একটা জগাখিচুড়ি গল্প
জিনিসটা কী? এক কোণে কাঠের বেঞ্চিতে বসার একটু পর সেই 'মাল' এল। আগুনের মতো গরম গোমাংসের খিচুড়ি। পাশে অল্প আচার। মোটা গোঁফ বলল `গোটা কলকাতায় আপাতত আমার ফেভারিট খাবার এটা। যত পারিস খা। কোনো শরীর খারাপের বালাই নেই। আমি তো এক-একদিন তিন চার প্লেট করে খাই।'
সেদিন সকাল থেকে বেশ বৃষ্টি হচ্ছিল। শীত আসতে শুরু করেছে কলকাতায়। অফিস যাবার আগে অভ্যেস মতো খবরের কাগজটায় চোখ বুলিয়ে নিচ্ছি, তখনই ফোনটা এল।
`শোন, কাল একটা জায়গায় আসতে পারবি, শাক্যকে নিয়ে?`
`কোথায়, এবং কেন?`
`টিপু সুলতান মসজিদের কাছে। এই ধর, দুপুর বারোটা নাগাদ।`
`কিন্তু কেন?`
`আহ্, প্রশ্ন করে আবার`, ধমকে উঠল কণ্ঠস্বর। `কোনো ডিসিপ্লিন শিখিসনি? বিনা প্রশ্নে মেনে নিতে হয় সব, জানিস না? `
এমনিতে মোটা গোঁফের লোকজনকে আমি বেশ সমঝে চলি। কেমন একটা ভিলেন মার্কা ইম্প্রেশন আসে। তার ওপর এই লোকটা কিছু বললে না করা যায় না। করতে পারি না আমরা কেউই। কখন আবার রাত্রিবেলা ফোন করে তিন ঘণ্টা ধরে আমার বিচার চালাবে এবং বিচারের রায় হবে টানা তিনদিন গুলি করে মৃত্যুদণ্ড। অথবা এর পরে দেখা হলে হয়ত, কিছুর মধ্যে কিছু না, আমার মাথার ঝুঁটিটা ধরে টেনেই দিল সর্বসমক্ষে। পারে, মোটা গোঁফের লোকেরা সব পারে। এই সব সাত-পাঁচ ভেবে যা থাকে কপালে বলে অফিসে বলে দিলাম পরদিন আমি একটু দেরি করে আসছি।
পরের দিন, শুক্রবার, আমি আর শাক্য যথাস্থানে গিয়ে দেখি মোটা গোঁফ হাজির আমাদের আগেই। বেশ কিছুদিন বাদে দেখা। চেহারাটা আরেকটু মোটা হয়েছে। একটু থপথপে ভাব। তবে চশমার আড়ালে ঝকঝকে চোখ আর অনাবিল হাসিটা এখনো অমলিন। আমাদের দেখে জড়িয়ে ধরল। আড্ডায় আরো দেখলাম বিপুলদা আর সুমিতাভ দা-কে।
আমাদের নিয়ে মসজিদের পাশের একটা ছোট, কিন্তু বেশ ভিড় খাবারের দোকানে ঢুকল। তখনো 'অসর'-এর নামাজ শেষ হয়নি। মোটা গোঁফ কানের কাছে মুখ বাড়িয়ে ফিসফিস করে বলল `এই সময়টায় আসলি বলে পাবি, এর পরেই 'অসর' শেষ হবে, আর মাল-ও শেষ।'
জিনিসটা কী? এক কোণে কাঠের বেঞ্চিতে বসার একটু পর সেই 'মাল' এল। আগুনের মতো গরম গোমাংসের খিচুড়ি। পাশে অল্প আচার। মোটা গোঁফ বলল `গোটা কলকাতায় আপাতত আমার ফেভারিট খাবার এটা। যত পারিস খা। কোনো শরীর খারাপের বালাই নেই। আমি তো এক-একদিন তিন চার প্লেট করে খাই।'
