নারীকে বাদ দিয়ে কীসের নারীবাদ? অচেনা বিদ্রোহীর ইনকিলাবে, জিন্দাবাদ আমাদেরও!

ঊষসী মুখোপাধ্যায়

Updated By: Sep 20, 2020, 08:23 PM IST
নারীকে বাদ দিয়ে কীসের নারীবাদ? অচেনা বিদ্রোহীর ইনকিলাবে, জিন্দাবাদ আমাদেরও!

ঊষসী মুখোপাধ্যায়

রুথ গিনসবার্গ প্রয়াত। খবরটা জানাজানি হতেই উপচে পড়ছে শোকবার্তা। স্মৃতিচারণা, শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের পাহাড়। মা-বাবারা পুরোনো ছবি ঘেঁটে সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করছেন, অমুক সালে ফ্যান্সি ড্রেস কম্পিটিশনে বাচ্চারা রুথের মতো সেজেছিল! ট্রাম্প সরকার তড়িঘড়ি ঘোষণা করেছেন, দ্রুত রুথের উত্তরসূরি নিয়োগ হবে!

কে এই রুথ গিনসবার্গ? পপস্টার? নেতা? অভিনেতা? লেখক?

না! রুথ মার্কিন সুপ্রিম কোর্টের এক আইকনিক বিচারপতি। ৮৭ বছরের এক বিদ্রোহী আইনজ্ঞ, যিনি অধিকার শব্দটাকে একেবারে নতুন একটা মাত্রায় নিয়ে গিয়েছেন?সমানাধিকারের আইনি লড়াইকে বৈপ্লবিক স্তরে তুলে ধরেছেন। নারীবাদী রুথ কণ্ঠহীনের কণ্ঠ হয়েছেন। লিঙ্গ যে যোগ্যতার মাপকাঠি হতে পারে না, স্পষ্ট করে দিয়েছেন। শুধু মেয়েদের জন্যই তিনি গলা ফাটাতেন, তেমনটা মোটেও নয়! রুথের লড়াই অধিকারের জন্য।

এমন এক প্রবাদপ্রতিম চরিত্র, যিনি মাটি থেকে উঠেছেন এবং শীর্ষপদে পৌছনোর আগেই স্রেফ কাজের জোরে জনপ্রিয়তার শিখরে উঠেছেন!

কিন্তু রুথ গিনসবার্গ দেশ-মহাদেশের গণ্ডি পেরিয়ে আমাদের নজর পর্যন্ত পৌছতে পারেননি। ট্রাম্পের ব্যক্তিগত জীবন, বারাক—মিশেলের ছোটবেলার ছবি, ক্লিন্টনের পারিবারিক কেচ্ছা-কেলেঙ্কারিও আমরা গড়গড় করে বলে দিতে পারি। কিন্তু রুথকে আমরা চিনিই না! (হলিউডে আর নাই-বা গেলাম!)

একবার রুথকে জিজ্ঞেস করা হয়, আমেরিকার সুপ্রিম কোর্টে কবে যথেষ্ট সংখ্যক মহিলা বিচারপতি হবে? রুথ বলেন, যেদিন ৯ জন মহিলা বিচারপতির আসনে বসবে, সেদিন। রুথের উত্তরে চমকে ওঠেন প্রশ্ন কর্তা। ন-জন? কই, সুপ্রিম কোর্টে ৯ জন পুরুষ বিচারপতিকে নিয়ে কেউ আঁতকে ওঠেননি তো! কেন? পদাধিকারের মাপকাঠি লিঙ্গ কেন?

