, এমন সাপ-লাঠির সমীকরণ নিয়ে চিন্তা ছিল বোধহয়। প্রোমোশনের রকমসকম দেখে সেটাই অনুমেয়।
বলিউডে প্রচলিত আছেই যে, আমির খান যে প্রজেক্টে থাকেন, তার আলপিন থেকে চিলেকোঠা পর্যন্ত ছিনবান করে তবেই নিশ্চিন্ত হন। এ ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। গল্পের তুরুপের তাসটা গোপন রাখাই হয়েছিল। ন্যাশনাল মিডিয়ার সামনে খাপ খোলেননি পরিচালক বা প্রযোজক। ক্রাইম থ্রিলার, কখনো বা সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার বলে ছবির প্রোমোশন হয়েছিল। ক্রাইম থ্রিলার দেখতে বসে সহজে সুপারন্যাচারাল এলিমেন্ট হজম করতে পারবেন কি না, সেই নিয়ে ভেতরে ভেতরে দ্বন্দ্ব তো ছিলই। দর্শকের ওপর অনাবিল আস্থা রেখেই, ক্যামেরার সামনের আর পেছনের লোকগুলো একশো থেকে দুশো ভাগ দিয়েছেন। নিট ফল এক আশ্চর্য ছবি। প্রায় শাশ্বত হয়ে থাকার দাবী রাখে এমন সংলাপঙ। কলাকুশলীদের অসাধারণ মেলবন্ধন। অসামান্য গাঁথুনিতে লৌকিক আর অলৌকিকের সীমারেখা মিলিয়ে দেওয়া.. প্রায় চৌকাঠ পেরনোর মতো সহজে দর্শক যাতে প্যারানর্ম্যালের পরিধিতে যেতে পারেন।
আসি আমির-করিনা-রানি কম্বো অফারে। আমিরের সুপারহিউম্যান ইন্সটিঙ্কট যাঁরা প্রত্যাশা করবেন, তাঁরা কমবেশি হতাশ হবেন। আগেই বলে রাখছি, এখানে আমিরের চরিত্র এক পুত্রহারা বাবার চরিত্র। পলকের ভুলে চোখের সামনে যে ছেলের মৃত্যু দেখেছে। মৃত্যুর আকস্মিকতার শোকে মুহ্যমান মা (রানি মুখার্জি) প্রায় না-মরে বেঁচে আছে।দুটো মৃতবত্ জীবন্ত, অপত্যস্নেহ-জর্জর দুই সত্তা নিজের নিজের মতো করে মৃত সন্তানকে তন্নতন্ন করে খোঁজে। নিছকই এক ছেলেখেলার ভুল যে ছোট্ট ছেলেটিকে টেনে নিয়ে গিয়েছে পরপারে। জীবনধারণ যাদের কাছে হয়ে গিয়েছে প্রতিদিনের বেঁচে থাকার অনুশীলন। পুলিস বিভাগে কর্মরত বাবা নিজেকে ডুবিয়ে রেখেছেন এক অদ্ভুত দুর্ঘটনার অনুসন্ধানে। মুম্বইয়ের জনপ্রিয় তারকা আরমান খানের অস্বাভাবিক কার অ্যাক্সিডেন্ট। শত অনুসন্ধানেও পাওয়া যাচ্ছে না সমস্যার শিকড়। খুনি যেন চোখের সামনেই, তবু তাকে দেখতে পাচ্ছেন না। এই অনুসন্ধানেই তাঁর সওয়ার হয় এক রহস্যময়ী লাস্যময়ী। মিস রোজি। করিনা কপূর..
