মুভি রিভিউ: 'রেনবো জেলি'র সাতরং কতটা রূপকথার ছবি আঁকল?
রণিতা গোস্বামী
রণিতা গোস্বামী
এর আগে 'পেন্ডুলাম' 'লোডশেডিং' এর মত সিনেমা বানিয়ে বেশ প্রশংসাই কুড়িয়েছেন।এবার তাই 'রেনবো জেলি' নিয়ে দর্শকদের আগ্রহ কিছু কম ছিল না। সিনেমাহলে গিয়ে অনেকের মুখেই শোনা গেল তাঁরা নাকি আগে থেকেই সিনেমা দেখার জন্য টিকিট কেটে রেখেছিলেন। ছোট থেকে বড় অনেকেই সিনেমা দেখার জন্য হলে ভিড় করেছেন।গত শুক্রবার মুক্তি পেয়েছে সৌকর্য ঘোষালের 'রেনবো জেলি'। আর তার পর থেকে বেশিরভাগ দর্শকদের মুখে প্রশংসাই শুনেছি। মাঝে অফিস থেকে ছুটি পেয়ে আমিও তাই 'রেনবো জেলি' দেখার সুযোগ হাতছাড়া করতে চাইলাম না। আসলে ৮-৮০, সকলেই কমবেশি রূপকথা ভালোবাসি।
কি ঠিক বললাম কিনা?
গল্প ও বিশ্লেষণ: রেনবো জেলিতে তথাকথিত রূপকথার রাজা-রানি, ভূত-প্রেত-রাক্ষস, আবার ব্যঙ্গমা-ব্যাঙ্গমি, রাজপুত্র-রাজকন্যা, কিংবা পরীদের রানি কেউই নেই। আবার একটু খেয়াল করে সিনেমাটা দেখলেই দেখতে পাবেন 'রেনবো জেলি'তে রূপকথার সব রসদই আছে। তবে একটু অন্য মোড়কে মোড়া। বর্তমান যুগের প্রেক্ষিতে দাঁড়িয়ে বলা যেতে পারে আজকালকার শিশুরা যেভাবে রূপকথাকে ভাবে, ঠিক সেভাবেই রয়েছে। এখানে তথাকথিত রাজপুত্রের বদলে রয়েছে ঘোঁতন নামে একটা পুচকে রাজকুমার।তার বড় হয়ে রাজত্ব, রাজকন্যা পাওয়ার স্বপ্ন। রয়েছে তাঁর স্বপ্নে দেখা রাজকন্যা পপিন্স। দৈত্য রাক্ষসের মতই রয়েছে ঘোঁতনের একটা স্বার্থপর, মিত্যেবাদী অত্যাচারী গন্ডারিয়া মামা। ঘোঁতনকে গন্ডারিয়া মামার হাত থেকে বাঁচাতে রয়েছে তার পরী পিসিও। এছাড়াও রয়েছে পাড়ার চায়ের দোকানের কাকু, কাবুলিওলা ও পাড়ার কিছু ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা। আর এসব দিয়েই আধুনিকতার মোড়কে রূপকথার জাল বুনেছেন পরিচালক সৌকর্য ঘোষাল।
ছবির শুরু থেকেই দেখা যায় মা-বাপ মরা অনাথ বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন ছোট্ট ছেলে ঘোঁতনের (মহাব্রত বসু) উপর তার গন্ডারিয়া মামার অত্যাচার। মৃত্যুর সময় ঘোঁতনের মা-বাবা ছেলের দেখভালের দায়িত্ব তার মামার উপর দিয়ে গেলেও, স্নেহ তো দূর ঘোঁতনকে বাড়ির কাজের লোক ছাড়া আর কিছুই মনে করেন না তার গন্ডারিয়া (কৌশিক সেন) মামা। একটু ভুলচুক হলেই ঘোঁতনের কপালে জোটে গন্ডারিয়া মামার মার। এভাবেই দিন কাটে তার। মামা তাকে বলেছে তার বাবা-মা তার জন্য নাকি যক্ষের ধন রেখে গেছেন। আর সেটা নাকি সে ১৮ বছর বয়স হলেই পাবে। আর তাই মামার অত্যাচার থেকে ভুলে থাকতে ১৮র স্বপ্নেই মজে থাকে ঘোঁতন। আর বাড়ির জানালা দিয়ে রোজ পাশের বাড়ির পপিন্সকে দেখে। সেই তার কাছে স্বপ্নে দেখা রাজকন্যা। পপিন্সেরও ঘোঁতনদাকে যে মন্দ লাগে না, তা ছবিটি দেখলেই বেশ বোঝা যায়। অন্যদিকে ঘোঁতনের গন্ডারিয়া মামা পাসওয়ার্ড খুঁজে বেড়ায় তার ঘরে রাখা রোবর্টের মধ্যে। সেখানেই নাকি ঘোঁতনের বাবা মা-র রেখে যাওয়া যক্ষের ধন আছে। এসবের মাঝেই ঘোঁতনের