স্বভাব-পেটুক বিপুলদা ততক্ষণে ঝাঁপিয়ে পড়েছে প্লেটের ওপর। মানে, দেখে মনে হল `এবারে বড় পিসির বাড়ির ভাগ-বাঁটোয়ারা নিয়ে হয় এসপার নয় ওসপার-বডি ফেলে দেব পুরো, আর এটাই লাস্ট মিল` এরকম ভাব করে খাচ্ছে। শাক্যও তথৈবচ। গরমের চোটে হুস-হাস করছে। এদিকে পরের চামচটা ফেলতে দিচ্ছে না এক সেকেন্ডের জন্যেও। এসব মহান মানুষদের পাশে বসে, আমি আর কী করি, যেন লজ্জায়, মানে ঠিক না খেলেও চলত, হেঁ হেঁ, কিন্তু ব্যাপারটা কী জানেন তো, তিস্তা জলবণ্টন চুক্তিটা একটু আটকে আছে এই না খাবার জন্যেই, তাই বাধ্য হয়ে আর কী- এরকম মুখের ভাব করে এক গ্রাস গলা দিয়ে নামিয়ে দেখি, এ যে দেবভোগ্য জিনিস! এতদিন এটা না খেয়ে থাকার জন্যেই তো আমার নুরেমবার্গে বিচার হওয়া উচিত ছিল। শুধু খিচুড়ি বললে কম বলা হয়, নরম মাংস আর ভাত মাখামাখি হয়ে মিশে যাচ্ছে মুখের ভেতর। আর তার সঙ্গে সমানে সঙ্গত দিচ্ছে ঘি-গরম মশলার টাচি মিশ্রণ। অনেকটা রবিশঙ্কর-জাকির হুসেনের যুগলবন্দি। আমি ভয়ানক উত্তেজিত হয়ে পাশে ফিরে বললাম, `এ জিনিস এটুকু খেয়ে আশ মিটছে না। আরেক প্লেট বোলাও। সঙ্গে ভুনা-টুনা যা থাকে আনতে বলো।'
কৌতুকে ঝকমক করে উঠল উজ্জ্বল চোখ: `ভাল লাগছে না? দেখ, আমি জানতাম বাঙালরাই এসবের মর্ম বুঝবে। খা কত খাবি` বলে হাঁক দিয়ে আরো আনতে বলল।
অদ্ভুত একটা গন্ধ বেরোচ্ছিল খিচুড়িটা থেকে। সেটা ম্যারিনেট করা মাংসের জন্য হতে পারে, হতে পারে ঘি-এর জন্য, অথবা সামান্য যে ক্যাওড়া জল আমার সারমেয়-তুল্য ঘ্রাণশক্তি ধরতে পেরেছিল, তার গন্ধ। এক একটা গ্রাসের সঙ্গে গরম ধোঁয়া বেরিয়ে আসছে নাক মুখ দিয়ে, আর আমার সারা গায়ে লেগে যাচ্ছে সেই গন্ধটা। ভুনাটাও ছিল 'কেয়া বাত'। বেশ ঝাল করে রাঁধা, রগরগে গা থেকে গড়িয়ে যাচ্ছে লাল তেল। ভুনার গ্রেভি দিয়ে খিচুড়িটা মাখিয়ে খেলাম। সেই লাল তেল আর মাংসের চর্বি একটু একটু করে গলে যাচ্ছে খিচুড়ির গরম ঝোলের ভেতর, আর মুখে দিলে ঝাল, গরম, ঘি, দারচিনি আর সেই অজানা গন্ধের ককটেল... মনে হল জাস্ট এই দোকানটার জন্যেই কলকাতা লন্ডন বা প্যারিসকে বলে বলে ছ'গোল দিয়ে দেবে।
এদিকে তুমুল তক্ক লেগে গেছে সুমিতাভ দা আর মোটা গোঁফের। মোটা গোঁফের বক্তব্য, একমাত্র এই দোকানেই এরকম খিচুড়ি পাওয়া যায়। সুমিতাভদা বলছেন, না পাশের দোকানে এর থেকেও ভাল একটা পাওয়া যায়। মোটা গোঁফ সঙ্গে সঙ্গে গেল খোঁজ করতে। আর ফিরে এল `কী কেমন ডজ দিলাম? আর আসবি কখনো খেলতে` মার্কা একটা হাসির সঙ্গে। ওটা নাকি তাহিরি, আর এই খিচুড়ির সঙ্গে তাহিরির তুলনা? ছ্যা! কিসে আর কিসে! গোত্রহীনদের সঙ্গে সংশ্রব রাখলে এমনই হয়, ফাঁকতালে এসব কথাও শুনিয়ে দিতে ছাড়ল না। সুমিতাভদা একেই ভাল মানুষ, একটু ঘাবড়ে গিয়ে খুব মনমরা হয়ে গেল দেখলাম।
এরই মধ্যে টিফিন কেরিয়ারে মোটা গোঁফের জন্য চার প্লেট খিচুড়ি তুলে নেওয়া হয়েছে। আমার তাড়া ছিল বলে অফিস বেরিয়ে গেলাম, যাবার আগে ঝকঝকে চোখ বলে দিল `আজ আমি খাওয়ালাম, কিন্তু তোর চাকরি পাওয়া বাবদ খাওয়াটা পাওনা থাকল। নেক্সট বার তুই। এই খিচুড়ি-ই খাওয়াতে হবে।'
