৪২০ বছর ধরে কবিকঙ্কণ মুকুন্দরাম প্রতিষ্ঠিত সিংহবাহিনীর আরাধনায় রত ঘরগোহালের ঘোষবাড়ি

আগামী বছরের পুজো ক্যালেন্ডারে এখনই লিখে নিন ঘরগোহালের ঘোষপরিবারের দেবী সিংহবাহিনীর পুজোর নাম। ইতিহাসের গন্ধ মাখা ঐতিহ্যের সেই পুজোয় শরিক হতে পারেন আপনিও।

Edited By: সুদেষ্ণা পাল | Updated By: Jan 24, 2020, 05:34 PM IST
৪২০ বছর ধরে কবিকঙ্কণ মুকুন্দরাম প্রতিষ্ঠিত সিংহবাহিনীর আরাধনায় রত ঘরগোহালের ঘোষবাড়ি

সুদেষ্ণা পাল

তারকেশ্বর। নামটা শুনলেই সবার চোখে ভেসে ওঠে শ্রাবণ মাস, ছেলেবুড়োর দল সবাই মিলে কাঁধে করে বাঁক নিয়ে জল ঢালতে চলেছে। আট থেকে আশির সেই দলে যোগ দেন গৃহবধূ থেকে কচিকাঁচার দলও। কিন্তু অনেকেই জানেন না, এই তারকেশ্বরের কাছেই লুকিয়ে আছে বাংলার ইতিহাসের আরও এক স্মৃতিবিজড়িত অধ্যায়। চণ্ডীমঙ্গল রচয়িতা কবিকঙ্কণ মুকুন্দরাম চক্রবর্তী প্রতিষ্ঠিত সিংহবাহিনী দেবীর পুজো। ঐতিহ্য মেনে বিগত ৪২০ বছর ধরে হয়ে আসছে এই পুজো।

হুগলীর আরামবাগ মহকুমার মলয়পুর-১ গ্রাম পঞ্চায়েতের ঘরগোহাল গ্রাম। সেই গ্রামেরই বাসিন্দা ঘোষ পরিবার। আনুমানিক ১৬০০ খ্রিষ্টাব্দে এই ঘোষবাড়ির পঞ্চমুণ্ডীর আসনেই সিংহবাহিনী দেবীর প্রতিষ্ঠা করেছিলেন কবিকঙ্কণ। উল্লেখ্য, ঘরগোহালের এই ঘোষ পরিবারেরই কৃতী সন্তান ছিলেন খড়্গপুর আইআইটির প্রথম ডিরেক্টর বরেণ্য বিজ্ঞানী ড. জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ। পদ্মভূষণ প্রাপক ড. জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ দেশে কারিগরি শিক্ষার প্রসারে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছিলেন। তাঁরই পূর্বপুরুষ গোপীনাথ ঘোষ।

বিজ্ঞানী ড. জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ

হুগলীর গোঘাট থেকে এই ঘরগোহাল গ্রামে এসে বসতি স্থাপন করেছিলেন গোপীনাথ ঘোষ। সে প্রায় আজ থেকে ১০ প্রজন্ম আগের কথা। সেইসময়ই ঘোষবাড়িতে এসে দেবী সিংহবাহিনীর প্রতিষ্ঠা করেছিলেন কবিকঙ্কন মুকুন্দরাম চক্রবর্তী। ঘোষ পরিবারের বর্তমান প্রজন্মের কাছ থেকে কথায় কথায় জানা গেল, আগে তাঁরা ছিলেন বৈষ্ণব। বাড়িতে রাজরাজেশ্বর নারায়ণ মন্দিরও রয়েছে। পরবর্তীতে বংশরক্ষার জন্যই শুরু হয়েছিল সিংহবাহিনী দেবীর পুজো।

সেই থেকে আজও পরম্পরা মেনে, ঐতিহ্য বজায় রেখে এই পুজো হয়ে আসছে। ক্যালেন্ডারের পাতায় পেরিয়ে গিয়েছে ৪২০ বছর। কিন্তু কবিকঙ্কণের হাত ধরে শুরু হওয়া দেবী সিংহবাহিনীর আরাধনায় কোনও ছেদ পড়েনি। সময়ের সঙ্গে কিছু নিয়ম বদলালেও, পুজোর মূল আচার সেই সনাতন কাল থেকে একই রয়ে গিয়েছে।

৪০০ বছর আগে তখন ঘড়ি ছিল না। পুজোর তিথি,  আচারের প্রহর সেইসময় গোনা হত 'জল-ঘড়ি' দিয়ে। কী এই 'জল-ঘড়ি'? অনেকটা যেন বালি-ঘড়ির মতই। একটা বড় হাড়িতে জল রাখা হত। সেই জলের উপর বসানো হত একটি পাত্র। সেই পাত্রের গায়ে ছোট ছিদ্র থাকত। যা দিয়ে হাড়ির জল ওই পাত্রের ভিতর ঢুকত। ধীরে ধীরে পাত্রটি জলপূর্ণ হয়ে হাড়ির মধ্যে ডুবে যেত। এইভাবেই গোনা হত পুজোর প্রহর। স্থির হত আচারের সময়।

