লক কিয়া যায়ে!
এই 'অরিজিন্যাল' সৃজিত সাহসী কিন্তু নির্ভুল নন। তবে সৌমিক-অনুপম-বোধিসত্ত্ব এবং অভিনেতারা মিলিয়ে যে সঞ্জীবনী সঙ্ঘ, সেই টিম মেম্বাররাই বাঁচিয়ে তুলেছে হেমলক সোসাইটিকে। কাজেই বেনেফিট অফ ডাউটে সৃজিতের সাত খুন মাফ। হেমলক সোসাইটির ট্রেনিং আসলে জীবনের দিকে ইউ-টার্ন। ফিল্মসিটির অন্দরে ফুল গট আপ কেস। অভিনব উপায়ে বুঝিয়ে হাড়ে হাড়ে টের পাওয়ানো আত্মহত্যা কেন 'মহাপাপ'। পৃথিবীটাকে আরও গাঢ় সোনালি রঙের চশমায় নতুন করে দেখতে শেখানো.. মৃত্যু নয়, জীবন।
(রিভিউ- হেমলক সোসাইটি)
আপনি কি কোনওদিনও একুশ তলা বিল্ডিং-এর ছাদের পাঁচিলে বসে একুশবার ভেবেছেন- টু ডু অর নট টু ডু? সিলিং ফ্যানের দিকে তাকাতে তাকাতে মনে হয়েছে জীবনবাবুকে সি-অফ করে দিই..? কিংবা, মেট্রোর প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে শেষবার ভেবেও শেষ মুহূর্তে যাত্রীসাধারণের খিস্তির ভয়ে পিছিয়ে গিয়েছেন? পরাণ আর মরণের হা-ডু-ডু খেলার এই নিশীথবেলায় শেষেরটিরই যাতে জয় হয়, তারই তিন দিনের ক্র্যাশ কোর্স করায় হেমলক সোসাইটি। ট্রাই নিয়েও মরতে গিয়ে যারা রাম-ছড়ান ছড়ায়, এবং তাঁরা যাতে ব্লেড, দড়ি, বন্দুক, দেশলাই, স্লিপিং পিল ইত্যাদি প্রভৃতি মাল্টিপল চয়েসের মধ্যে একটিকে বেছে নিয়ে এক চান্সে মরতে পারে, তারই এক্সপার্ট ট্রেনিং দেওয়া হয় এখানে। মৃত্যু যাতে ম-ম করে মধুগন্ধ নিয়ে আসে, মরণেচ্ছুরা যাতে বেহালা বাজাতে বাজাতে পটল তুলতে পারেন তারই সুব্যবস্থা। কী থ্রিলিং বলুন তো? পাবলিকের মার না খেয়েও ক্যাওড়াতলার পার! ইচ্ছে হলেই শিঙ্গা ফুঁ---? উঁহু, তত ইজি না। ক্লাসে ডক্টর ধমনী ঘোষ ঘিনঘিনে কাটা হাতের স্যাম্পেলে কারেক্ট ধমনীটা কাটতে শেখান যখন, দেখে আপনার উলটি আসবে। কিম্বা বন্দুক চার ইঞ্চি দূরে রেখে মাথায় গুলি করা প্র্যাকটিস করতে গিয়ে ফেল্টুস না হওয়ার টেকনিক শিখতে গেলে আপনার মাথা বোঁ করে ঘুরবে। গলায় দড়ি দিয়ে মরার ইড়ি-মিড়ি-কিড়ি বাঁধন শিখতে ভুল করলে রাগী দিদিমণির ধমক খেয়ে মনে হবে, ছেড়ে দে মা, 'বেঁচে' বাঁচি!
