মহাজনের পৌষ মাস, চাষাভুষোর সর্বনাশ
না জানার মধ্যে এক ধরনের আদিম সরলতা আছে। না বোঝার মধ্যে আছে এক ধরনের আদিম আতঙ্ক। অনাদায়ী ঋণ আদায়ের জন্য সমবায় ব্যাঙ্কের দেওয়া সম্পত্তি বিক্রির নোটিসে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় অনেকেই এই সরল আতঙ্ক প্রত্যক্ষ করে থাকবেন। স্পষ্টতই মুখ্যমন্ত্রী মনে করেছিলেন (অন্তত সেই মুহূর্তে) 'দুই বিঘা জমি' কবিতাটির পুরাতন ভৃত্যের জমি কেড়ে নেওয়ার মতো ভয়ঙ্কর কোনও অন্যায় সংঘটিত হতে যাচ্ছে।
ঋণ নিয়ে ফেরত না দেওয়ার অধিকারকে আইনি স্বীকৃতি দিতে চান পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়। জয়ললিতা, মায়াবতী প্রমুখ উল্লেখযোগ্য রকমের অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় এবং জনপ্রিয়তা-কাতর মুখ্যমন্ত্রীও এত দূর যাননি কখনও।
না জানার মধ্যে এক ধরনের আদিম সরলতা আছে। না বোঝার মধ্যে আছে এক ধরনের আদিম আতঙ্ক। অনাদায়ী ঋণ আদায়ের জন্য সমবায় ব্যাঙ্কের দেওয়া সম্পত্তি বিক্রির নোটিসে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় অনেকেই এই সরল আতঙ্ক প্রত্যক্ষ করে থাকবেন। স্পষ্টতই মুখ্যমন্ত্রী মনে করেছিলেন (অন্তত সেই মুহূর্তে) 'দুই বিঘা জমি' কবিতাটির পুরাতন ভৃত্যের জমি কেড়ে নেওয়ার মতো ভয়ঙ্কর কোনও অন্যায় সংঘটিত হতে যাচ্ছে।
আমাদের দেশে কৃষিতে ঋণের প্রধান সমস্যাটা ধার শোধ না করার নয়। প্রধান সমস্যাটা হল মহাজনি ঋণের রমরমা কারবারের। মহাজনি ঋণে সুদের হার বছরে 720 শতাংশ পর্যন্ত। সারা দেশেই কৃষকদের ঋণগ্রস্ততা এখন কৃষির সঙ্কটের অন্যতম কারণ। কৃষক আত্মহত্যার কারণও বটে। কৃষিতে ঋণগ্রস্ততা খতিয়ে দেখার জন্য নিযুক্ত বিশেষজ্ঞরা (রাধাকৃষ্ণ কমিটি, ২০০৭ সাল) বলেন মহাজনি ঋণ থেকে প্রাতিষ্ঠানিক ঋণে কৃষকদের নিয়ে আসতে না পারলে কৃষির মূল সমস্যা মিটবে না। এ সবই সংশ্লিষ্ট সকলের জানা। এমনকি স্বভাব-মূর্খ সাংবাদিকদেরও। তৃণমূল কংগ্রেস নেতৃত্বের কাছে কি জানা ছিল না?