বাড়িতে আচমকাই এসে হাজির হন পরীপিসি। যিনি ঘোঁতনকে ৭ স্বাদের রান্নার জাদু শেখান। যে স্বাদই নাকি তার গন্ডারিয়া মামাকে বশ মানাবে। যে খাবারগুলির মধ্যে ৭ স্বাদের সংমিশ্রণে তৈরি 'রেনবো জেলি'ই কামাল করবে। গল্পের মোড় ঘুরবে। এরইমধ্যে ঘটে যাবে অনেকরকম কাণ্ড। তবে সেই কাণ্ডকারখানা গুলো দেখতে হলে প্রেক্ষাগৃহে যেতেই হচ্ছে। সব খোলসা করে দিলে তো 'রেনবো জেলি'র সাতরঙা স্বাদের মজাটাই আস্বাদন করতে পারবেন না।
ছবিটি দেখলে বেশ বোঝা যায় সেখানে ঘোঁতনের মত এক 'স্পেশাল চাইল্ড'কে সমাজ কীভাবে দেখে। সমাজের নগ্নতা, নিষ্ঠুরতাকে তুলে ধরতে চেয়েছেন পরিচালক সৌকর্য ঘোষাল। একজন 'স্পেশাল চাইল্ড'কে যেভাবে স্বস্নেহে বড় করতে হয়ে, এযুগে দাঁড়িয়েও সমাজ কি আদপে সেটা করে? সে প্রশ্নই তুলেছেন পরিচালক।সবমিলিয়ে এই ছবি যে শুধুই একজন স্পেশাল চাইল্ডের গল্প তেমনটাও নয়, এখানে মিষ্টি একটা ভালোবাসার গল্প আছে, যুদ্ধ জয়ের কথা আছে, স্বপ্ন দেখার কথাও বলা আছে। ছবিতে ছোটদের উপরি পাওনা বাচ্চদের পছন্দের কার্টুন। সবমিলিয়ে এখানে বাস্তব ও রূপকথাকে সুন্দর ভাবে মিশিয়ে দিয়েছেন পরিচালক।
অভিনয়- এই ছবিতে প্রতিটি চরিত্রে প্রত্যেকের অভিনয়ই চোখে পড়ার মত। বিশেষ করে ঘোঁতনের চরিত্রে মহাব্রত বসুকে ফুলমার্কস দেওয়াই যায়। ঘোঁতনের মামার চরিত্রে কৌশিক সেন, পরী পিসির চরিত্রে শ্রীলেখা মিত্র, বাড়ির পশে চায়ের দোকানের কাকুর চরিত্রে শান্তিলাল মুখোপাধ্যায়, পপিন্সের চরিত্রে অনুমেঘা বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রত্যেকেই এখানে এককথায় অসাধারণ, পারফেক্ট। এছাড়াও ছবির অন্যান্য চরিত্রগুলিতে বাকি অভিনেতা, অভিনেত্রীদের অভিনয়ও বেশ ভালো।
চিত্রনাট্য ও পরিচালনা- ছবির গল্প, চিত্রনাট্যে, ডায়লগ, এবং পরিচালনা সবকটি ক্ষেত্রেই সৌকর্য ঘোষালকে ফুল মার্কস না দিয়ে পারলাম না।
গান-এই ছবিতে সিনেমাপ্রেমীদের মনে দাগ কেটেছে 'রূপকথা' সহ ছবির প্রত্যেকটি গানের সুর কথা। এক্ষেত্রেও কিন্তু হাত রয়েছে সেই সৌকর্য ঘোষালেরই। ছবির গানের কথা গুলি খোদ সৌকর্য ঘোষালেরই লেখা। শুধু গানের কথা নয়, নবারুণ বোসের করা গানের সুরগুলিই মন ছুঁয়ে যায়।
সিনেমাটোগ্রাফি- ছবিতে আরও একটি বিষয় ভীষণই গুরুত্বপূর্ণ জায়গা নেয় সেটি হল সিনেমাটোগ্রাফি। এক্ষেত্রে আলোক মাইতির কাজও মন্দ লাগল না, বেশ ভালো।
সম্পদনা- ছবির সম্পদনার ক্ষেত্রেও অর্ঘ্যকমল মিত্রের তুলনা হয়না। যদিও তাঁর নিখুঁত সম্পাদনার পরিচয় এর আগেও আমরা বহু ছবিতেই পেয়েছি। তা সে ঋতুপর্ণ ঘোষের 'সত্বান্বেষী', 'নৌকাডুবি'ই হোক কিংবা বোমক্যেশ বক্সী সহ আরও বেশকিছু ছবি।
ত্রুটি: যেহেতু গোটা ছবিতে একটি দৃশ্য, যেখানে পপিন্সের বাড়ির কাজের মেয়ের সঙ্গে ঘোঁতনের মামার বন্ধুটির একঝলক ঘনিষ্ট দৃশ্যটি হয়ত ছোটদের ছবির ক্ষেত্রে বাদ দিলেও হয়তবা দেওয়া যেত।
তবে সব মিলিয়ে সৌকর্য ঘোষালের 'রেনবো জেলি' কে ৫ এর মধ্যে সাড়ে ৪ দেওয়াই যায়।
আরও পড়ুন-