সুন্দরবনের একসময়ের 'দাতাকর্ণ' জলদস্যু আজ অনাহারে! সাহায্যর আর্জি বাংলার 'বীরাপ্পনের'
রয়াল বেঙ্গল ছাড়াও সুন্দরবন যার নামে কাঁপত, তাঁর নাম ধীরেন ওরফে বাচ্চু সর্দার। পুলিস থেকে প্রশাসন সকলের ত্রাস ছিলেন তিনি। এলাকার দাতাকর্ণ ছিলেন তিনি। অথচ পেশা ছিল জলদস্যুবৃত্তি। এলাকার সকলের পাশে থাকাই ছিল লক্ষ্য। বাংলার সেই 'বীরাপ্পন'ই এখন দিন কাটাচ্ছেন অসহায়ভাবে।
প্রসেনজিৎ সর্দার: পৃথিবীর বৃহত্তম ব-দ্বীপ সুন্দরবন। যার অধিকাংশ বাংলাদেশের ভূখন্ডে অবস্থিত। পৃথিবী বিখ্যাত রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের বাসভূমি এই সুন্দরবন। যেখানে জলে কুমির, ডাঙায় বাঘ। এই এলাকার মানুষের জীবন জীবিকা কাটেই প্রতিদিন লড়াইয়ের মধ্যে দিয়ে। রয়াল বেঙ্গল ছাড়াও সুন্দরবন যার নামে কাঁপত, তাঁর নাম ধীরেন ওরফে বাচ্চু সর্দার। পুলিস থেকে প্রশাসন সকলের ত্রাস ছিলেন তিনি। এলাকার দাতাকর্ণ ছিলেন তিনি। অথচ পেশা ছিল জলদস্যুবৃত্তি। এলাকার সকলের পাশে থাকাই ছিল লক্ষ্য। বাংলার সেই 'বীরাপ্পন'ই এখন দিন কাটাচ্ছেন অসহায়ভাবে।
আরও পড়ুন, Elephant In Sankrail: হাতি সামলান; ফসলের ক্ষতিপূরণের দাবিতে সাঁকরাইলে লাগাতার অবরোধ চাষিদের
আজ থেকে প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে ভারতীয় ভূখন্ডের সুন্দরবনের জঙ্গল এলাকায় বিভিন্ন জলযানে ডাকাতি নিয়ে চিন্তায় ছিল প্রশাসন। ক্রমাগত বেড়েই চলেছিল অত্যাচার। সেই সময় খাতায়কলমে সুন্দরবন তথা পশ্চিমবঙ্গের ভয়ঙ্কর জলদস্যুদের তালিকায় নাম ছিল একজনেরই। তিনি বাচ্চু সর্দার! ইংরেজদের অধীন থেকে তখন সবে মাত্র দেশ স্বাধীন হয়েছে।অখন্ডিত ২৪ পরগনা জেলার প্রত্যন্ত সুন্দরবনের বাসন্তী ব্লকের গরাণবোস এলাকার দুয়ারি ঠাকুরঘেরীর বাসিন্দা মহাদেব সর্দার ও কালিন্দী সর্দার দম্পতি বসবাস করতেন। দম্পতির দুই কন্যা ও চার পুত্র সন্তানের মধ্যে ধীরেন ওরফে বাচ্চু সর্দার তৃতীয়। বাবা মহাদেবের হাত ধরে তৎকালীন সময়ে পাঠশালায় ভর্তি হলেও দু-চারদিন যাওয়ার পর, লেখাপড়ায় মনযোগী না হওয়ায় পাঠশালায় যাওয়া বন্ধ করে দেন। এরপর ভবঘুরে হয়ে ওঠেন বাচ্চু।