সিংহবাহিনী দেবীর পুজো হয় শাক্ত মতে। কবিকঙ্কণ মুকুন্দরাম চক্রবর্তী নিজে এই পুজোয় পাঠা বলি প্রথা শুরু করেছিলেন। 'জল-ঘড়ির' সময় দেখে প্রহর গুনে সন্ধিপুজোয় বলি প্রথার প্রচলন করেছিলেন তিনি। তারপর থেকে একইরকমভাবে এই প্রথা চলে আসছে ঘোষবাড়িতে। বর্তমান প্রজন্মের এক সদস্য জানালেন, "একাত্তরের বন্যার সময় চারদিক জলে ভেসে গিয়েছে। বলির পাঁঠা কোথায় পাওয়া যাবে! সেইসময়ই স্থির হয়েছিল এবার বলিপ্রথা বন্ধ করে দেওয়া হবে। কিন্তু, অদ্ভূতভাবেই সেবার যেন দেবী সিংহবাহিনী-ই সব ব্যবস্থা করে দেন!"

সিংহবাহিনী দেবী মন্দির

ঘোষপাড়া থেকে পার্শ্ববর্তী এলাকা, সবার কাছেই এই দেবী খুব জাগ্রত বলে নিয়ম-নিষ্ঠাভরে পূজিত হয়ে থাকে। পুজো শুরুর আগে পারিবারিক রাজরাজেশ্বর নারায়ণ মন্দির থেকে রাজা ও লক্ষ্মীকে শোভাযাত্রা করে এনে স্থাপন করা হয় সিংহাসনে। ঐতিহ্য বিজড়িত এই পুজোয় অন্যতম একটি রীতি হল 'ধুনোপোড়া'। বাড়ির মহিলারা বড় থেকে ছোট সবাই মাথায় মাটির সরা নিয়ে সারবদ্ধভাবে আসনে বসেন। তারপর সেই মাটির সরার মধ্যে ধুনো জ্বালানো হয়। দু'হাতেও থাকে সেরকমই দুটি সরা। পাশাপাশি সেই আদিকাল থেকে এখনও এই পুজোয় ৮ মণ চালের নৈবদ্য দেওয়ার রীতি বিদ্যমান রয়েছে।

রাজরাজেশ্বর মন্দির থেকে রাজা ও লক্ষ্মী নিয়ে এসে আসনে প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে

কবিকঙ্কণের হাত ধরে শুরু এই পুজোকে ঘরগোহালের ঘোষ পরিবার ৪০০ বছর পেরিয়েও এখনও সমানভাবে আগলে রেখেছে। পুজোর আচার থেকে অতিথিদের আপ্যায়ণ, কোথাও কোনও ফাঁক রাখেননি তাঁরা। কিন্তু লোকবল কমছে। পরিবারের অনেকেই কর্মসূত্রে এখন গ্রাম ছাড়া। পুজো উপলক্ষেই সবাই একজায়গায় জড় হন। কিন্তু এরপর কী? ইতিহাসের গন্ধ জড়িয়ে যে পুজোয়, তার ভবিষ্যৎ কী হবে? ঘোষ পরিবারের প্রবীণদের কপালে চিন্তার ভাঁজ। তবু কোনওভাবেই হাল ছাড়তে নারাজ ঘোষবাড়ি। তাঁদের বিশ্বাস, পথ দেখাবেন দেবী সিংহবাহিনী-ই।

ধুনোপোড়া

চলুন জেনে নিন, কীভাবে ঘরগোহাল গ্রামে ঘোষবাড়ির সিংহবাহিনী দেবীর মন্দিরে আপনি পৌঁছবেন? হাওড়া থেকে গোঘাট বা আরামবাগ লোকালে টকিপুর স্টেশনে নামবেন। সেখান থেকে টোটো বা বাসে বড় কেলাপাড়া বাসস্টপ। অথবা হাওড়া থেকে তারকেশ্বর লোকালে তারকেশ্বর স্টেশনে নেমে, সেখান থেকে টোটো বা বাসে পঞ্চাননতলা বাসস্টপ। সকালে গিয়ে সারাদিন পুজো আচার-অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে আবার একইভাবে আপনি রাতে ফিরে আসতে পারবেন। আপনার ইচ্ছে হলে দেবী সিংহবাহিনীকে অঞ্জলিও দিতে পারবেন। আর আতিথেয়তা? মিষ্টিমুখ থেকে মধ্যাহ্নভোজ, অতিথিদের জন্য সর্বক্ষণ আতিথেয়তার ডালি সাজিয়ে প্রস্তুত ঘোষ পরিবার।

৮ মণ চালের নৈবদ্য

তাই আর দেরি করবেন না, এখনই আগামী বছরের পুজো ক্যালেন্ডারে লিখে নিন ঘরগোহালের ঘোষপরিবারের দেবী সিংহবাহিনীর পুজোর নাম। আজ থেকে ঠিক ৩৮০ দিন পর আবার পুজো। ২২ অক্টোবর ষষ্ঠীতে বোধনের সঙ্গে সঙ্গেই দেবী সিংহবাহিনীর আরাধনায় মেতে উঠবে ঘোষ পরিবার। ইতিহাসের গন্ধ মাখা ঐতিহ্যের সেই পুজোয় শরিক হতে পারেন আপনিও।

.