হনুমানের মহাকীর্তি

ছবির নাম- হনুমান ডট কম রেটিং- ***1/2

Updated By: Dec 12, 2013, 07:20 PM IST

শর্মিলা মাইতি

ছবির নাম- হনুমান ডট কম

রেটিং- ***1/2

পবনপুত্র হনুমান নামে তিনি সর্বজনপূজিত, মহাকাব্যনন্দিত। এ ছবির নায়কের নাম অঞ্জনীপুত্র। হনুমানের জন্মদাত্রীর নাম যে কটি মানুষ জানেন, তাঁরা এ ছবির নামকরণের সার্থকতা বুঝবেন! ওষুধ আনতে বললে রামভক্ত হনুমান পুরো গন্ধমাদন পর্বতটাই তুলে এনেছিলেন। বসিরহাটের প্রত্যন্ত গ্রামের এক মাস্টারমশাই, যিনি জীবনে প্রথমবার কম্পিউটারের চেহারা দেখেছেন। শিখেছেন গুগল নামক বিশ্বগ্রাসী সবজান্তার অস্তিত্ব। শিখেছেন আঙুলের ডগার স্পর্শে তাঁর জ্ঞানের চেনা পরিধিটা বাড়তে বাড়তে ক্রমে সম্পূর্ণ অচেনা গন্তব্যে পৌঁছে যায়!

গ্লোবালাইজেশনের যুগে গোটা বিশ্বই গ্রাম। ইন্টারনেটের জাল দিয়ে ঘেরা, দূরত্ব সেখানে কোনও পরিমাপই নয়, কিবোর্ডে আঙুল ছুঁইয়ে এক দেশ থেকে পৃথিবীর অন্য প্রান্তের দেশে পৌঁছে যায় মন, মানুষও। এভাবেই মানুষে-মানুষে মনের টান আর সেখান থেকেই স্বর্ণকমলপুর, যে গ্রাম এখনও স্থান পায়নি উইকিপিডিয়া কিংবা গ্লোবে, সেখান থেকে একটি মানুষের অনুসন্ধান-যাত্রা। জীবনসঙ্গিনীকে যে লিখে রেখে যায়, প্রিয় তনু, এ যাত্রা নিরুদ্দেশ যাত্রা নয়। আবার আমি ফিরে আসব। এ এক অসম্ভবের ছন্দে যাত্রা!

আইসল্যান্ডে প্রথম বাংলা ছবির শুটিং। এটাকেই যদি এ ছবির ইউএসপি ধরা হয়, তবে প্রায় কিছুই বলা হবে না। এই প্রথমবার খুব সফলভাবে অভিনেতা প্রসেনজিত্কে পাওয়া গেল। স্বাভাবিক উত্তর-যৌবনে উত্তীর্ণ এক মানুষ। পরিমিত অভিনয়। অঙ্কের মাস্টারমশাইয়ের মন ও মননে ঢুকে পড়া একটি মানুষ। প্রসেনজিত্ নিজের খোলসটাকে একেবাসরেই খুলে ফেললেন। এমনকী, মনের মানুষেও কোনও কোনও সংলাপ বলার মধ্যে যে স্বল্প স্বভাবসুলভ ম্যানারিজম ছিল, এখানে তার লেশমাত্র নেই। স্ত্রীর জন্য যিনি চিনি-না-দেওয়া চা এনে দেন প্রতি ভোরে, পরম যত্নে। কম্পিউটারে বিশ্বসন্ধানের পর ফুল-ফল-প্রকৃতির মধ্যে যিনি খোঁজেন অঙ্কের ফর্মুলা। আবার সেই মানুষটিই সাইবার ফাঁদের মোহিনীর টানে আপন জগত্ও ভুলতে বসেন। রাত জেগে অজানা প্রেমিকার সঙ্গে চ্যাট করেন, যে তার ঠিকানা দিয়েছে আইসল্যান্ডের। একদিন মধ্যরাতে চ্যাট চলতে চলতেই হঠাত্ সেই ওয়েবক্যামেই দেখে ফেলেন এক মর্মান্তিক হত্যাদৃশ্য।