পাশাপাশি সেই সময়ে জমিদারদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হতে হত সাধারণ দরিদ্র অসহায়দরকে। ভবঘুরে বাচ্চু বন্ধুদের নিয়ে জমিদারদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সরব হয়ে উঠতেন। বাচ্চুর এমন সাহসিকতা আর প্রতিবাদী মনোভাব দেখে এলাকার মানুষ স্নেহ করতে শুরু করেন তাঁকে। এরই মধ্যে জমিদারদের অত্যাচারে জর্জরিত হয়ে বছর কুড়ি বয়সের বাচ্চু বাবা-মায়ের হাত ধরে বাসন্তী থানার অন্তর্গত ঝড়খালি ত্রিদীব নগরের ডি ব্লকের এ কে জি কলোনীতে চলে আসে। কিন্তু তৎকালীন সময়ে জমিদারদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হলে আর্থিক স্বচ্ছলতার প্রয়োজন ছিল।
আরও পড়ুন, ৫০০ নয়, বাংলায় বিজেপি ক্ষমতায় এলে ২ হাজার টাকা দেবে, জানালেন সুকান্ত
তাই জমিদারদের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য বাচ্চু ও তার ছয় বন্ধু ডাকাতি করার ছক কষতে শুরু করে। সেই মতো যোগাযোগ তৈরী হয় বাংলাদেশের কয়েকজনের সঙ্গে। শুরু হয় জলদস্যুর কাজ। বাংলাদেশের বন্ধু বান্ধবদের কাছ থেকে আগাম গোপন খবর পেয়ে ইলিশ মাছ ভর্তি ট্রলার ছিনতাই করার ছক তৈরী করে। মেশিনগান সহ ৭ জনের একটি দল ডিঙি নৌকা নিয়ে সুন্দরবনের কলসদ্বীপের গভীর খাড়িতে ঘাঁটি গাড়ে। ভাটা পড়তেই ট্রলার ছিনতাই করে তারা।
ট্রলারে থাকা পদ্মার বিখ্যাত ইলিশ প্রায় চল্লিশ মণ(১৬০০ কেজি) মাছ লুঠ করে। নিজের ভাগের টাকা নিয়ে গ্রামে ফিরে আসে। দরাজ হস্তে দরিদ্রপরিবার গুলির পাশে দাঁড়িয়ে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। সেই থেকে জলদস্যুর কাজে হাতে খড়ি। এরপর শুরু দৌড়াত্ম্য! বাচ্চু সর্দারকে ধরতে নাজেহাল পুলিস-প্রশাসনও৷ একবার এক খাঁড়ির মধ্যে তাঁকে হাতের নাগালে পেলেও গুলির লড়াই করে পগারপাড় হন বাচ্চু সর্দার। তবে পরবর্তীতে যতবারই ধরা পড়েছেন ততবার আদালত থেকে তাঁকে ছাড়িয়ে নিয়ে এসেছেন এক আইনজীবী৷ এরপর এই পেশা থেকে সরে এসেছিলেন কিন্তু এক কন্যাদায়গ্রস্ত বাবাকে বাঁচাতে ফের ফেরেন এই পেশায়৷ ৩৫ বছর ধরে এই পেশাতেই দাপিয়ে বেরিয়েছেন তিনি।
এলাকার মানুষের কাছে তিনি অবশ্য দাতা কর্ণ। লুঠের টাকা সকলের মধ্যে বিলিয়েই আনন্দ পেতেন বাচ্চু সর্দার। স্থানীয়রাই ছিল তার ভরসা৷ আজ তিনি ৭৪ ছুঁইছুঁই। পেশির জোর কমেছে ফলে পেশা ছাড়তে হয়েছে। বিদ্যাধরী নদীর পাশেই ভাঙাচোড়া ঘরে দিন কাটছে একসময়ের বীরাপ্পনের। কাঁকড়া ধরে চলেছে পেট। পরের সাহায্যেই এখন সম্বল তাঁর। একসময় দরাজহস্তে দান করেছিলেন, সেই হাত পেতেই আজ বেঁচে থাকার আর্জি বাচ্চুর।