১৬১ বছর আগে পৃথিবীর নিয়ম বদলে দিয়েছিল যে বই!
সৃষ্টিতত্ত্বের কাঁধ থেকে ঈশ্বরের হাতটা সরিয়ে দিয়েছিলেন ডারউইন!
সৌমিত্র সেন
সালটা ১৮৩০। এইচ এম এস বিগল জাহাজে করে বিশ্বভ্রমণে বেরিয়েছিলেন একটি লোক। সেখানে তিনি নানা অভিজ্ঞতা অর্জন করলেন, নানা নমুনা সংগ্রহ করলেন, পরীক্ষা-নিরীক্ষাও চলল। সে সব জড়ো করে তিনি একটি বইও লিখে ফেললেন। আর রাতারাতি সে-বই নতুন করে লিখল পৃথিবীর ইতিহাস!
ভদ্রলোকের নাম চার্লস ডারউইন। ১৮৫৯ সালের আজকের দিনে, ২৪ নভেম্বরে লন্ডন থেকে তাঁর সেই বইটি বেরিয়েছিল। 'অন দ্য অরিজিন অফ স্পিসিসেস'। বইটির পুরো নাম অবশ্য বেশ বড়-- 'অন দ্য অরিজিন অফ স্পিসিসেস বাই মিনস অফ ন্যাচারাল সিলেকশন, অর দ্য প্রিজারভেশন অফ ফেভারড রেসেস ইন দ্য স্ট্রাগল ফর লাইফ'! মানে করলে দাঁড়ায়, প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে প্রজাতির উৎপত্তি অথবা জীবনসংগ্রামে আনুকূল্যপ্রাপ্ত গোত্রের সংরক্ষণ বিষয়ে। অবশ্য বছরতেরো পরে বইটির নাম ছোট করে দেওয়া হয় 'দ্য অরিজিন অফ স্পিসিস'।
বইটি প্রকাশ মাত্রেই বিশ্বকে একটা তীব্র ঝাঁকুনি দিয়েছিল। পুরনো ধ্যানধারণা সব লহমায় বদলে গেল। ধাক্কা খেল চার্চ-চর্চিত ও প্রচারিত সৃষ্টিতত্ত্ব! বিরোধও বাধল। এ দিকে বিশ্ব জুড়ে জ্ঞানবুভুক্ষু মানুষ চেটেপুটে পড়তে লাগল পৃথিবীর জীবজগতের এই নতুন নিয়ম। মননবাদী মানুষের দল ধীরে ধীরে যেন তাঁদের সামনে একটা অচিন্ত্যপূর্ব দিগন্তের দুয়ার খুলে যেতে দেখলেন! জীববিজ্ঞানেই শুধু নয়, সামগ্রিক ভাবে বিজ্ঞানের পৃথিবীতেই একটা 'প্যারাডাইম শিফট' ঘটে গেল।
বইটির ভূমিকায় ডারউইন আর্মাডিলো, রিয়া নামের এক উড্ডীন-অক্ষম পাখি, কয়েকটি বিলুপ্ত প্রজাতির ঘোড়া এবং অধুনালুপ্ত স্লথের জীবাশ্মের কথা উল্লেখ করেন। জানা যায়, গ্যালাপোগোস দ্বীপের প্রাণী ও উদ্ভিদদের দেখেই তিনি বিবর্তনতত্ত্ব নিয়ে প্রথম চিন্তাভাবনা শুরু করেন। সেই চিন্তাভাবনাই পরে ক্রমে মহীরুহের আকার নেয়। যুগ যুগ ধরে বিজ্ঞানের জগতে কত কত গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার হয়েছে, কত কত গবেষণাপত্র বেরিয়েছে। কিন্তু হাতেগোনা কয়েকটি বিষয়ই সেই ভূমিকা পালন করে যা, শুধু আগের নয় সেই তত্ত্বের পরবর্তীকালের ওই বিষয়ক বিজ্ঞানের পুরোটাই সাবলীল ভাবে নিয়ন্ত্রণ করে, বদলে দেয়। ডারউইনের বিবর্তনতত্ত্বও তেমনই এক গবেষণা। এই আবিষ্কার তো শুধু বিজ্ঞান নয়, দর্শন ও সামাজিক ক্ষেত্রেও বিপুল সাড়া ফেলে দিয়েছিল।
