মোহনবাগানের "অনারকিলিং"
মোহনবাগান তাঁবুর সামনে হাউহাউ করে কাঁদছেন সদস্য সমর্থকরা... কেঁদেই যাচ্ছেন। সেই মোহনবাগান নির্বাসিত হওয়ার দিন থেকেই। কাঁদছেন আরও অনেক মানুষ, গোটা দেশ জুড়েই... কাঁদছেন নির্ভয়া-দামিনীর-আমানত হারানোর পর থেকেই। দুটোই তো অনেকটা একইরকম... সযত্নে পালিত ঐতিহ্যকে ধর্ষণ, সুস্থ চিন্তাকে হত্যা। তবে কান্না কেন? কেন চোখে জল? জল তো আগুন নেভায়!....আর তাই আজ মোহনবাগান নির্বাসিত..
কী ভেবেছিলেন মোহনবাগান কর্তারা? তাঁরা ভগবান? সর্বশক্তিমান? যা খুশি তাই করতে পারেন? যা খুশি তাই?... বদলে দিতে পারেন ফুটবলের আইন? কিনে নিতে পারেন ফেডারেশন কর্তাদের? কেন্দ্রীয়মন্ত্রী, সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি... সবাইকে? ভেবেছিলেন আজও জমিদারী কেতায় ক্লাব চালাবেন? ভুল ভেবেছিলেন.. যে ভুলটা ভাবছেন বিগত বহু বছর ধরে।
...আর তাই আজ মোহনবাগান নির্বাসিত।
মগজে কার্ফু বড় বিষম বস্তু। খোলা হাওয়া ঢুকতে দেয় না। নতুন চিন্তা, বদলে যাওয়া ফুটবল বিশ্বের ছবি, বদলে যাওয়া ফুটবল আইন, বদলে যাওয়া সমর্থকদের চাহিদা... কিচ্ছু না। প্রতিটা বিশ্বকাপে হাজির থাকেন তাঁরা। মাঠে রোনাল্ডো, মেসিরা খেলেন... গ্যালারিতে চিত্কার, তাঁরা ভাবেন সব তাঁদের জন্য। তাঁরা জাতীয় ক্লাবের পদাধিকারী বলে কথা.. নিজেরাই বলেন, খুশি হন, ঢেঁকুর তোলেন, আর কার্ফুয়ের মেয়াদ বাড়িয়ে দেন।
.... আর তাই আজ মোহনবাগান নির্বাসিত।
অদ্ভুত এক অন্ধকার কুয়োয় পড়ে থাকতে ভালবাসেন এই কর্তারা। জানতেও পারেন না ভারতীয় ফুটবলে তাঁদের ক্লাব, বাংলার সব ক্লাব দ্রুত প্রাসঙ্গিকতা হারাচ্ছে। বিশ্ব ফুটবলের বিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ফেডারেশন কর্তারা দল বিচারের মাপকাঠি বদলে ফেলেছেন। রেভিনিউ, ভিউয়ারশিপ, স্পনসররাই সেখানে শেষ কথা, সেখানে মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গলের ঐতিহ্য কলকাতার বনেদি বাড়িগুলোর মতই.. তাল পুকুরে ঘটি ডোবে না। নামের জাদুতে মুগ্ধ হয়ে স্পনসররা আর টাকার ঝুলি উপুর করে না, ভিউয়ারশিপও আসে না। "আমরা মোহনবাগান, আমরা ইস্টবেঙ্গল" বলে কলার উঁচিয়ে ঘুরে বেড়ানোর দিন শেষ।
....আর তাই আজ মোহনবাগান নির্বাসিত।