আমাদের সুপ্রিম কোর্টে কজন মহিলা বিচারপতি আছেন জানেন? ৩০ জনের মধ্যে দুজন। দেশের সব হাইকোর্ট মিলিয়ে দেশে মহিলা বিচারপতির সংখ্যা মাত্র ৭৮।

এই চোখে পড়ার মতো ফারাক নিয়ে ভেবেছিলেন রুথ।

দেশের আম-মহিলার শুভচিন্তক বিচারব্যবস্থায় যদি মহিলারা জায়গাই না পায়, তবে মহিলাদের জন্য কোনটা ভালো, কোনটা মন্দ, কোথায় সমস্যা, কীভাবে তার সমাধান সম্ভব, সেগুলো উপলব্ধি করবে কে? নারীকে বাদ দিয়ে নারী ক্ষমতায়ণ কীভাবে সম্ভব? আমার জীবন যাপন না করলে কেউ বুঝবে কী করে, আমার সঙ্গে প্রতিনিয়ত কী হচ্ছে? সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকারে কেন মহিলারা সামিল হবে না?

পরিসরটা আরও ছোট করে আনলেও প্রশ্নটা সমান প্রাসঙ্গিক। আমাদের দেশে কটা পারিবারে মহিলাদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার আছে? বরং পুরুষের সঙ্গ-হীন মহিলাকে নিয়ে প্রশ্ন ওঠে হামেশা। একা কেন থাকে? একা কেন রাতে বেরোয়? একা বেড়াতে কেন যায়? মেয়েদের ‘সুরক্ষায়’ রক্ষা-বন্ধন নামে আস্ত একটা উত্সব আছে আমাদের!

যতক্ষণ না মহিলাদের সহ-নাগরিক ভাবা হবে, ততক্ষণ তাঁরা স্রেফ মহিলা হয়েই থেকে যাবেন! সমান হবেন না!

আমরা এখনও তো বলি, মাধ্যমিকে ‘মেয়েদের মধ্যে’ প্রথম হয়েছেন অমুক! ‘মেয়েদের’ ক্রিকেট টিমের ক্যাপ্টেন তমুক! সহজপাঠের সেই লেখা অবলীলায় পড়ছি, ‘ছোট খোকা বলে অ-আ, শেখেনি সে কথা কওয়া’, লেখা হয়েছে ‘উ ঊ, ভাত আনো বড় বউ’! খোকা লেখাপড়া শিখবে, আর ভাত আনবে বড় বউ? এটা কি জেন্ডার রোলের সামাজিক সংজ্ঞায়ন নয়? কই, কানে বাধছে না তো!

উত্তরপ্রদেশের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী মায়াবতী ছোটবেলায় আইএএস হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন। তাঁর ভাইদের পাঠানো হতো বেসরকারি স্কুলে। আর ভাবী মুখ্যমন্ত্রী যেতেন দীর্ণ, মলিন সরকারি স্কুলে! ঘুরে দাঁড়াতে হলে একেবারে আক্ষরিক অর্থেই ক্ষমতায়ন চাই, বুঝতে ভুল করেননি মায়াবতী। তত্কালীন উত্তরপ্রদেশে সরকারি আমলাদের দোর্দণ্ডপ্রতাপ চেহারাটাই তো ছিল ক্ষমতার প্রতীক!

আমলা নয়, মায়াবতী সরাসরি পৌঁছেছেন ক্ষমতার কেন্দ্রে। তাই আজ তাঁর জীবন নিয়ে লেখালেখি হচ্ছে! কিন্তু যাঁরা পারেননি? সমঅধিকার তো তাঁদেরও ছিল! তাঁদেরও আছে!

এখনও বহু শিক্ষিত, শহুরে পরিবারে মেয়ে-বউদের চাকরি করা ‘না-পসন্দ’। আমাদের বলিউডের ফার্স্ট ফ্যামিলিতে দশকের পর দশক মেয়েদের সিনেমায় কাজ করতে বাধা দেওয়া হয়েছে! তবুও আমরা সেই পরিবারের পুরুষদের নায়ক বলেই মেনে এসেছি!

যে কোনও খবরের কাগজের পাত্র-পাত্রীর পাতা উল্টে দেখুন, সুশ্রী-সুন্দরী-ফর্সা-গৃহকর্মে দক্ষ বউ সকলের দরকার! এখনও বলিউড-হলিউডের নামকরা অ্যাওয়ার্ড শো-তে ‘মেল’ এবং ‘ফিমেল’ অ্যাক্টরের আলাদা পুরস্কার দেওয়া হয়! শিল্প-বিচারে লিঙ্গ কেন এত জরুরি বলতে পারেন কেউ?

