নকশাল আমল থেকে আজ পর্যন্ত বিদ্যাসাগরকে শুধু ভেঙেই চলেছে বাঙালি
দু'শো বছরের মধ্যে এত 'বাজে' কোনো বাঙালিকে কি পেয়েছে বাঙালি? নানা উপলক্ষে এই বাঙালিটি এমন আখাম্বা উচ্চতা নিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে পড়েন যে, স্বভাবতই ছোটমাপের বাঙালি লজ্জায় কুঁচকে যায়।
সৌমিত্র সেন
দু'শো বছরের মধ্যে এত 'বাজে' কোনো বাঙালিকে কি পেয়েছে বাঙালি? নানা সময়ে নানা উপলক্ষে এই বাঙালিটি এমন এক আখাম্বা উচ্চতা নিয়ে সটান সামনে দাঁড়িয়ে পড়েন যে, স্বভাবতই ছোটমাপের বাঙালি লজ্জায় কুঁচকে যায়। এঁকে স্বীকার করাও সম্ভব হয় না অথচ এড়াবারও জো নেই। সেই 'বাজে' বাঙালিটি আর কেউ নন, পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। যাঁর ২০০ তম জন্মবার্ষিকী আজই।
বিদ্যাসাগর সম্পর্কে মাইকেল মধুসূদন দত্ত যে কবিতাটি লিখেছিলেন, সেটি ক্লাসিক পর্যায়ে চলে গিয়েছে এবং জীবনের কোনও না কোনও সময়ে সেটির মুখোমুখি হননি এমন বঙ্গসন্তান হাতেগোনা। কিন্তু আমরা খুব কম লোকই জানি যে, পূর্ণেন্দু পত্রীও বিদ্যাসাগরকে নিয়ে একটি কবিতা লিখেছিলেন। ঠিক কবিতা নয়, ছড়া। সেখান থেকে কয়েকটি পঙক্তি উদ্ধৃতির লোভ সামলাতে পারছি না: 'এক যে ছিল বিদ্যাসাগর ভীষণ বাজে লোক/ বলত কিনা বিধবাদের আবার বিয়ে হোক' ....'এক যে ছিল বিদ্যাসাগর দেখতে এলেবেলে/ চাইতো কিনা লেখাপড়া শিখুক মেয়েছেলে' ....'এক যে ছিল বিদ্যাসাগর বুদ্ধি শুদ্ধি কই/ লিখেই চলে লিখেই চলে শিশুপাঠ্য বই।' ছড়া-ভঙ্গিতে লেখা কয়েকটি লাইনে পূর্ণেন্দু পত্রী বিদ্যাসাগরের জীবন ও কর্মের বেশ কিছু মূল জায়গায় আলো ফেলেছেন। তবে একটু তির্যকতার সঙ্গেই। যে তির্যকতা, বলাই বাহুল্য, তাঁর নয়; তা বাঙালিজাতির।
কিন্তু যে-মানুষটি সারা জীবন ধরে বাঙালিদের জন্য় ভেবে গেলেন, কাজ করে গেলেন, তাঁর প্রতি বাঙালির এমন মনোভাব কেন? অনেক কারণ। সংক্ষেপে এটুকু বলা যেতে পারে: বিদ্যাসাগর কখনও 'গুরু' হয়ে ওঠেননি, তাঁকে ঘিরে কোনও 'হ্যালো' তৈরি হয়ে উঠতে দেননি, কোনও অনুগমনকারী শিষ্যদল সংগ্রহ করে যাননি, নিজের চারিদিকে কোনও পরিকরবর্গের উত্থানে আগ্রহ দেখাননি, আত্ম-কেন্দ্রিক কোনও প্রতিষ্ঠানও তৈরি করেননি।
ফলে যে-সব চেনা মাপে বাঙালি সাধারণত তাদের মনীষীদের ফেলে দিয়ে দায়সারা সম্মান-পুজো-স্মরণের নিগড়ে বেঁধে নিশ্চিন্তে নিদ্রা যায়, বিদ্যাসাগরের পক্ষে সেটা করা কঠিন হয়ে পড়ে। এ শুধু সাধারণ বাঙালিরই যে সমস্যা, তা নয়। চিন্তাশীল বাঙালিরও এই সঙ্কট তৈরি হয়েছে। হয়তো আর একটি সূক্ষ্ম ভাবে।
