সুন্দরবনে ভরসা জোগাচ্ছে বিগ বসের swag
বছরের হিসেবে অস্তমিত যৌবন। কিন্তু এখনও সুস্থ, সবল, প্রাণবন্ত বিগ বস।
মৌপিয়া নন্দী
সালটা ২০১০। সুন্দরবনে চলছে বাঘসুমারির কাজ। হঠাতই লেন্সে ধরা দিলেন তিনি। বিশালদেহী, প্রাণবন্ত দক্ষিণরায়। তাঁর রাজকীয় ভঙ্গিমা, ব্যারিটোন গর্জন তাক লাগিয়ে দেয় সুমারি দলের সদস্যদের। এরপর থেকে বার বার সজনেখালি অভয়ারণ্যের বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে তাঁর সদম্ভ পদচারণা ধরা পড়েছে খালি চোখে হোক বা ক্যামেরায়। বন্য বাঘের নামকরণ একেবারেই নাপসন্দ ব্যাঘ্র বিশারদদের। তবে পর্যটকের নয়ণমণি এই বাঘমামার নাম মুখে মুখে ঘুরে বেড়ায় 'বিগ বস' হিসেবে। কারণ, বডি ল্যাঙ্গোয়েজে তিনি বুঝিয়ে দেন, এই এলাকার অবিসংবাদী নেতা তিনি, তিনি এবং তিনিই। আর সেই বিগ বসের সাম্প্রতিকতম ছবিই এখন আশার আলো ছড়াচ্ছে সুন্দরবন ব্যাঘ্র প্রকল্পের কর্তা ও বাঘপ্রেমীদের মধ্যে।
গত ৯ বছরে সবচেয়ে বেশিবার সুন্দরবনে সাইটিং হয়েছে এই বাঘটিরই। কারণ যে বিশাল এলাকাজুড়ে তার রাজত্ব সেখানে পর্যটকদের অবাধ যাতায়াত। আর নৌকা দেখলে পোজ দিতে কার্পণ্য করেন না সে। বছরের হিসেবে অস্তমিত যৌবন। কিন্তু এখনও সুস্থ, সবল, প্রাণবন্ত সে। কখনও নেতিধোপানি, কখনও নবাঁকিতে দেখা দিয়ে বুঝিয়ে দেয় বয়স বাড়লেও নিজের এলাকায় কর্তৃত্ব অটুট। আর এখানেই উত্সাহের রসদ পাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।
আপাতভাবে তার বয়স এখন ১৪-১৫ বছর। সম্প্রতি যে ছবি ধরা পড়েছে সেটি যে বিগ বসেরই তা গায়ের ডোরা এবং মাথা ও চোখের ওপরের চিহ্ন দেখে নিশ্চিত করেছেন টাইগার ট্র্যাকার নিত্যানন্দ চৌকিদার। ২০১০ সালের ছবির সঙ্গে তুলনা করে নিশ্চিত হয়েছেন তিনি। স্টেট ওয়াইল্ডলাইফ বোর্ডের সদস্য এবং শের এর কর্ণধার জয়দীপ কুন্ডু র ক্যামেরায় দুটি ছবিই ধরা পড়েছে। তাঁর মতে, নিজের এলাকায় এত বছর ধরে বহাল তবিয়তে এই বাঘটি বিরাজ করছে, এটা সুন্দরবন টাইগার রিজার্ভের জন্য অত্যন্ত ইতিবাচক বার্তা দেয়। সাম্মানিক বন্যপ্রাণ ওয়ার্ডেন সুচন্দ্রা কুন্ডুর সঙ্গেও গত ৯ বছরে একাধিকবার মোলাকাত হয়েছে বিগ বসের। উচ্ছ্বসিত সুচন্দ্রার বক্তব্য, সুন্দরবনে বাঘ সংরক্ষণের ক্ষেত্রে সাফল্যের অভিজ্ঞান বিগ বসের এই দাদাগিরি। প্রথম তাকে যখন দেখেন, তখনই তার বয়স অন্তত ৪-৫ বছর। তারপর এতগুলো বছর ধরে বহাল তবিয়তে বিরাজ করা অত্যন্ত আনন্দের বিযয়।
