আলস্য-আশ্রমে ঘোরাফেরা
তা গত ২০/২২ বছর তো হবেই। আমি নিয়মিত লক্ষ্য করে চলেছি উত্পলকুমার বসুকে। উত্পলকুমার বসুর লেখালেখিকে। আমাদের চারপাশে, আমাদের চারিপাশে পড়ার মতো বাংলা সাহিত্য প্রতিদিন কতই না রচিত হয়ে চলেছে।
তা গত ২০/২২ বছর তো হবেই। আমি নিয়মিত লক্ষ্য করে চলেছি উত্পলকুমার বসুকে। উত্পলকুমার বসুর লেখালেখিকে। আমাদের চারপাশে, আমাদের চারিপাশে পড়ার মতো বাংলা সাহিত্য প্রতিদিন কতই না রচিত হয়ে চলেছে। কিন্তু লক্ষ্য করার মতো? ওই যে উত্পলকুমার চারদিক দেখেতে দেখেতে খাটো পায়জামা-ফতুয়ায় হেঁটে আসছেন (যেন জরিপবাবু), ওই যে উত্পলকুমার জেটপাখি দেখছেন (পাখি দেখছেন কি! নাকি ওড়া দেখছেন! রানওয়ে!), ওই যে উত্পলকুমার কফিহাউসে টেবিল জমিয়েছেন। ওই যে উত্পলকুমার টেলিভিশনে ফিচার লিখছেন (লোকমাতা দেবী)। ওই যে উত্পলকুমার হুস্, উড়ে গেলেন গ্রিসে। ওই ওই যে উত্পলকুমার নবদ্বীপে কীর্তন শুনছেন। ...এই রকম কত কত উত্পলকুমারকে যে আমি গত ২০/২২ বছর যাবত্ লক্ষ্য করে আসছি তা আমি নিজেই জানি না।
সবিনয়ে জানাই যেদিন থেকে আমি সামান্য লেখালেখির চেষ্টা করে আসছি, আমি হারিয়ে ফেলেছি আমার পাঠকৌমার্য। আরও লক্ষ্যণীয় এই যে আমি ধীরে ধীরে হয়ে উঠেছি একজন আত্মসর্বস্ব নিরীক্ষক মাত্র। যার নিরীক্ষণ বিলুপ্তপ্রিয় আমিষাশী ও বিচরণশীল। জটিল ও কুয়াশাবৃত ভূমিশয্যাই যার আরাধ্য, সৌরবৃক্ষ মুখে ছুটে চলা বরাহে নিহিত যার অভিপ্রায় এবং যার চোখের সামনে ভাসমান লেখার টেবিল ও দেখার টেবিল।
এই সমস্ত মনোসংযোগঘটিত ক্ষয়-ক্ষতি নিয়েই আমি ঢুকে পড়েছিলাম ভাষামহলে সূর্যস্বয়ম্বরা, জ্বলে এবং জ্বালায়। লক্ষ্য করলাম কাহিনি নয়, এমনকি কোনওরকম কাহিনিসূত্রও নয়, বরং উত্পলকুমার নির্মাণ করতে চাইছেন একের পর এক ফ্যালাসির, উত্পলকুমার ধ্বংস করতে চাইছেন একের পর এক ফ্যালাসির। আধা ঔপনিবেশিক এই ফ্যালাসি। যে ফ্যালাসি থেকে জন্ম এক দ্বন্দ্বের, শূন্যতার দ্বন্দ্বের, কবিতাদুনিয়ার এক সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বের। আর জন্ম পাঠকের। কবিতাপাঠকের। এক দগ্ধ উপনিবেশে পাখির ডাক যেভাবে তৈরি করে মায়াসভ্যতার রহস্য, উত্পলকুমারও প্রায় অর্থহীন জীবনের শ্রম ও সংকট থেকে ওই একই প্রকারে নির্মাণ করে চলেছেন একটিই মায়াকাননের ফুল। আর পুষ্পজন্ম কখনোই কাহিনি নির্ভর নয়। বরং বলা যায় অনেকাংশেই অবৈধ মনসংযোগ সর্বস্ব এবং এই মনসংযোগের প্রান্তরেখা কখনও বা ছুঁয়ে যায় জাগতিক ঘটনাপ্রবাহের জাদুবাস্তবতা, আবার কখনও বা এই বাস্তবতা ছুঁয়ে যায় প্রান্তরেখাটিকে। ওই প্রান্তরেখায় নিহিত যে রিরংসাভঙ্গিমা, যে যে অশান্তি চুক্তিপত্র, যে যে সমান্তরাল (প্রান্তিক) রাজনীতির বাণিজ্যদলিল, কী আশ্চর্য, তার প্রায় সমস্ত স্বরূপই আমি প্রত্যক্ষে পেলাম উত্পলকুমারের কবিতায়, আমি অস্থিরে গেলাম।
মাটির স্বচ্ছতা কাঁপে-উত্পলকুমার একদা দেখেছিলেন, দেখেছিলেন এবং লিখেছিলেন। মধ্যে মধ্যে মনে হয় এই আপাত সহজ পংক্তিটিতে নিহিত রয়েছে উত্পলকুমারের যাবতীয় রাজনৈতিক রণনীতি এবং এই কম্পাঙ্ক যেন তার রচনায় খানিকটা নিয়তি নির্ধারিত। কেন না তাঁর ভাষা ব্যবহারে হেরে যাওয়া, বারবার হেরে যাওয়া লড়াকু, অন্ত্যজ এবং প্রান্তিক মানুষের ছায়া ক্রীড়া করে। তার ভাষা ব্যবহারে ক্রীড়া করে এক মজামার বালকের হাসি; যার ডাক নাম কৌতুক। উত্পলকুমারের লেখায় এই যে আশা ও আশাহতের যুগপত্ আলো অন্ধকার- তা যাবতীয় একাডেমিক ডিসকোর্সের বাইরে নির্মাণ করে চলেছে এক আণবিক উপনিবেশের। উত্পলকুমার যাকে আলস্য-আশ্রম নামে চিহ্নিত করতে বোধহয় নিশ্চিন্তবোধ করবেন। যেখানে গান-বাজনা, ধর্মাচরণ, দশবছর আগের কোনো লেখা নিয়ে আলোচনা ইত্যাদি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। যেখানে গেলে আমাদের আত্মবিশ্বাস বাড়বে, মুখের ব্রণ মিলিয়ে যাবে, এবং বহুদিন আগে হারিয়ে যাওয়া এরিয়ার চেক, উচ্চ-মাধ্যমিকের মার্কশিট এবং উত্পলকুমার বসুর বাড়ির ঠিকানা লেখা কাগজটিও খুঁজে পাওয়া যাবে।
এই আলস্য-আশ্রমে ঘুরে বেড়াতে বড় সাধ জাগে। দেখি, দূরে উত্পলকুমার বসে আছেন। বসে আছেন বটের নিচে। সাহায্য বটের নিচে। উত্পলকুমার হাসছেন। ওমা! বটের গায়ে পেরেকসাঁটা একটা পোস্টার-
অবেলায় ঘুম পায়, জেগে উঠি, তাও অসময়ে।
দেখি বিকেল গড়িয়ে গেছে, সন্ধ্যার ঢালের উপর
দাঁড়িয়ে দু-জন মেয়ে প্রাকৃত ভাষায় কথা কইছে, আমি হাসছি।
রাহুল পুরকায়স্থ