আচ্ছা ধরুন, আমাদের চারপাশেই তো এমন সব শরীর ঘোরাফেরা করে যাদের খবর আমাদের নেওয়ার কোনও প্রয়োজনই হয় না। যাদের বাদ দিয়েও আমরা স্বাভাবিক জীবনটা কাটিয়ে দিতে পারি। অথবা এমন কিছু শ্রেণির মানুষ যাদের শরীর শুধু যান্ত্রিক বা জৈবিক প্রয়োজনে ব্যবহৃত, ব্যবহৃত, ব্যবহৃত হয়ে পচা শুয়োরের মাংস হয়ে গেলে ফেলে দেওয়াই তো রীতি। চাপা দেওয়া কিংবা গুম করে দেওয়াই তো নিয়ম! কোনওদিন এ নিয়ে প্রশ্ন করেছিল কেউ? শিউরে উঠি করিনা কপূরের ঠোঁটের একটি বিশেষ সংলাপে। "এক লড়কি গায়েব হো গয়া, অর কোই পুছনেওয়ালা ভি নেহি? হম য্যায়সি লোগ তো গিনতি মে ভি নেহি আতি.." পৌঁছে যাই অমোঘ এক প্রশ্নে। যে শরীরগুলোর খোঁজ নেওয়ারও দরকার নেই, সে-শরীর আছে কী নেই তা নিয়ে আমরা এত দৃশ্যকল্প রচনা করি কেন? কেনই বা অশরীরী শব্দের মধ্যে এক শিহরণ বা আলোড়ন খুঁজতে থাকি আমরা..? প্রাণহীন শরীর কি হয় না? কিংবা পরপার ও এপারের মানুষের মধ্যে কী কোনও কথোপকথন হতে পারে না? হলে কী শুধুই তাকে প্ল্যানচেট ইত্যাদি কোনও গা-ছমছমে নাম দিতে হবে? যদি মৃত্যু শব্দটাই তুলে নেওয়া হয় ভাবনার অভিধান থেকে, তা হলেও কী সম্ভব নয় প্রাণ ও প্রাণহীনের সহাবস্থান।
রোজ তো কত কী ঘটে যাহা তাহা। কত অস্বাভাবিক ঘটনা দেখি, শুনি যা যুক্তির কলমে ব্যাখ্যার ঊর্ধ্বে। পথের কাঁটা সরানোর জন্য কত প্রাণ হনন করা হয় প্রতিদিন। সে সব প্রাণ কি প্রকৃতিরই অঙ্গ নয়? তদন্তকারীরা, সত্যানুসন্ধানীরা কি তাদেরও বয়ান নিতে পারে না, চরম সত্যের কাছাকাছি পৌঁছনোর জন্য? করিনা কপূরের চরিত্র সেই মিসিং লিঙ্ক। চরম সত্য উদ্ঘাটনের। সত্যি বলতে কী, এত সূক্ষ্মভাবে, অনায়াসে প্রাণপূর্ণ আর প্রাণহীন জীবনের মাঝখানের লাইনটা উধাও করে দিয়েছেন পরিচালক, বিশ্বাসই হয় না। ঠিক যেন ঘুড়ির মতো উড়ে গেল পরাজগতে। সংলাপ বা ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোরের কারিকুরিতে জানান দিতেই হল না!
তালাশ-এ পাওয়ার আছে অনেক কিছু। টানটান উত্তেজনা, অপূর্ব ক্যামেরার ইমেজারি, আন্ডারওয়াটার দৃশ্যে অসাধারণ আলো। ছবির শুরু নরিম্যান পয়েন্টে একটি অস্বাভাবিক অ্যাক্সিডেন্ট দিয়ে। প্রচলিত ধারার ক্রাইম থ্রিলারের ধাঁচই অনুসরণ করেছেন পরিচালক। তারপর ধীরে ধীরে পরাবাস্তব স্তরে। ম্যাজিক রিয়্যালিজমের জগতে।আমির-করিনা-রানিকে যদি তালাশ-এর কেন্দ্রে রাখা হয় তবে পাশাপাশি চরিত্রগুলো নিয়ে অনবদ্য একটি ফ্রেম তৈরি হবে। পার্সি মহিলার চরিত্রে শেরনাজ পটেল, ল্যাংড়ার চরিত্রে নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকি, শশীর চরিত্রে সুব্রত দত্ত তাদের মধ্যে অন্যতম। গল্পের রস আরও গাঢ করেছেন তাঁরা। পলক না ফেলতে পারা অভিনয় এঁদের। পার্শ্বচরিত্র হলেও ভোলা অসম্ভব।
প্রশংসা প্রচুর হল, দুটি-একটি যে সমস্যা নেই তা নয়। কিছু দৃশ্য অসম্পূর্ণ। অনাবশ্যক। আরমানের বন্ধুর সঙ্গে তার বাবার সংলাপ কেন দরকার বোঝা যায় না। তেমনি যুক্তি নেই কেন আরমানের স্ত্রীয়ের আরও বেশি আরও সক্রিয় অংশগ্রহণ থাকল না এই ইনভেস্টিগেশনে। তবে দর্শক, এমন ছবির পেয়ালায় ধীরে ধীরে চুমুক দেবেন। ইংরেজি পরিভাষায়, slow sip। তালাশ আসলে আপনাদের সঙ্গে পরিপূর্ণ ইন্দ্রিয়যোগাযোগের রাস্তা খুলে দেয়। এটাই তালাশের অ্যাপিল। তালাশের সারার্থ।