পরিচালক গৌরব পান্ডে এই ছবিটিতে মনপ্রাণ এবং জ্ঞান ঢেলেছেন। উজাড় করেছেন নিজের অভিনয় ক্ষমতাও। এ ছবিতে একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয় করেছেন তাঁর মেয়েও। খুবই স্বতস্ফূর্ত অভিনয় এই ছোট্ট মেয়েটির। অঞ্জনী স্যারের এই যাত্রার রেখামানচিত্র ধরে সাজিয়েছেন ছবিকে। আইসল্যান্ড- যার নামটুকুই শুধু জানা ছিল ভূগোল বইয়ের পাতা থেকে, সারা বিশ্বের উত্থান-পতন-নবজাগরণ-রক্তক্ষরণ-উল্লাস, কোনওখানেই পৃথিবীর ইতিহাস যাকে স্থান দেয়নি, জমি বেচার টাকায় সাহসে ভর করে পাড়ি দেওয়া সেই মানুষ প্রথমার্ধ থেকেই জাগিয়ে দেয় প্রচণ্ড প্রত্যাশা!

অসাধারণ সিনেমাটোগ্রাফি আর ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর নিয়ে আইসল্যান্ড নিসর্গ এমন অপূর্ব প্রকাশ যে কোনও দিন বাংলা ছবির পর্দায় দেখা যাবে, জানা ছিল না। বিদেশ বিভুঁইয়ে প্রবাসী বাংলাদেশি বন্ধুর আশ্রয়ে এসে অঞ্জনীপুত্রের সামনে অন্য একটা পৃথিবীর জানালা খুলে যায়। এই পর্বের সুন্দর এডিটিং এবং অবশ্যই গৌরব পান্ডের অভিনয়, দর্শককে নিয়ে য়াবে অন্য এক যাত্রাপথে। স্ত্রীর ভূমিকায় মৌসুমী একটু আড়ষ্ট। জার্মান চ্যাটফ্রেন্ড মারিয়ার ভূমিকায় সাসকিয়াও বেশ আকর্ষণীয়া। দুজনের সৌন্দর্যের বৈপরীত্য গল্পে একটা অন্য মাত্রা যোগ করে, সেটা উপলব্ধি করবেন মনে মনে। দ্বিতীয় পর্বের থ্রিলারকে তেমন স্পিডি থ্রিলার বলা চলে না। প্রচলিত ব্যাকরণের থেকে অনেকটা আলাদা। কম্পিউটার বিশ্ব তার সবটুকু নিয়ে হাজির। অঞ্জনীপুত্র হনুমান-এর সাধারণ আর সহজ বিশ্বাসের ওপরে ভর করে ক্রমশ ক্লাইম্যাক্সে পৌঁছে যাওয়া।

গল্পটা ভেঙে বলার নয়। দেখতে গেলে অন্যরকম স্বাদ অবশ্যই পাবেন। ভাল লাগবে শেষার্ধে, অঞ্জনীপুত্রের প্রত্যাবর্তনের দৃশ্য। যে মাস্টারমশায়ের কাছে বাইরের খবর বলতে ছিল খবরকাগজ, এখনও তার হাতে খবরের কাগজ। শুধু আগে যে খবর চোখ টানত, এখন চোখ বাজপেয়ীর হাঁটুর অপারেশনের খবর পেরিয়ে আরও গভীরে চলে যায়। স্ত্রীকে সে জানায়, বৃষ্টি আসার আগাম খবর... কেন এই মনোজগতের বিবর্তন, সেটাই অক্ষরে অক্ষরে লেখা আছে এ ছবির পাতায়।

অনেক ভাল-র মধ্যেও খামতি আছে। আরও সজাগ হওয়ার দরকার ছিল সঙ্গীত পরিচালনার ক্ষেত্রে। সাউন্ড মিক্সিং-ও কোনও কোনও জায়গায় ভালভাবে হয়নি। থ্রিলার পার্টটি আরও জমজমাট হতে পারত। যা হতে পারত, সেটা বাদে যা হয়েছে, সেটাই বা কম কিসের। ডট কম নয়, ডট বেশিই!

.