হেমলক সোসাইটিতে 'না-ছড়িয়ে' মরার বিভিন্ন টেকনিক শেখাতে হাজির একঝাঁক মারকাটারি ক্যামিও শিল্পী। এঁরাই শেখান, আত্মহত্যা কী ও কয় প্রকার। সব্যসাচী, সাবিত্রী, সৃজিত, রাজ, বরুণ, ব্রাত্য, সোহাগ, সুদেষ্ণা। (শেযের দুজনকে ডিরেক্টর মোটেই সুযোগ দিলেন না কেন কে জানে! যদি প্রয়োজনই না থাকে তবে এমন চরিত্র ইনট্রোডিউস করা কেন?) যাই হোক, ছবিতে অনবদ্য হরর-কমিক এলিমেন্ট এই পণ্ডিতমশাইরাই। আবার মৃত্যুর রং কী ও কয় প্রকার বোঝাতেই বোধহয় এক-একটা ক্লাসের দেওয়াল-মেঝে কখনও ব্লাড-রেড, কখনও কোবাল্ট ব্লু, কখনও নিঃসীম সাদা। নেপথ্য সুর হ্যামলিনের বাঁশির মতো গায়ে-কাঁটা-দেওয়া। দর্শকের সিটে বসেই মনে হয় যেন অদৃশ্য টানে তলিয়ে যাচ্ছি কালো গহ্বরে। মরণ যেন ত্রিমাত্রিক। কখনও তার তীব্র প্রাণহীন গন্ধও নাকে আসছিল যেন!..
ক্যালিফোর্নিয়ার সান ডিয়েগোতে এমনই এক সোসাইটি সত্যিই ছিল বটে, কিন্তু পরবর্তীকালে অন্তর্বর্তীকালীন অজানা কারণে সোসাইটি অন্য এক সংস্থার সঙ্গে মিশ খেয়ে খেই হারিয়ে অন্য পথে হাঁটতে শুরু করে। সে যাই হোক, যাদের সেসব খোঁজ দরকার, দয়া করে গুগল করে নেবেন। আপাতত, কলকাতার বুকে, আই মিন, কলকাতার উপকণ্ঠে এক ফিল্মসিটির ভিতরে এই হেমলক সোসাইটির মালিক আনন্দ কর। পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়। তিনি ফ্লার্টিং-এ শাহরুখ খান, প্রেমে উত্তমকুমার, বিরহে গুরু দত্ত, হসপিটালের বেডে রাজেশ খন্না। বাট টাইম্স আর এ-চেঞ্জিং...তাই আনন্দের পকেটে হেব্বি মাল্লু (গাড়িখান একবার দেখে নেবেন, দাম কোটি টাকার কম হবে না!)। প্রয়াত বিলিয়োনেয়ার বাবার একমাত্র পো। আস্ত এ-ক-খা-ন ফিল্ম সিটির মালিক। যাদবপুরের ইঞ্জিনিয়ার। এলিজিবল ব্যাচেলর (গার্লফ্রেন্ড নেই, তবু মাঝরাত্তিরে কন্ডোম কিনতে যান কেন, দেবা ন জানন্তি!!) অত থেকেও কী? না, লিম্ফোসাইটোপিনিয়া। মাসে মাসে ব্লাড ট্রান্সফিউশন। এক্কেবারে জেন-Y গ্রুপের A1 ট্রাজিক হিরো!
প্রতিভা, চুলকুনি আর শ্যাম্পেনের বোতল। কোনওদিন চাপা থাকে না। জয়োত্সবে প্রথম আর শেষেরটি হিস-স-স-স্স্স করে বেরোবেই! কোয়েল মল্লিক নামের এই প্রতিভার দ্বীপটা যে ইন্ডাস্ট্রিতে এতদিন যে ছিল, সেটাই জানা ছিল না। এ ছবির আমেরিকা-আবিষ্কার 'মেঘনা'। কলম্বাস সৃজিতকে এ জন্যে করতালি। সারা ছবি জুড়ে কোয়েলের এমন এফর্টলেস অভিব্যক্তি, এমন নো-নার্সিস্টিক পারফরম্যান্স...অবিশ্বাস্য!