গ্রিক কিংবদন্তিতে প্রোক্রাস্টেস নামের এক ডাকাতের কথা আছে। নৈশযাত্রীদের সে রাত্রিবাসের জন্য আমন্ত্রণ করে তার ঘরে ডেকে আনত। খাটে শুতে দিত। তারপর, যাত্রীটি তার খাটের চেয়ে লম্বা হলে, তাঁর পা ছেঁটে ছোট করে নিত আর বেঁটে হলে তাঁকে টেনে লম্বা করে নিত। বিদ্যাসাগরকে নিয়েও কিন্তু এটাই চলেছে। তাঁকে আমরা সবাই আমাদের নিজের-নিজের খাটে শুইয়ে আমাদের খাটের মাপে আঁটিয়ে নিতে চাই।
তাঁর জীবদ্দশাতেও এ সমস্যা হত। তাঁর মৃত্যুর পর এটা বহুগুণ বেড়ে গিয়েছে। তার ফলে নির্মোহ দৃষ্টিতে বিশ্লেষণ করা সামগ্রিক কোনো বিদ্যাসাগরকে আমরা আজও সেভাবে পাইনি।
পাওয়ার পথে নিত্য নতুন বাধাও সৃষ্টি হয়েছে। এখন যেমন মোদীর বিদ্যাসাগর ও মমতার বিদ্যাসাগর, রাজনীতিতে বিদ্যাসাগরের এই দুই অবতারকে আমরা প্রত্যক্ষ করছি। বাঙলার অধিকাংশ মনীষীদের নিয়েই অবশ্য এটা চলছে। বিদ্যাসাগরকে নিয়েও যে হবে, সেটা ভাবনার বাইরে ছিল। কোনো মনীষীর জন্মবার্ষিকী কোন দল কী ভাবে উদযাপন করছে, সেই সূত্রে নতুন কী প্রকল্প ঘোষিত হচ্ছে, কী কী প্রতিশ্রুতি দেওয়া হচ্ছে-- সবটাই একটা অবাঞ্ছিত প্রতিযোগিতার মোড়কে আমাদের কাছে আসছে। গত বছর বিদ্যাসাগরের জন্মদিন উপলক্ষে বীরসিংহ গ্রামে মুখ্যমন্ত্রী প্রতিশ্রুতির বন্যা বইয়েছিলেন। কোথায় কী? সব চেয়ে বড় কথা, বিদ্যাসাগর কলেজের ঘটনাটি বিজেপি-তৃণমূলের মধ্যে বিদ্যাসাগরকে নিয়ে আড়াআড়ি বিভাজন তৈরি করে দিল। কেন বিদ্যাসাগরকে নিয়ে সস্তা রাজনীতি হবে, এ প্রশ্নের উত্তর বাঙালির কাছে স্পষ্ট নয়। এ সব বাঙালিকে বাধ্য হয়ে সহ্য করতে হয়েছে।
বিদ্যাসাগরের বহুমুখী জীবনের নানা পর্যায়ে মূলত তিনটি ক্ষেত্রে তাঁর বিপুল ও ব্যতিক্রমী অবদানের কথা স্মরণ করা হয়: সমাজ, শিক্ষা, সাহিত্য।
সমাজ বলতে বিদ্যাসাগরের সমাজ সংস্কারমূলক কাজের কথাই আলোচ্য। যেখানে উজ্জ্বলতম ঘটনাটি বিধবা বিবাহ। বিধবা বিবাহের জন্য তাঁকে প্রচুর ঘাত-প্রতিঘাত সহ্য করতে হয়েছিল। চিরকালের হৃদয়বাদী ও যুক্তিবাদী বিদ্যাসাগর অবশ্য কাঁটা দিয়েই কাঁটা তোলায় বিশ্বাসী ছিলেন। কেননা, তিনি বিধবাদের পুনর্বিবাহ নিয়ে দেশের গোঁড়া ব্রাক্ষণ্যবাদী মনোভাবকে পরাজিত করার জন্য শাস্ত্রবচনের দিকেই হাত বাড়িয়েছিলেন। এবং জয়যুক্ত হয়ে সেটি আইন হিসেবে বলবৎ করতে পেরেছিলেন। তাঁর এই একটি কাজ গোটা নারীসমাজকে যে কত ভাবে স্বস্তি দিয়েছিল, তার ইয়ত্তা নেই! বহুবিবাহ রদও তাঁর স্মরণীয় কাজ।
