পোটেনশিয়ালের সদ্ব্যবহার অথবা মধ্যমেধার সাধনা
ডাঃ সিংহ সরকারি হাসপাতালে সরকারি বেতনে সাধারণ মানুষের চিকিত্সা করতেন। প্রাইভেট প্র্যাকটিস করলে যে কোনও দিন তুড়ি মেরে তিনি দশ গুণ রোজগার করতে পারেন। এটাকেই বেসরকারি হাসপাতালের মালিকরা ডাক্তারদের সম্ভাবনা বা 'পোটেনশিয়াল' বলে থাকেন। যে ডাক্তার অকারণে নিছক বিল বাড়ানোর জন্য প্যাথলজি টেস্ট করান না, তাঁকে ডেকে ওই সব হাসপাতালের ম্যানেজাররা বলেন, "ডাক্তারবাবু আপনার কিন্তু পোটেনশিয়াল আছে, আপনি একটু চেষ্টা করলেই আপনার পোটেনশিয়াল রিয়ালাইজ করতে পারেন।" পোটেনশিয়াল মাপা হয় লক্ষ টাকার এককে। রাজ্য সরকার সম্ভবত চাইছে ডাঃ সিংহ তাঁর পোটেনশিয়াল অনুযায়ী রোজগার করুন!!!
যে কোনও উত্কর্ষ কেন্দ্রকে সমূলে ধ্বংস করার দীর্ঘ ঐতিহ্য রয়েছে বাঙালির। বামফ্রন্ট আমল থেকে চলে আসা এই ধারা সযত্নে রক্ষা করছে তৃণমূল কংগ্রেসের সরকার।
কলকাতার এস এস কে এম হাসপাতাল সংযুক্ত ইন্সটিটিউট অব পোস্ট গ্র্যাজুয়েট মেডিক্যাল এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ দেশের একটি অগ্রণী চিকিত্সা গবেষণা প্রতিষ্ঠান। সেখানে গত কয়েক বছর ধরে সদ্যোজাতদের চিকিত্সার জন্য যে নিওন্যাটোলজি বিভাগটি রয়েছে তার দায়িত্বে ছিলেন ডাঃ অরুণ সিংহ। তাঁর নেতৃত্বে ওই বিভাগটির কাজকর্ম সারা দেশের কাছে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে উঠেছিল। আমরা আধা-বোঝা রাজনীতিকদের ধান্দা তাড়িত পিঠ চাপড়ানির কথা বলছি না। আইপিজিএমআর-এর নিওন্যাটোলজি বিভাগের সাফল্য সারা দেশে বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে স্বীকৃতি পেয়েছে। একই ধাঁচে তৈরি পুরুলিয়া জেলা হাসপাতালের সাফল্যও দেশবন্দিত। সদ্যোজাতদের চিকিত্সায় এই 'পুরুলিয়া মডেল' এখন অনুসরণ করা হয় সারা দেশে। প্রতি হাজারে শিশু মৃত্যুর হার ৩৫ থেকে কমিয়ে ১৫-তে নিয়ে আসতে পেরেছেন ডাঃ অরুণ সিংহ। এই অসামান্য কৃতির জন্য পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কর্মচারী হলেও এই বিষয়ে অন্য চারটি রাজ্য সরকার তাঁকে উপদেষ্টা হিসাবে ব্যবহার করে। কেন্দ্রীয় এবং আন্তর্জাতিক স্তরের বিভিন্ন চিকিত্সা গবেষণা প্রতিষ্ঠানেরও তিনি পরামর্শদাতা।
অন্য কোনও জাতি হলে ডাঃ সিংহের জন্য তাঁরা গর্বিত বোধ করতেন, অন্য কোনও সরকার হলে তাঁর কাজের আরও সুবিধা করে দিত। পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাঁকে বদলি করে দিয়েছে। বদলি করেছে এমন জায়গায় যেখানে নিওন্যাটোলজি বিভাগই নেই। তাঁর অপরাধ, তিনি মুখ্যমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ এবং রাজ্য সরকারের স্বাস্থ্য বিষয়ক টাস্ক ফোর্সের প্রধান আর এক চিকিত্সকের সঙ্গে বাদ বিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়েছিলেন।
আমাদের মতে উচ্চ শিক্ষা এবং গবেষণায় সাম্যের কোনও জায়গা নেই। কিছু উত্কর্ষ কেন্দ্র বিশেষ বিশেষ ব্যক্তিকে কেন্দ্র করেই সর্ব দেশে সর্ব কালে গড়ে ওঠে। ডাঃ অরুণ সিংহের মতোই তাঁরা সম্মান এবং স্বীকৃতি পান অসামান্য কর্মের জন্য, অসামান্য মেধা এবং উদ্ভাবনী ক্ষমতার জন্য। মিষ্টি কথা বলা এবং স্তাবকতার জন্য নয়। এক লক্ষ মিষ্টভাষী অপদার্থর থেকে একজন দুর্মুখ ডাঃ সিংহর উপযোগিতা সমাজ ও দেশের কাছে অনেক বেশি। সেই কারণেই তাঁর মতো অনন্য কৃতিত্বের অধিকারীদের অবাধে কাজ করার সুযোগ দেয় সভ্য সমাজ।
বর্বর সমাজ তা দেয় না। আমরা অসভ্য, বর্বর বলে প্রতিভার মূল্য দেই না।
ডাঃ সিংহ সরকারি হাসপাতালে সরকারি বেতনে সাধারণ মানুষের চিকিত্সা করতেন। প্রাইভেট প্র্যাকটিস করলে যে কোনও দিন তুড়ি মেরে তিনি দশ গুণ রোজগার করতে পারেন। এটাকেই বেসরকারি হাসপাতালের মালিকরা ডাক্তারদের সম্ভাবনা বা 'পোটেনশিয়াল' বলে থাকেন। যে ডাক্তার অকারণে নিছক বিল বাড়ানোর জন্য প্যাথলজি টেস্ট করান না, তাঁকে ডেকে ওই সব হাসপাতালের ম্যানেজাররা বলেন, "ডাক্তারবাবু আপনার কিন্তু পোটেনশিয়াল আছে, আপনি একটু চেষ্টা করলেই আপনার পোটেনশিয়াল রিয়ালাইজ করতে পারেন।" পোটেনশিয়াল মাপা হয় লক্ষ টাকার এককে। রাজ্য সরকার সম্ভবত চাইছে ডাঃ সিংহ তাঁর পোটেনশিয়াল অনুযায়ী রোজগার করুন!!!
সুদীপ্ত সেনগুপ্ত
(এডিটোরিয়াল কনসালট্যান্ট)