কেন দল তুলে নিলেন মোহনবাগান কর্তারা? কারণ তাঁদের কাছে আজও এদেশের ফুটবল আইন মানে প্রিয়দাকে ধরে ইচ্ছামত নিয়মকানুনের ঘাড় বাঁকিয়ে দেওয়া, কারণ তাঁদের কাছে আজও সাফল্য মানে ইস্টবেঙ্গলকে হারানো.. তা সে মাঠেই হোক বা মাঠের বাইরে। কারণ তাঁদের কাছে আজও আতঙ্ক মানে "পাঁচ গোল"। সেরা ফুটবলার ওডাফা লাল কার্ড, লড়াকু নবি হাসপাতালে, দল এক গোলে পিছিয়ে.. আবার যদি পঁচাত্তর ফেরে... সেই আতঙ্ক... সেই অতীত.. সেই অন্ধকার.. সেই অন্ধ অহংকার... যে অহংকার অনার কিলিংয়ের রাস্তা দেখায়।
....আর তাই আজ মোহনবাগান নির্বাসিত।
তালেগোলে পার পেয়ে যাচ্ছেন করিম বেঞ্চারিফা, দেশের সবচেয়ে দামি কোচ। সাফল্যের থেকে কথা বেশি... বাগানে আলো জ্বালাতে এসেছিলেন... চিতা জ্বালিয়ে দিলেন। কেন কর্তাদের জানিয়েছিলেন ফুটবলাররা ভেঙে পড়েছে... কাঁদছে... রক্তাক্ত নবির মধ্যে মাঠে মৃত জুনিয়ারের ছবি দেখছে... খেলার শক্তি হারিয়ে ফেলেছে, মানসিকতাও?... মিথ্যা কথা... পিছিয়ে পড়লে ফুটবলাররা কাঁদে না... রাগে ফোঁসে... চোখে জল নয় আগুন জ্বলে। যদি না জ্বলে সেই আগুন জ্বালানোর দায়িত্ব তো আপনার। তার বদলে ক্লাবে আগুন জ্বালিয়ে দিলেন? ছি:!... কী ভেবেছিলেন? আসার পর থেকে শুধুই ব্যর্থতা... তার উপর ইস্টবেঙ্গলের কাছেও হারলে টিকতে পারবেন না, কারণ অতীত অভিজ্ঞতায় এই ম্যাচের মাহাত্ম্য জানেন! সেদিন করেননি, আজ অন্তত ফুটবলারদের জিজ্ঞাসা করুন... জনে জনে বলবেন তাঁরা কতটা লজ্জিত। দশজনে খেলে আরও গোল খেতে পারতেন, দিতেও পারতেন... বিশ্ব ফুটবলে দশজনে খেলে পিছিয়ে পড়া ক্লাবের জেতার উদাহরণ অনেক আছে, তাঁরাও উদাহরণ হতে পারতেন... আর যাই করুন লড়াই ছাড়তেন না, মাঠ ছেড়ে পালাতেন না। এই আত্মবিশ্বাস তাঁদের ছিল, আজও আছে... কিন্তু আপনার নেই... করিম... আর কখনও ওই ফুটবলারদের চোখে চোখ রেখে তাকাতে পারবেন? নিজের চাকরি হারানোর ভয়ে ফুটবলারদের পা থেকে বল কেড়ে নিলেন! এত ভয়?
....আর তাই আজ মোহনবাগান নির্বাসিত..
মোহনবাগান তাঁবুর সামনে হাউহাউ করে কাঁদছেন সদস্য সমর্থকরা... কেঁদেই যাচ্ছেন। সেই মোহনবাগান নির্বাসিত হওয়ার দিন থেকেই। কাঁদছেন আরও অনেক মানুষ, গোটা দেশ জুড়েই... কাঁদছেন নির্ভয়া-দামিনীর-আমানত হারানোর পর থেকেই। দুটোই তো অনেকটা একইরকম... সযত্নে পালিত ঐতিহ্যকে ধর্ষণ, সুস্থ চিন্তাকে হত্যা। তবে কান্না কেন? কেন চোখে জল? জল তো আগুন নেভায়!
....আর তাই আজ মোহনবাগান নির্বাসিত..