কৃষিই হোক বা শিল্প, আমাদের দেশে অনাদায়ী ঋণের প্রধান সমস্যাটা ছোট অঙ্কের ঋণের নয়, বড় আকারের ঋণের। ঠিক আমাদের দেশে নয়, কিন্তু ঘরের একেবারে পাশেই, বাংলাদেশে কৃষি সহ গ্রামীণ ক্ষুদ্র ঋণ নিয়ে বিস্তর কাজকর্ম হয়েছে। তাতে (তিন দশকের বেশি দীর্ঘ অভিজ্ঞতায়) দেখা যাচ্ছে ছোট ঋণ-গ্রহীতারা নিয়মিত ধার শোধ করেন। বিশেষ করে যদি তাঁরা যৌথভাবে কোনও প্রতিষ্ঠানের কাছে ঋণের জন্য দায়বদ্ধ হন। কারণ, তাঁদের আবারও ঋণ নিতে হবে, তাঁরা জমি এবং নিজের সমাজ ছেড়ে পালাতে পারবেন না এবং ঋণের সদ্ব্যবহার করে তাঁরা জীবনে প্রত্যক্ষ সুফল পাচ্ছেন। এই ঋণ দেওয়ার কাজ করে আমাদেরই মতো বাংলায় কথা বলা এক ভদ্রলোক নোবেল পুরস্কার পর্যন্ত পেয়ে গিয়েছেন। এ সবই সংশ্লিষ্ট সকলের জানা। এমনকি স্বভাব-মূর্খ সাংবাদিকদেরও। তৃণমূল কংগ্রেস নেতৃত্বের কাছে কি জানা ছিল না?
সত্যিকারের ছোট চাষী ও বর্গাদারদের একমাত্র সমবায় ব্যাঙ্কগুলিই ঋণ দেয় এবং সেটা দেয় কোনও বন্ধক ছাড়াই। ঋণের পরিমাণ মাত্র ১০ হাজার টাকা এবং তা বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তার কথাই বিশেষজ্ঞরা এখন বলছেন। সম্পত্তি তাঁরাই বন্ধক রাখতে পারেন, যাঁদের তেমন সম্পত্তি আছে এবং ব্যাঙ্কের কাছে সেই সম্পত্তির কোনও ধার্য বিক্রয়মূল্য আছে। প্রায়শই এঁরা গ্রামের সম্পন্ন কৃষক। আর্থিক সম্পন্নতা মানেই রাজনৈতিক তথা সামাজিক প্রতিপত্তি। মানে গায়ের জোরে বলে দেওয়ার ক্ষমতা, 'দেব না লোন শোধ, কী করতে পারে দেখি?' এঁদের থেকে বকেয়া আদায় করার জন্যই আইন এবং সেই আইনের চরম ব্যবস্থা সম্পত্তি ক্রোক। এ সবই সংশ্লিষ্ট সকলের জানা। এমনকি স্বভাব-মূর্খ সাংবাদিকদেরও। তৃণমূল কংগ্রেস নেতৃত্বের কাছে কি জানা ছিল না?
বস্তুত প্রাতিষ্ঠানিক ঋণ সমাজের আর্থিতভাবে দুর্বল অংশের কাছে বেশি করে পৌঁছে দেওয়াই এখন আমাদের মতো জনহিতকর রাষ্ট্রের কাছে চ্যালেঞ্জ। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী যা চাইছেন তাতে গ্রামীণ ব্যাঙ্ক আর কৃষি ঋণ দেওয়ার ঝুঁকি নিতে চাইবে না। অর্থনীতিতে শূন্যস্থান পূরণের জন্য এগিয়ে আসবে ইতিমধ্যেই আগ্রাসী মহাজনি ঋণ ব্যবস্থা। ছোট চাষী গিয়ে পড়বেন তার হাতে। ব্যাঙ্কগুলি বিপন্ন হলে সঙ্কটে পড়বেন তার ছোট আমানতকারীরা। তাঁদের ব্যাঙ্কের চাহিদা মেটাতে এগিয়ে আসবে ইতিমধ্যেই আগ্রাসী বেসরকারি আর্থিক সংস্থাগুলি। যাদের কোনও সামাজিক দায় নেই এবং সঞ্চয়কারীর টাকা মেরে পালিয়ে যাওয়ার দীর্ঘ ইতিহাস আছে। এ সবই সংশ্লিষ্ট সকলের জানা। এমনকি স্বভাব-মূর্খ সাংবাদিকদেরও। তৃণমূল কংগ্রেস নেতৃত্বের কাছে কি জানা ছিল না?
হয়তো জানা ছিল না। তারই মূল্য স্বরূপ এ রাজ্যে আগামী দিনে দেখা যাবে মহাজনের পৌষ মাস, চাষাভুষোর সর্বনাশ।
সুদীপ্ত সেনগুপ্ত