হিরো থেকে ভিলেন: অধিনায়ক থেকে ফাঁসিকাঠে
হিরো থেকে ভিলেন হওয়ার ঘটনাটা রহস্য-রোমাঞ্চের গল্পে শুনতে দারুণ লাগে। কিন্তু বাস্তবে এমন কোনও ঘটনা শুনলে একটু অন্য রকম লাগে কি?এই প্রতিবেদনটা যেই মানুষের জীবনের কাহিনিটা নিয়ে সেটা শোনার পর আপনার দীর্ঘশ্বাস পড়তেই পারে। আর সেই জীবনকাহিনির ওপর লিখতে গেলে শিরোনাম দিতেই হয় `ফর্ম হিরো টু ভিলেন`। তাঁকে নিয়েই লিখেছেন আমাদের প্রতিনিধি পার্থ প্রতিম চন্দ্র।
পার্থ প্রতিম চন্দ্রের লেখায় এক অদ্ভুত জীবন কাহিনি
১৩ জুলাই, ১৯৩০: প্রথম বিশ্বকাপে দেশের অধিনায়ক। ২৬ ডিসেম্বর, ১৯৪৪: প্রাণদণ্ড হিসাবে গুলি করে মারা হল।
হিরো থেকে ভিলেন হওয়ার ঘটনাটা রহস্য-রোমাঞ্চের গল্পে শুনতে দারুণ লাগে। কিন্তু বাস্তবে এমন কোনও ঘটনা শুনলে একটু অন্য রকম লাগে কি?এই প্রতিবেদনটা যেই মানুষের জীবনের কাহিনিটা নিয়ে সেটা শোনার পর আপনার দীর্ঘশ্বাস পড়তেই পারে। আর সেই জীবনকাহিনির ওপর লিখতে গেলে শিরোনাম দিতেই হয় `ফর্ম হিরো টু ভিলেন`।
অ্যালেক্স ভিলাপ্লেন। এই নামটা কোনওদিন কোনও ফরাসির ভুলে যাওয়ার কথা নয়। কিন্তু সত্যি তাঁকে সবাই ভুলে গেছে। অবশ্য ভোলার কথা নয়। যতই হোক ফরাসিরা তাঁদের যে ফুটবলকে নিয়ে এত গর্ব করে, তার গোড়াপত্তন হয় এই অ্যালেক্সের হাত ধরে। তিনিই বিশ্বকাপে প্রথমবার ফ্রান্সকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। ১৯৩০ ফুটবল বিশ্বকাপে ফ্রান্স দল যেদিন প্রথমবার মাঠে নেমেছিল সেদিন সকালে সব ফরাসি সংবাদপত্রে লেখা হয়েছিল, `আলেক্স ইজ আওয়ার হিরো।` সেই নায়ককেই ১৪ বছর পর প্রাণদণ্ড দেয় ফরাসি সরকার। হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছেন। বিশ্বকাপে নিজেদের প্রথম অধিনায়ক অ্যালেক্সকে গুলি করে মেরে বিশ্বাসঘাতকতার শাস্তি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু কেন?
আলজেরিয়ায় জন্ম অ্যালেক্স ছিলেন মজার চরিত্রের। মাঠের বাইরে তো বটেই, মাঠের মধ্যেও সব সময় মজা করতে ভালবাসতেন। অধিনায়ক হয়ে জেতার থেকেও দলের সতীর্থদের বলতেন, " বন্ধু খেলাটা জেতার জন্য নয়, উপভোগের জন্য"। রেফারিদের দেখে সবাই যখন ভয়ে শিঁটিয়ে, তখন অ্যালেক্স রেফারিদের সঙ্গেই ইয়ার্কিতে মশগুল। বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচ। মেক্সিকোর বিরুদ্ধে অ্যালেক্সের দল ফ্রান্স তখন ৪-১ গোলে এগিয়ে, অ্যালেক্সকে পিছন থেকে লাথি মারলেন এক মেক্সিকান ফুটবলার। রেফারি দেখেও না দেখার ভান করলেন। অ্যালেক্স ওমনি রেফারির কাছে গিয়ে চোখ মারলেন। রেফারি বেচারা গেলেন ঘাবড়ে। অ্যালেক্স বললেন, ল্যাঙ মারা তো আর দেখতে পাও না, চোখ মারাটা দেখে যদি তোমার চোখ খোলে! এভাবেই সবার মন জুড়ে থাকতেন তিনি। কিন্তু এটা অ্যালেক্সের জীবনের একটা প্রাণচঞ্চল দিক। বাকিটায় আছে শুধুই অন্ধকার। বিশৃঙ্খলতার চূড়ান্ত জায়গায় চলে গিয়ে ফুটবলটা ছাড়তে বাধ্য হলেন তিনি। শুরু হল রেসের মাঠের নেশা। ঘোড়াকে জোরে আরও জোরে ছোটানোর নেশাটা চেপে ধরল তাঁকে।
কিন্তু সেখানেও বাধ সাধল তাঁর চরিত্রের অন্ধকার দিক। গড়াপেটার দায়ে আজীবন নির্বাসিত হলেন রেসের মাঠ থেকে। এরপর অ্যালেক্স খেলার মাঠ ছেড়ে যোগ দিলেন আন্তর্জাতিক মাদকচক্রে। সেখানে তাঁর মধ্যে চেপে বসল অগাধ টাকা কামানোর নেশা। ফরাসি সরকারের কানে গেল সে কথা, সাবধানও করা হল তাঁকে। কিন্তু এর মধ্যে উত্তাল হল বিশ্ব। হিটলার দাঁত নখ বের করে বেরোলেন বিশ্বজয় করতে। ঢেউ এসে পড়ল ফ্রান্সেও। হিটলারের চোখ গিয়ে পড়ল ফ্রান্সের ওপর। সেই সুযোগটা নিলেন অ্যালেক্স। অর্থের লোভে হিটলারের নাত্সি বাহিনীর হয়ে গুপ্তচরবৃত্তি শুরু করলেন। ব্রিগেড নর্ড আফ্রিকান নামে হিটলারের পৃষ্ঠপোষকোতা করা একটি দলের প্রধান হলেন বিশ্বকাপে ফরাসি ফুটবল দলের প্রাক্তন এই অধিনায়ক। অবশ্য অ্যালেক্সের মধ্যে তখন ফুটবলারের সব সত্ত্বা মরে গেছে। আলেক্সের গুন্ডা দল হিটলারের কাজ সহজ করার জন্য দেশের নিরীহ লোককে ধরে ধরে মারতে শুরু করল। হিটলারের থেকে অর্থ পেতে থাকলেন আর দেশের লোকেদের অত্যাচার, খুন করতে থাকলেন। এরপর যুদ্ধ থামল। হিটলার ইতিহাসের পাতায় ঘৃণ্য চরিত্র হিসাবে চলে গেলেন। অ্যালেক্সও তাঁর পুরো দল সমেত ধরা পড়ল। তাঁর দোষের ফিরিস্তি বের করতে গিয়ে দেখা গেল এতটাই লম্বা যে তাঁকে দেশের সবচেয়ে ঘৃণ্য বিশ্বাসঘাতক অ্যাখা দেওয়া হল। প্রাণদণ্ড হিসাবে গুলি করে মারা হল। ব্যস! এতটুকুই। এমন একজন মানুষ যার জীবন কাহিনি হলিউডের সিনেমার চিত্রনাট্যের চেয়েও অনেক বেশী নাটকীয়, তাঁকে নিয়ে আর কিছু জানা যায়নি।