লামার্ক প্রথম জীববিদ্যাকে আলাদা একটি বিষয় হিসেবে চিহ্নিত করেন। তিনিই প্রথম বলেছিলেন, প্রাকৃতিক নিয়মেই জন্মগ্রহণ করে প্রাকৃতিক নিয়মেই জন্মদাতার থেকে একটু আলাদা হয়ে যায় জীব। এবং এই ভাবে চলতে-চলতেই দীর্ঘ সময়ে বড় ধরনের বিবর্তন ঘটে। এই ভাবনাই ডারউইনকে তাড়িয়ে বেড়ায়।
ডারউইন দেখালেন, বিবর্তন শুধু পরিবর্তন নয়; এ হল পরিবর্তনের এমন এক ধারা যা অতীতকে সঙ্গে নিয়েই ভবিষ্যতের দিকে ভেসে চলে। এই পরিবর্তন অতি সরল থেকে সরল, সরল থেকে জটিল আবার জটিল থেকে জটিলতর কিংবা অনুন্নত থেকে উন্নত, উন্নত থেকে উন্নততরের দিকে। এবং এই জার্নিতে জীবকে পরিবেশের সঙ্গে লড়তে হয়, খাপ খাওয়াতে হয়। এই কাজগুলি করতে-করতে জীব নানা বৈচিত্র্য অর্জন করে। বেঁচে থাকার এই সংগ্রামে জয়ী হয়ে কেবল তারাই বেঁচে থাকে যারা যোগ্যতম। আর এর সঙ্গেই অন্বিত 'প্রাকৃতিক নির্বাচন' বিষয়টি। এই পথেই নতুন এবং উন্নততর প্রজাতির সৃষ্টি হয়। আরশোলা একই অবয়বে সুদীর্ঘকাল টিকে থাকল পৃথিবীতে। আরশোলা খাপ খাইয়ে নিতে পেরেছে বলেই এটা পারল। আবার ডাইনোসর নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল। সে খাপ খাওয়াতে পারল না। অর্থাৎ, এখানে প্রাকৃতিক নির্বাচনই আসল খেলাটা খেলছে।
কিন্তু এখানেও নানা ফাঁক থেকে গিয়েছিল। কী করে সেই ফাঁক ভরাট করা যায় তখন তা ডারউইনের জানা ছিল না। তবে সেই ফাঁকপূরণের মানুষও পেয়ে যায় বিজ্ঞান। আসেন গ্রেগর মেন্ডেল (১৮২২-৮৪) আর ওয়াইজম্যান (১৮৩৪-১৯১৪)। পৃথিবী পায় বংশগতি তত্ত্ব। অনেক জিনিসই তখন পরিষ্কার হয়ে যায়।
কিন্তু তাতে ডারউইনের গুরুত্ব কমে না। তিনিই প্রাথমিক ভাবে আমাদের শেখান, কোনটা নিকৃষ্ট জীব, কোনটা উৎকৃষ্ট, এবং কেন। এই 'কেন'ই আমাদের জ্ঞানতৃষ্ণা উসকে দেয়। ডারউইন আসলে আমাদের ছেড়ে দেন বিজ্ঞান-ইতিহাসের এক সন্ধিপথে, একটা বড় চৌমাথায়। যেখান থেকে অনেকগুলি পথ বেরিয়ে গিয়েছে। এবং আমরা নানা ভাবনার দিশা ধরে নানা দিকে ছড়িয়ে পড়ে শেষমেশ এক পূর্ণতাবাদী সামগ্রিকতায় উপনীত হতে পারি। শেষ নেই। শেষ কথা কে বলবে! শুধু আরও আরও এগিয়ে যাওয়া। চরৈবেতি। এবং তা থেকেই নব নব ভাবনা। তবে এমন একটা দর্শন যে-বই দেয়, তাকে কুরনিস না করে পারা যায়! তাই জন্মদিনে তার জন্য রইল অনেক অনেক শুভেচ্ছা।
আরও পড়ুন: অস্ট্রেলিয়ার সুন্দর সৈকতে হাঙর-হানায় মৃত্যু পর্যটকের