৭১তম স্বাধীনতায় সব থেকে জোরে কথা বললেন এই 'গুঙ্গা পালোয়ান'
সৌরভ পাল
চিলেকোঠার থেকে ঘরটার মাপ সামান্যই বড়। 'পায়রার খোপের মত ঘরে' রয়েছে চারটি চৌকি বিশেষ। সিলিং বরাবর ঝোলানো আছে একটা দড়ি, সেখানে ঝোলানো কতগুলো জামাকাপড়। একটা কাঠের শেলফ আছে যেখানে রাখা আছে কয়েক জোড়া জুতো। ঘরের দেওয়াল থেকে ঝুলন্ত তাকে রাখা অসংখ্য সোনা, রূপা, ব্রোঞ্জের পদক। রয়েছে ট্রফিও। এটাই ভারতের হয়ে সোনা জেতা কুস্তিগীর বীরেন্দর সিংয়ের 'একলা ঘর'। দিল্লির সদর বাজার মেট্রো স্টেশনের কাছে কুস্তির আখড়ার নিকট এই নিবাসেই জীবন কাটছে ভারতের হয়ে সোনা জয়ী কুস্তিগীর বীরেন্দর সিংয়ের। ভারত ৭০ পেরিয়ে ৭১-এ পা দিল। ইন্ডিয়া ডিজিটাল হচ্ছে। মেক ইন ইন্ডিয়ার স্বপ্ন একটু একটু করে সাকার হচ্ছে, এমনটাই দাবি। দেশ এগিয়ে যাচ্ছে... 'কেবল' জল চুইয়ে পড়বে না এমন একটা পোক্ত ছাঁদ জুটছে না বীরেন্দর সিংয়ের। এটাই ৭১ তম স্বাধীনতার ভারত!
প্রশ্নটা আসতেই পারে, স্বাধীনতার ৭১ তম বসন্তে এক আকশ বীরগাথার কথা শোনার পর হঠাৎ এ কোন বীরেন্দরকে নিয়ে 'শোকগাথা' গাওয়া হচ্ছে?
সাল ২০১৭, তুরস্ক, স্বর্ণপদক জয়
সাল ২০১৬, ইরান, স্বর্ণপদক জয়
সাল ২০১৩, বুলগেরিয়া, স্বর্ণপদক জয়
সাল ২০১২, বুলগেরিয়া, ব্রোঞ্জপদক জয়
সাল ২০০৯, তাইওয়ান, ব্রোঞ্জপদক জয়
সাল ২০০৮, আর্মেনিয়া, রূপোর পদক জয়
সাল ২০০৫, অস্ট্রেলিয়া, স্বর্ণপদক জয়
এটাই হল বধির বীরেন্দর সিংয়ের ট্র্যাক রেকর্ড। 'প্রতিবন্ধী' বিভাগে ভারতের হয়ে কোনও অলিম্পিয়ানের এই ইর্ষণীয় ইতিহাস রয়েছে কিনা, তা 'মহাজাগতিক আলোর' মধ্যেও খুঁজে পাওয়া কঠিন! অর্জুন পুরস্কার প্রাপ্ত এই কুস্তিগীর বিশ্বসভায় ভারতকে শ্রেষ্ঠ আসন দিয়েছেন বহুবার, অথচ নিজের দেশেই তাঁর 'আসন' অনিশ্চিত! এটাও ৭১ তম স্বাধীনতার ভারত!
"আমি নিজে শুনতে পাইনা। তার মানে এটা কখনই হতে পারে না আমার কথা কেউ কখনও শুনবে না", আত্মবিলাপে এই কথাই বারেবারে আওড়েছেন ৩২ বছরের কুস্তিগীর বীরেন্দর সিং। দিল্লিতে ওকে সবাই চেনে 'গুঙ্গা পালোয়ান' নামেই। জন্ম জলন্ধরে। কখনই স্কুলে যেতে পারেননি। পড়াশোনা শেখানোর জন্য কোনও স্পেশ্যাল এডুকেশন সেন্টারেও তাঁকে পাঠাতে পারেনি তাঁর পরিবার। একটা সময় সিকিউরিটি গার্ডের চাকরিও করেছেন। বন্ধু অজয়ের হাত ধরে পাল্টে গিয়েছে গোটা জীবন। প্রথমে মুক ও বধির স্কুলে পড়াশোনা, তারপর ২০০৫ সালে প্রথম অস্ট্রেলিয়ার প্যারা অলিম্পিকে কুস্তিতে স্বর্নপদক জয়। এরপর আর পিছনে তাকাতে হয়নি বীরেন্দরকে। একের পর এক মাইলফলক নিজের নামে অবিরাম অনবরত গড়ে গিয়েছেন 'গুঙ্গা পেহেলওয়ান'। অথচ, সংখ্যাগরিষ্ঠ ভারত তাঁকে চেনেই না। এই আক্ষেপ বীরেন্দরের নিজের গলাতেও, "দেশের বেশিরভাগ মানুষ আমাকে এখনও চেনেই না। আমি যদি কথা বলতে পারতাম, তাহলে আমার মত খেলাপাগল মানুষের অধিকার নিয়ে কথা বলতাম।" সঙ্গে যুক্ত করেন,"আমি সর্বদা আমার দেশকে জগৎ শ্রেষ্ঠ করার চেষ্টা করেছি, কয়েকবার সফলও হয়েছি। কিন্তু কারও এবিষয়ে কোনও মাথা ব্যাথাই নেই। কেউ দেখুক আর নাই বা দেখুক আমি আমার কাজ করেছি, আগামীতেও করে যাব।"