পরে শুনেছিলাম, শাক্যর দৌলতে একবোতল রেডিমিক্সও জোগাড় হয়েছিল। তারপর মোটা গোঁফের গাড়িতে বসে সকলে মিলে খেতে খেতে আউট্রাম ঘাট। সেখানে সুমিতাভদা বলেছিলেন পার্ক সার্কাসে কোথায় যেন খুব ভাল বিফ পাওয়া যায়। সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি ঘোরানোর হুকুম এবং 'এসব জিনিস এ জীবনে না খেলে নরকে যেতে হবে' টাইপের কারণ দর্শানো। সেই দোকানে গিয়ে আরেক প্রস্থ খাবার পরে মোটা গোঁফের বাড়ি। সেখানে বাংলা, হুইস্কি এবং সহযোগী আড্ডা। রাত্রিবেলা শাক্যর দাবিতে ফের এসেছিল বিফ খিচুড়ি। আড্ডার ফাঁকে ফাঁকে নাকি বিপুলদাকে দেখে হুঙ্কার ছাড়া হচ্ছিল `আয় তোকে আজ গাঁজা খাওয়াব। আয় তোর গলায় বাংলা ঢালি`। আদ্যন্ত ভদ্র এবং মদের ধারে কাছে না যাওয়া বিপুলদা নাকি করুণ মুখে বাসি মুড়িঘণ্ট খাচ্ছিল আর মাঝে মাঝে বুক ভাঙ্গা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ছিল বিফ খিচুড়ির দিকে তাকিয়ে। নাহ্! শাক্য এক ফোঁটাও ভাগ দেয়নি।
প্রায় মাস তিনেক বাদে আবার একটা ফোন এসেছিল। এবার বিপুলদা করেছিল। বাচ্চাদের মত হাউ হাউ করে কাঁদছিল বিপুলদা। না, আমার চাকরি পাওয়ার ট্রিট দেওয়াটা বাকিই থেকে গেল। ঝকঝকে চোখ দুটো, মোটা গোঁফের আড়ালে লুকিয়ে থাকা বাচ্চাদের মতো হাসি, সামান্য তোতলামি সব থেমে গেছে হঠাৎ এক অকরুণ সকালবেলা। সব হাসি, অভিমান, ছেলেমানুষি, কষ্ট, কবিতা, সব কিছু ঝরা পাতার মত অবহেলায় এক পাশে ফেলে রেখে অন্য এক জার্নি শুরু করেছে লোকটা। নিথর শরীরটা যখন দেখলাম, মনে হল এভাবেও চলে যাওয়া যায়? বিফ খিচুড়িটা আমি আর কোনোদিন খেতে পারব না। জানি না কেন, কিন্তু টিপু সুলতান মসজিদের পাশের ওই ছোট্ট দোকানটার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেও পারব না হয়ত কোনদিন। আজ বুঝেছি, খিচুড়ির সেই অজানা গন্ধটা কিসের ছিল। নিখাদ বন্ধুত্ব হাসি হয়ে আমার চারপাশে এমন একটা আরামের ওম তৈরি করে দিয়েছিল, গন্ধটা আসছিল সেখান থেকে, শীতের ভোরবেলা ঊষ্ণ লেপের মতন। সেই গন্ধটাও আমি আর পাব না কখনো। কিন্তু, আপনারা বিশ্বাস করুন, আমি কিন্তু কাঁদছি না। গলাটা ধরা ধরা লাগছে? ধুর, ও তো সর্দি হয়েছে বলে। চোখের কোণ ভিজে? আরে আমার চোখে কি কাঁকরও পড়তে নেই? আমার সত্যি কোনো কষ্ট নেই-কারণ আমি জানি, স্বর্গ বলে যদি কিছু থেকে থাকে, তাহলে ঈশ্বর তাঁর নিজের হাতে রান্না করা বিফ খিচুড়ি দিয়েই সেদিনের মতো জয়দেব বসু আর তাঁর কবিতাগুলোকে অভ্যর্থনা জানিয়েছেন।
শময়িতা চক্রবর্তী