ওয়ান-ফিল্ম-ওয়ান্ডার-কাম-থ্রি-ফিল্ম-ওল্ড পরিচালক এমন সাবজেক্ট নিয়ে সম্পূর্ণ মৌলিক ছবি প্রথমবার বানিয়েছেন। বেস্ট অফ অল থ্রি। অটোগ্রাফ-এর মতো কথা বলতে বলতে একই সিনে কলাকুশলীদের কস্টিউম বদলে যায়নি। বাইশে শ্রাবণ-এর মতো তেড়ে গালাগালি কিম্বা অন্য স্ক্রিপ্টের ধারা-অনুসরণ নেই। তবে, নতুন থিয়োরি প্রথমবার পড়াতে গেলে যেমন বেশি-বেশি বুঝিয়ে ফেলেন মাস্টারমশাই, তেমনই অতিকথনের ভারে ন্যুব্জ চিত্রনাট্য। কোয়েল-পরম সিনগুলোয় অতিনাটকীয়তার বাড়াবাড়ি। স্ক্রিনটাইমে অসঙ্গতি। অপ্রয়োজনে স্ল্যাং। 'পান' ব্যবহার করতে গিয়ে অনাবশ্যক বাড়িয়ে তোলা সংলাপ। দীপঙ্কর-রূপা গাঙ্গুলি (পর্দায় কোয়েলের বাবা-সত্ মা) চরিত্র কেমন যেন হাফ সার্কল। আবার সাহেবের চরিত্রটা লজিক্যালি ফুল সার্কল হয়ে যাওয়ার পরেও, শেষ পর্বে কবর খুঁড়ে বের করে এনে নায়ক পরমব্রতর চরিত্রকে অতিরিক্ত হিরোইক করবার চেষ্টা...ঠিক সৃজিত-সৃজিত নয়। অনুপমের গান যদিও বাজারে হিট, তবু পুরনো ডায়রি ছেড়ে নতুন রাইটিং প্যাডের প্রয়োজন এসেছে বলেই মনে হয়... যাক গে, তাতে কী? ছবি তো চোখ আর হৃদয় দিয়ে দেখে, ছুরি-কাঁচি-ব্লেড দিয়ে নয়। সৌমিক হালদারের অসামান্য, অনবদ্য ক্যামেরার কারিকুরি সত্যিই রাহুল দ্রাবিড়ের কাজটি করেছে। সেরার সেরা সম্মান তাঁরই প্রাপ্য। ক্লাইম্যাক্স দৃশ্যে সেই অসামান্য এক্সট্রিম ক্লোজ আপ চোখের পাতায় লেগে থাকবে যত দূরেই যাই। নায়ক-নায়িকার মিলনসম্ভবা দুটি ওষ্ঠ, ওম্ পাওয়ার প্রস্তুতি নিয়েও বিচ্ছিন্ন হয়। আলিঙ্গন। ক্যামেরা ধরে নেয় দুটি ঠোঁট। নায়কের ঠোঁট জানায় তার মারণ-রোগের কথা। নায়িকার ঠোঁটে গড়িয়ে আসে অশ্রু। এমন বুক-ভেজানো লিরিক্যাল ক্যামেরাওয়ার্ক বাংলা ছবিতে মনে পড়ে না!
এই 'অরিজিন্যাল' সৃজিত সাহসী কিন্তু নির্ভুল নন। তবে সৌমিক-অনুপম-বোধিসত্ত্ব এবং অভিনেতারা মিলিয়ে যে সঞ্জীবনী সঙ্ঘ, সেই টিম মেম্বাররাই বাঁচিয়ে তুলেছে হেমলক সোসাইটিকে। কাজেই বেনেফিট অফ ডাউটে সৃজিতের সাত খুন মাফ। হেমলক সোসাইটির ট্রেনিং আসলে জীবনের দিকে ইউ-টার্ন। ফিল্মসিটির অন্দরে ফুল গট আপ কেস। অভিনব উপায়ে বুঝিয়ে হাড়ে হাড়ে টের পাওয়ানো আত্মহত্যা কেন 'মহাপাপ'। পৃথিবীটাকে আরও গাঢ় সোনালি রঙের চশমায় নতুন করে দেখতে শেখানো..
মৃত্যু নয়, জীবন।
কম্পিউটারজি, ইয়ে আনসার 'লক' কিয়া যায়ে!
ফুলকলি