প্রাক্তন চিফ ওয়ার্ল্ডলাইফ ওয়ার্ডেন এবং দীর্ঘদিন সুন্দরবন বায়োস্ফিয়ারের দায়িত্বে থাকা প্রদীপ ব্যাসও মনে করেন সুন্দরবনে বাঘ সংরক্ষণের বিষয়ে অত্যন্ত সদর্থক ইঙ্গিত দিচ্ছে এই পুরুষ বাঘটির ভালভাবে বেঁচে থাকা। তাঁর মতে, বয়স বাড়ার ছাপ দেহে পড়লেও এবং এলাকা আগের তুলনায় ছোট হয়ে এলেও একই জায়গায় সে যে জীবনধারণ করতে পারছে এতে স্পষ্ট খাদ্যভান্ডারে টান পড়েনি। একইসঙ্গে তাঁর ব্যাখ্যা, দেশের অন্যান্য টাইগার হ্যাবিটাটের তুলনায় সুন্দরবনের বাঘের টেরিটোরিয়ালিটি কম প্রকট। যাকে বলা হয় ডিফিউজড টেরিটোরিয়ালিটি। তবে সুন্দরবনের বাঘও যে টেরিটোরিয়াল তার প্রমাণ অতীতেও মিলেছে। এই বাঘটি আরও একবার প্রমাণ করল। প্রদীপ ব্যাস আরও বলেন, ''ট্যুরিজম জোনে বাঘটির টেরিটোরি হওয়ায় এবং এখন হাতে হাতে ক্যামেরা থাকায় এই রয়্যাল বেঙ্গলটির গতিবিধি বেশি করে চোখে পড়ছে। তাই এটাকে কেস স্টাডি হিসেবে নেওয়া সম্ভব হচ্ছে''।
আরও পড়ুন- হাওয়া বেরিয়ে গেল ইমরানের, ভারতের চাপে হাফিজের বিরুদ্ধে কড়া পদক্ষেপ পাকিস্তানের
সুন্দরবন টাইগার রিজার্ভের ফিল্ড ডিরেক্টর নীলাঞ্জন মল্লিকের মতে, এই বাঘটির দীর্ঘদিন বহাল তবিয়তে রাজত্ব করা তিনটি বিষয়কে নিশ্চিত করছে। প্রথমত, বাঘের খাদ্যভান্ডার নিয়ে দুশ্চিন্তার কারণ নেই। দ্বিতীয়ত, এতটা বয়স হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও এলাকা দখলের লড়াইয়ে অন্য কোনও তরুণ পুরুষ বাঘ তাকে পরাস্ত করে এলাকাছাড়া করেনি। অর্থাত টেরিটোরিয়াল ফাইটের শিকার হয়নি বাঘটি। তৃতীয়ত, সুন্দরবনে চোরাশিকার বা মানুষ-পশু দ্বন্দ্বের শিকার হতে হয়নি তাকে। তাই সে তার জীবনের মেয়াদ পুরোটাই কাটাতে পারছে, যা সংরক্ষণের ক্ষেত্রে বড় সাফল্য।
আরও পড়ুন- কাশ্মীরে জঙ্গি নির্মূলে ব্লু প্রিন্ট বিজেপি সাংসদ সুব্রহ্মণ্যম স্বামীর
আয়লা পরবর্তী সময়ে সুন্দরবনের রয়্যাল বেঙ্গল ও তার খাদ্যভান্ডার নিয়ে দানা বেঁধেছিল আশঙ্কা। পরবর্তীকালে ক্যামেরা ট্র্যাপের প্রয়োগ আশ্বস্ত করেছে ম্যানগ্রোভের জঙ্গলে অন্তত শতাধিক রয়্যাল বেঙ্গলের বাস। বিগ বসের সাম্প্রতিক ছবি হাসি ফোটাচ্ছে ব্যাঘ্রপ্রেমীদের মুখে।