শিক্ষাক্ষেত্রেও তাঁর অবদান বুনিয়াদি। বাংলা প্রাইমারের ইতিহাসে 'বর্ণপরিচয়' তাঁর ভাবনাপ্রতিভার এক অটল স্বাক্ষর। কিন্তু শুধু শিশুপাঠ্য বই লেখাই নয়, গ্রামে-গঞ্জে ঘুরে ঘুরে গায়ে-গতরে খেটেও শিক্ষাবিস্তারের জন্য কাজ করেছিলেন তিনি। কলকাতাতেই নিজের গাঁটের পয়সা খরচ করে গোটা কুড়ি বঙ্গবিদ্যালয় স্থাপন করেছিলেন। বাংলার জেলাজুড়ে মেয়েদের জন্য অন্তত ৩৫টি স্কুল করেছিলেন। শিক্ষাসংস্কারক হিসেবেও তিনি স্মরণীয়। তৎকালীন সংস্কৃত কলেজের পাঠক্রম নিয়ে বিশদে ভেবেছিলন। এ ক্ষেত্রে বেদান্ত ও সাংখ্য দর্শকে ভ্রান্ত বলে দাগিয়ে দিয়ে এবং এগুলিকে 'কমব্যাট' করার জন্য পাশ্চাত্য দর্শনের চর্চা বাড়ানোর তাঁর সুপারিশ নিয়ে অবশ্য প্রভূত জলঘোলা হয়েছে। হয়তো ঠিকই, এ ক্ষেত্রে তিনি একটু কম সংবেদনশীলতার পরিচয় দিয়েছিলেন। তবে, এ-ও ঠিক, সেই সময়ে দাঁড়িয়ে পিছন-টেনে-ধরা ওই দুর্দমনীয় ব্রাক্ষণ্যবাদকে ঠেকিয়ে রাখার জন্য এ-ও তাঁর এক নিজের মতো প্রকল্প ছিল। তবে, যা-ই তিনি করুন না কেন, সামনের দিকে তাকিয়েই করতে চেয়েছিলেন।
বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রেও বিদ্যাসাগরের অবদান ভোলার নয়। ঠিক যে-সময়ে বাঙালির একটা নিজের মতো ভাষা দরকার ছিল, সেই সময়েই তিনি বাংলা ভাষাটিকে একটু-একটু করে গড়ে তুলছিলেন। পরে এ বিষয়ে প্রধান কৃতিত্ব বঙ্কিমচন্দ্রকে দিলেও শ্রীঅরবিন্দ বিদ্যাসাগরের অবদানকেও শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেছেন। স্বয়ং বঙ্কিমচন্দ্র বিদ্যাসাগরী ভাষার চাল অপছন্দ করতেন, কিন্তু তিনিও এ ক্ষেত্রে বিদ্যাসাগরের কৃতিত্বকে খাটো করেননি। এ কথা তো সত্যিই অস্বীকার করা যায় না, রামমোহনের হাতে যে-ভাষা ভূমিষ্ঠ হয়েছিল, বিদ্যাসাগর তাকে দৌড় করাতে না পারলেও তার যথেষ্ট পুষ্টিবিধান করেছিলেন, তাকে হাঁটতেও শিখিয়েছিলেন।
সব মিলিয়ে বিদ্যাসাগর আমাদের নবজাগরণের এক অনন্য সন্তান। তিনি আমাদের নানা কিছু শিখিয়েছেন। যুক্তিবাদী গঠনমূলক মনোভাবের দ্বারা আমাদের ভবিষ্যৎ-পথের নানা বিপদ দূর করেছেন। সমাজ-শিক্ষা ইত্যাদি ক্ষেত্রে জীবনের মূল বিষয়গুলির উদযাপন ঘটিয়েছেন।
এবং একটু অন্যভাবে তিনি আমাদের ভাঙতেও শিখিয়েছেন। নিজেকে দিয়েই বিদ্যাসাগর বাঙালিকে 'আইকনোক্ল্যাজম'-এ দীক্ষা দিয়েছেন। বাঙালি স্বভাবত 'আইকনোক্লাস্ট' নয়। কিন্তু ঘটনার ফেরে পড়ে সে বারবার বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভেঙেছে। নকশাল আমল থেকে হাল আমল পর্যন্ত সেই ট্রাডিশন সমানে চলেছে।