ভারত ব্যাডমিন্টনে সিন্ধুর হাত ধরে পদক পাচ্ছে 'সক্রেটিস'-এর জন্য!
স্বরূপ দত্ত
অলিম্পিকে তাহলে ভারত রপ্ত করে নিয়েছে গ্রিকদের স্টাইল। অথবা নিজেদের অজান্তেই হয়ে গিয়েছে একটা গ্রিকদের শৃঙ্খল। আধুনিক বিশ্বে মাথা বলতে তো আমেরিকা, রাশিয়া, ইংল্যান্ড, জার্মানি, ফ্রান্স, চিন, জাপানদের মতো দেশগুলো। কিন্তু প্রাচীন পৃথিবীতে যে গ্রিকরাই ছিল মাথা। আর তাঁদের সাম্রাজ্যে ধীরে ধীরে থাবা বসিয়েছিল রোমানরা। পৃথিবী আজও রয়ে গিয়েছে। তাঁর অতীত আর বর্তমান বদলে গিয়েছে শুধু। কিন্তু সে যে রয়েছে ইতিহাসেরই আদূরে বুকে।
গ্রিক সভ্যতার কথা বলতে গেলে, ওই তিনজন ছাড়া যে, কোনও কথাই সম্পূর্ণ হবে না। সক্রেটিস, প্লেটো এবং অ্যারিস্টেটল। গ্রিকদের এই গর্বের তিনের দর্শনের উপর ভিত্তি করেই তো আজও টিকে রয়েছে আধুনিক মানুষের যুক্তি-তর্কের বিরাট বহুতল। প্রথমে এসেছিলেন সক্রেটিস। বানিয়েছিলেন প্লেটোর মতো দুর্দান্ত ছাত্র। পরে প্লেটোও তৈরি করেছিলেন আর এক প্রতিভাবান ছাত্রকে। অ্যারিস্টেটল। শিক্ষক-ছাত্রের এমন 'সাইকেল' গোটা বিশ্বেই বিরল। আমাদের বাংলা কিংবা ভারতে খানিকটা তেমনই হয়েছিল। শ্রীরামকৃষ্ণ এবং স্বামী বিবেকানন্দ। শিক্ষক-ছাত্রের সেরা যুগলবন্দী এদেশের ইতিহাসের।
ভাবছেন, কেন এই এই শিক্ষক ছাত্রদের নিয়ে পড়লাম। তার কারণ, রিও অলিম্পিক। এবার এখনও পর্যন্ত দুটো পদক নিশ্চিত। একটি পেয়েছেন সাক্ষী মালিক। অন্যটি নিশ্চিত করেছেন পি ভি সিন্ধু। আজই তাঁর ম্যাচ সন্ধেবেলায়। জিতলে সোনা পাবেন। হারলে রুপো। কিন্তু আমাদের দেশের মেয়ে সোনারই থাকবেন। অথবা তার থেকেও বেশি কিছু। খেয়াল করে দেখুন গত লন্ডন অলিম্পিকেও পদক জিতেছিলেন সাইনা নেওয়াল। এবারের অলিম্পিকে পদক পেলেন পি ভি সিন্ধু। দুজনই খেলেন যে ব্যাডমিন্টন। এ দেশের ব্যডমিন্টন ইতিহাসে কোনওকালে খুব বলার কিছু ছিল না। একটা নাম প্রকাশ পাড়ুকোন। আর একটা পুলেল্লা গোপীচাঁদ। ব্যস। তাও দুজনের কারও বাড়িতেই নেই অলিম্পিক পদক।
উল্টে অল ইংল্যান্ড চ্যাম্পিয়নশিপ জেতা প্রকাশের মেয়ে ব্যাডমিন্টন কোর্ট ছেড়ে নেমে পড়েছেন সিলভার স্ক্রিনে। দীপিকা পাড়ুকোন। দেশের সবথেকে দামি 'নায়িকা'। আর গোপীচাঁদ? নিজে খেলেছেন নিঃশব্দে। অলিম্পিক পদক হয়তো জেতেননি। কিন্তু তাঁর কেরিয়ারও কম গর্বের নয়। তবু, সেই মানুষটা খেলা ছাড়ার পর গর্বের স্রোতে গা না ভাসিয়ে নেমে পড়লেন ভারতীয় ব্যাডমিন্টনের সক্রেটিস হতে। এবং পেয়েও গেলেন প্লেটোকে! পুলেল্লা গোপীচাঁদ এ দেশের ব্যাডমিন্টনের সক্রেটিস হলে, সাইনা নেওয়ালকে যে প্লেটো বলতেই হবে আপনাকে। আর ওই দুজনকে ভারতীয় ব্যাডমিন্টনের সক্রেটিস এবং প্লেটো হিসেবে কল্পনা করে নিতে পারলে, আপনি তৃতীয় নাম হিসেবে অ্যারিস্টেটলকেও পেয়ে যাবেন। পি ভি সিন্ধু যে আমাদের দেশের ব্যাডমিন্টনের অ্যারিস্টেটলই।