বৈষম্য যে কী দানবীয় চেহারায় বিদ্যমান, তা পরিসংখ্যানই দেখিয়ে দিচ্ছে।

আন্তর্জাতিক লেবার অরগ্যানাইজেশন বলছে, কর্পোরেটে ম্যানেজার লেভেলে ৩ ভাগের মাত্র একভাগ মহিলা। তাঁদের শিক্ষাগত যোগ্যতা পুরুষ সহকর্মীদের থেকে বেশি হওয়া সত্ত্বেও তাঁরা সংখ্যালঘু!

দমকলে মহিলা কর্মীর সংখ্যা মাত্র ৩.৫%। এরোস্পেস ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে মাত্র ৭.৮%। ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্কের সার্ভে বলছে, ২০০৫-২০১৬ পর্যন্ত ভারতের মাত্র ২৭% মহিলা চাকরি করতেন, ২০১৫-১৬ সালে সেটা কমে দাঁড়ায় ২৪%। ২০১৭-১৮ সালে সরকারি অ্যানুয়াল ইকনমিক সার্ভে রিপোর্টে বলা হয়, পুরুষদের তুলনায় কম রোজগেরে মহিলাদের উপর চাকরি ছেড়ে সংসারে মন দেওয়ার জন্য চাপ তৈরি করা হয়!

ডাচ সংস্থা ওয়েজইন্ডিকেটরের একটি সমীক্ষা বলছে, ২০১৮ সালে ভারতে মহিলাদের তুলনায় পুরুষরা ১৯% বেশি রোজগার করতেন। আন্তর্জাতিক লেবার অরগ্যানাইজেশন বলছে, সম-বেতনের প্রশ্নে বিশ্বের সবচেয়ে পিছিয়ে থাকা দেশগুলোর মধ্যে ভারত অন্যতম!

আমাদের বায়ুসেনার প্রধান অরূপ রাহা ২০১৪ সালে বলেছিলেন, মেয়েরা ফাইটার পাইলট হওয়ার যোগ্যই নয়!

যুদ্ধবিমান ছেড়েই দিন, বাস-ট্রাম-অটো-টোটো-অ্যাপক্যাবে মহিলা চালক কজন আছেন? যে একজন দুজন আছেন, তাঁদের খোঁজ মিললে কাগজে-কাগজে তাঁর ছবি বেরোয়! কেন? আমরা কি জানতাম না যে, মেয়েরাও গাড়ি ও সংসার দুটোই চালাতে পারে? গাড়ি চালানোর যোগ্যতাকে বিশেষত্ব বলার যুক্তিটা ধোঁয়াশাই থেকে যায়।

এ-দেশের বহু মিডিয়া হাউস মেয়েদের সাংবাদিক হিসেবে নিয়োগ করতে চায় না, ঠিক যেভাবে আমরা সেনাবাহিনীতে মেয়েদের নিয়োগ করলেও যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠাই না! সম্প্রতি এই প্রসঙ্গে কেন্দ্র সুপ্রিম কোর্টে বলেছে, মেয়েরা কমান্ডার হলে পুরুষ-বাহিনী তা মেনে নিতে পারবে না! বকলমে, এই ২০২০ সালে দাঁড়িয়েও পুরুষের ইগোকে যুক্তি হিসেবে তুলে ধরছে সরকার!

টিভি, সিনেমা বা ভিশ্যুয়াল আর্টে ক্যামেরা-সংক্রান্ত কাজে মহিলা প্রায় নেই-ই! এমনকী, অস্কারের মতো ‘প্রোগ্রেসিভ’ মঞ্চে প্রথমবার একজন মহিলাকে সেরা সিনেমাটোগ্রাফারের মনোনয়ন পেতে ৯১ বছর সময় লেগেছে! (২০১৮ সালে মাডবাউন্ড ছবির জন্য মনোনীত হন রেচেল মরিসন)!

