অভ্যাসের জীবন
বৃহত্ জীবনের কাজের কথাও বলছি না, রোজকার জীবনের ছোট খাটো অভ্যাসেও আমরা দায়সারা, শৃঙ্খলাহীন।
আমাদের অভ্যাসের জীবন। বলা ভাল বদভ্যাসের জীবন। দায়সারা আর সর্টকাটের জীবন। কাজে অনীহা তো প্রায় ধ্রুব সত্যে পরিণত হয়েছে। আর কেনই বা হবে না, অনায়াসে
কার্যসিদ্ধি হলে কেই বা আর পরিশ্রম করতে যায়! বৃহত্ জীবনের কাজের কথাও বলছি না, রোজকার জীবনের ছোট খাটো অভ্যাসেও আমরা দায়সারা, শৃঙ্খলাহীন। অনেক দিন আগে একটি দৈনিকের কড়চার লেখা আমার বারবার মনে পড়ে। নাতিকে নিয়ে শিয়ালদা স্টেশন থেকে ট্রেনে উঠেছিলেন এক ভদ্রলোক। বিধাননগর স্টেশন আসতেই নাতিটির সরল প্রশ্ন, দাদু এই স্টেশনটাকে উল্টোডাঙা স্টেশনও বলছে কেন? ঈষত্ থমকে ট্রেনের দুদিক দেখিয়ে দাদু বললেন, ওই যারা উল্টোদিক দিয়ে রেললাইন টপকে বাইরে যাচ্ছে, তাদের জন্য এটা উল্টোডাঙা, আর যারা বিধি মেনে প্ল্যাটফর্মে নেমে বাইরে যাচ্ছে তাদের কাছে এটা বিধাননগর। দাদুর এই উত্তরে শিশু মনে কী বিস্ময় জেগেছিল তা আর জানা যায়নি, কিন্তু আমার তো মনে হয়, গোটা শহরটাই আমাদের কাছে যেন উল্টোডাঙা। বিধি মানা আমাদের একেবারে না-পসন্দ। তা না হলে পথে বেরোলেই আমরা সবাই কেন ট্রাফিক পুলিস হয়ে যাই! যেখানে সেখানে হাত তুলে দাঁড় করিয়ে দিই বাস-মিনিবাস। একেবারে মাঝ রাস্তাতেই । লটবহর নিয়ে ওঠার আগেই পিছনে ছোট-বড় গাড়ির মিছিল। হর্নের তীব্র আওয়াজে তখন
চারপাশ মুখরিত। দিনের পর দিন এই অভ্যাসেই চলছে জীবন। মাস খানেক আগেই বেশ কয়েকটি থানাকে কলকাতা পুলিসের আওতায় আনা হয়েছে। তার মধ্যে যাদবপুরও আছে। তো, দিনকয়েক আগে অফিসে আসার সময় দেখি একেবারে শুনশান যাদবপুর। একটু খেয়াল করতেই দেখতে পেলাম রাস্তার দুদিক দড়ি দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে, আর পথচারীদের প্রতি ট্রাফিক পুলিসের কাতর অনুনয়, স্যার ওদিকে নয়, নীচ দিয়ে যান। অর্থাত্ রাস্তা পারাপার নয়, সাবওয়ে দিয়ে যেতে বলছেন পুলিসকর্মীটি। তাতে পথচারীদের তীব্র অনীহা।
এতদিনের অভ্যাস বাস-ট্যাক্সি থামিয়ে টুক করে রাস্তা পেরনোর, এখন যদি সিঁড়ি ভেঙে ও প্রান্তে পৌঁছতে হয় তাহলে তো বিরক্তি আসবেই! এই হচ্ছি আমরা। বছর পনেরো আগে এই সাবওয়েটি তৈরি হয়েছিল। সেই তৈরির সময় যাদবপুর বিশ্ববিদ্যায়ের চার নম্বর গেট পর্যন্ত জ্যাম হত। সেইসময়ও বিরক্ত হতাম আমরা, আবার আমাদের জন্য বানানো সেই সাবওয়ে দিয়ে যেতে গিয়েও বিরক্ত হচ্ছি। যাদবপুরের এই সাবওয়েটির দীর্ঘকাল ভুতুড়ে বাড়ির মতো অবস্থা। ভিখিরি আর ভবঘুরেদের আস্তানা হয়ে আছে। পান-গুটখার মশলায় রঞ্জিত গোটা দেওয়াল। সেখানেই লেখা আছে. এই সাবওয়ে আপনার, এর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব আপনার। সাবওয়ের চেহারা দেখে আর ওই লেখা পড়ে লজ্জা পেতে হয়। শুধু কি যাদবপুরের এই সাবওয়ে, কলকাতার কোনও ওভারব্রিজ বা সাবওয়ে দিয়েই বা আমরা যাতাযাত করি! করি না, কারণ গাড়ি থামিয়ে যেতে ঝুঁকি থাকতে পারে, ট্রাফিক বিপর্যস্ত করে ছুটতে হতে পারে, কিন্তু সিঁড়ি ভাঙার কষ্ট নিতে পারব না! সচেতনভাবে একটু চেষ্টা করলে আমরা কি পারি না এই অভ্যাস কিছুটা বদলে ফেলতে? পারি তো বটেই, কিন্তু যদি ভাবি এটা দায়, তাহলে সেকাজ দায়সারা হবেই। কিন্তু যদি ভাবি দায়িত্ব, তাহলে তাহলেই বোধহয় সম্ভব । আমাদেরই তো এই শহর! যে শহরে থাকি তাকে সুন্দর দেখতে চাইব না আমি? আমরা?
সোমশুভ্র মুখোপাধ্যায়