সক্রেটিস গোপীচাঁদকে ঠিক কতটা কী বলে সম্মান দেওয়া যায় বলুন তো? এ দেশের ব্যাডমিন্টনকে তো গ্ল্যামারের দুনিয়ার পথে নিয়ে গেলেন তিনিই। নিজের পরিচর্যায় তৈরি করলেন সাইনা আর সিন্ধুকে। পর পর দুটো অলিম্পিকে পদক জিতলেন তাঁর ছাত্রীরাই! গোপীচাঁদকে যে একেবারে সক্রেটিস লাগছে। এই অলিম্পিকে খুব চলছে কথাটা। সিন্ধুকে, গোপীচাঁদ যা বলেছিলেন, এক বছর আগের ঘটনা। 'কোর্টের মধ্যে চেঁচাও। বেশি করে চেঁচাও।তাতে বিপক্ষ তোমায় ভয় পাবে।' আজ পৃথিবী দেখছে-শুনছে সিন্ধুর চেঁচানো। সক্রেটিসও তো এভাবেই শিখিয়ে ছিলেন ছাত্রকে। ছাত্র জিজ্ঞাসা করেছিলেন সাফল্য কী? সক্রেটিস তাঁকে প্রায় ডুবিয়ে দিয়েছিলেন জলে। তারপর মৃতপ্রায় ছাত্রকে জল থেকে তুলে বলেছিলেন, 'এই যে বাঁচার জন্য তুমি নিজের শেষ শক্তি পর্যন্ত দিচ্ছিলে, এটাকেই বলে সাফল্য!' গোপীচাঁদের দর্শন যে, সক্রেটিসের মতোই।
আজ পি ভি সিন্ধু সন্ধেবেলায় খেলতে নামবেন। কে জানে সক্রেটিসের মতোই গোপীচাঁদও তাঁর ছাত্রীকে এমন কোনও পরামর্শ দেবেন কিনা। গ্রিকদের ওই তিনের উত্তরসূরী হলেন চিরিসপাস। ভদ্রলোক বছর ৭৫ বেঁচেছিলেন। ১৪৩ তম প্রাচীন অলিম্পিক চলাকালীন প্রয়াত হয়েছিলেন। দূরপাল্লার দৌড়বিদ ছিলেন। বড় ভালো দৌড়তেন। সক্রেটিস করেছিলেন বিষপান। আর তাঁর উত্তরসূরী চিরিসপাস মারা গিয়েছিলেন কীভাবে জানেন? হাসতে হাসতে। নিজেই একটা চুটকি বা জোক লিখেছিলেন তিনি। (৭০০-রও বেশি বই বা প্যাপিরাস কাগজ লিখেছিলেন তিনি জীবনে)! তাতে একবার চিরিসপাস লেখেন, একটা গাধা ডুমুর খেয়ে ফেলেছে! তারপর সেই গাধার মুখ আর পেট পরিষ্কার করার জন্য তাকে মদ খাওয়ানো হল। এবার গাধাটা মাতাল হয়ে গেল...! এই পর্যন্ত লিখে নিজেই বেশ কয়েকবার আওড়ান চিরিসপাস। আর তারপর অট্টহাসিতে ফেটে পড়েন, নিজের সৃজনশীলতার ক্ষমতা দেখে। আর পর মুহূর্তে হাসতে হাসতেই লুটিয়ে পড়ে প্রাণত্যাগ করেন! হ্যাঁ, চিরিসপাস নিজের লেখা জোক পড়তে পড়তে, তা থেকে পাওয়া হাসিতে মারা গিয়েছিলেন! কেন বললাম এই কথাটা?
কারণ, মনে হচ্ছে আজ ভারতীয় ব্যাডমিন্টনের সক্রেটিস (গোপীচাঁদ) তাঁর ছাত্রীকে হয়তো এমনই বলবেন, 'আজ অট্টহাসিতে ফেটে পড়ো। নিজের খেলায় নিজে এত আনন্দ পেয়ো যে, পৃথিবীকে ভুলে যেও। নিজের সৃষ্টিতে ডুব তো সবাই দেয়। কিন্তু চিরিসতাসের মতো ডুব ক'জন দিতে পারেন! তাই চিরিসতাসরা প্রাচীন পৃথিবীর বাসিন্দা হয়েও আধুনিক ধারণার জন্ম দিয়ে যান আজকের পৃথিবীকে।' সিন্ধুও যে তাই। প্রাচীন সভ্যতা। ফের নতুন করে বয়ে চলেছে অনেক দূরের রিও-র বুকে। আজ 'সিন্ধু' তাঁর নিজের স্রোতে নিজেই গা ভাসিয়ে দিক শুধু। বাকি সভ্যতা এমনিই গড়ে উঠবে। আজ থেকে অনেক বছর পরেও সেদিন আরও আধুনিকবিশ্ব হয়তো এভাবে বলবে, 'ভারতীয় ব্যাডমিন্টনের গ্রিক দার্শনিকদের কথা। ছিলেন সক্রেটিস, প্লেটো, অ্যারিসস্টেটল এবং চিরিসপাসরা। যাঁদের সক্রেটিস ছিলেন গোপীচাঁদই।' চোখ বুজে কল্পনা করে দেখুন........কি এমন কিছু কল্পনা করতে পারলেন?