মেয়েরা অযোগ্য, এমন কোনও প্রমাণ কেউ দিতে পারেননি। তবু সামাজিক প্রাতিষ্ঠানিকতার রীতি-নীতিতে প্রশ্নের মুখে দাঁড়াতে হয় মেয়েদের যোগ্যতাকেই!

কারও অকর্মণ্যতা প্রমাণ করতে গিয়ে আনমনে যখন বলে ফেলি, ‘নে, হাতে চুড়ি পরে নে!’ কিংবা পৌরুষ প্রমাণে যখন বলি ‘আমি কি হাতে চুড়ি পরে আছি?’ তখন কি ভাবি, চুড়ি পরা হাত অযোগ্যতা, অকর্মণ্যতা, দুর্বলতার প্রতীক কেন?

উইমেন্স ডে কিংবা মাদার্স ডে-উদযাপনে অনেকেই বলেন, মেয়ে মানেই মাতৃত্ব! স্বেচ্ছায় মাতৃত্ব যাপন করা আর মা নামের সামাজিক নৈতিকতার ইনস্টিটিউশন, দুটোর ফারাক আমরা কি আজও বুঝি না?

রুথ মনে করেছিলেন, না। আমরা বুঝি না! সুপ্রিম কোর্টের শীর্ষপদে তাঁর নাম মনোনয়ন করেছিলেন তত্কালীন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিন্টন। কিন্তু রুথ বলেছিলেন, তাঁর সামনে তিনটে হার্ডল ছিল। ১. তিনি মহিলা। ২. তিনি দুই সন্তানের মা। ৩. তিনি ইহুদি! এমনকী, তাঁর হার্ভার্ডের অধ্যাপকও মনে করতেন, রুথকে কুর্সিতে বসিয়ে একজন যোগ্য পুরুষের আসন নষ্ট করা হচ্ছে!

তবুও রুথ হার মানেননি। ঘুরে দাঁড়িয়েছেন! আমরা ঘুরে দাঁড়াব কবে? ছেলে, মেয়ে, তৃতীয় লিঙ্গ, রূপান্তরকামী নির্বিশেষে লিঙ্গ পরিচিতি সরিয়ে রেখে নাগরিক অধিকারের প্রশ্ন তুলে কবে আমাদের রুথ গিনসবার্গরা সামনে উঠে আসবে? কবে আমাদের রুথরা অন্তর থেকে ইক্যুয়ালিটি উদযাপন করা শেখাবে?

যারা জোর গলায় ঠিক রুথের মতোই বলবে, ‘আমি মেয়ে বলে বাড়তি সুযোগ চাই না, আমি শুধু চাই আমাদের ভাইয়েরা আমাদের গলা থেকে পা-টা নামাক!’

এ-তো গেল শুধু জীবিতদের কথা! কন্যাভ্রূণ হত্যায় ইতিহাস গড়া ভারতকে নিয়ে বিশেষজ্ঞদের উদ্বেগ, ২০২৫ সালের মধ্যে প্রত্যেক বছর শুধু এদেশেই অজাতকন্যার সংখ্যা দাঁড়াবে ৪ লক্ষ ৬৯ হাজার!

জন্মের অধিকারই যেখানে প্রশ্নের মুখে, সেখানে সামাজিক সমানাধিকার কি জাদুমন্ত্রের মতো শোনাচ্ছে? বাস্তবকে অস্বীকার করার জায়গা নেই ঠিকই, তবুও রুথ গিনসবার্গরা এই বাস্তবের মাটিতে দাঁড়িয়েই আইনি সমানাধিকারের লড়াই করে গিয়েছেন। যে লড়াই অবলীলায় দেশ-কালের গণ্ডি পেরিয়ে ওয়াশিংটনকে মিলিয়ে দিতে পারে উত্তরপ্রদেশের সঙ্গে।

ভিনরাষ্ট্র, ভিনমহাদেশের একটা অচেনা নাম হঠাত্ কী ভয়ঙ্কর প্রাসঙ্গিক মনে হচ্ছে, না?

আরও পড়ুন- শান্তির রাজনীতি ও রাজনীতির শান্তি: নোবেলের নেপথ্যেও ক্ষমতার জোর?

.