অনেক লড়াই, কটাক্ষের পর কোন বিশেষ স্বীকৃতি পেলেন রেফারি কণিকা বর্মণ? জেনে নিন
শুধু রেফারিং নয়। ফুটবলার হিসেবেও ভারতের প্রতিনিধিত্ব করছেন কণিকা। ২০১১ সালের শেষে শিলিগুড়িতে আয়োজিত উত্তরবঙ্গ উৎসবে এক ফুটবল প্রতিযোগিতায় নিজের দলের জয় নিশ্চিত করেন কণিকা।
সব্যসাচী বাগচী
মুকুটে যোগ হল নতুন পালক। এ বার এএফসি (AFC) এলিট মহিলা রেফারি ও সহকারী রেফারিদের প্যানেলে জায়গা করে নিলেন কণিকা বর্মণ (Kanika Barman)। মঙ্গলবার এই সুখবর পেয়েছেন বঙ্গ তনয়া। এর আগে ২০২০ সালে ফিফা (FIFA) এলিট প্যানেলেও জায়গা পেয়েছিলেন তিনি।
সেই বিষয়ে জি ২৪ ঘণ্টাকে কণিকা বলেন, "এর আগে ফিফা প্যানেলে জায়গা করে নিয়েছিলাম। এ বার সুযোগ পেলাম এএফসি প্যানেলে। এটা আমার কাছে অনেক বড় সুযোগ।" কিন্তু ফিফা-র চেয়ে তিনি এএফসি-কে কেন এগিয়ে রাখলেন? কণিকার প্রতিক্রিয়া, "আসলে ফিফা প্যানেলে জায়গা পেলেও বড় প্রতিযোগিতার ম্যাচ পরিচালনা করার সুযোগ ছিল না। তবে এএফসি প্যানেলে আসার জন্য এ বার থেকে ম্যাচ পরিচালনা করার সুযোগ পাব। তাই এটা আমার কাছে অনেক বড় প্রাপ্তি। আসলে এএফসি প্যানেলে এশিয়ার শীর্ষে থাকা রেফারি ও সহকারি রেফারিরা থাকেন। ফলে আগামী দিনে যদি আমি ভাল পারফরম্যান্স করতে পারি, তাহলে বিশ্বকাপে প্রধান রেফারি কিংবা সহকারী রেফারির ভূমিকা পালন করতে পারি।"
প্রত্যেক মানুষের জীবনে সমস্যা আছে। তবে সবাই তো আর কণিকা হতে পারেন না। ওঁর মেয়ে সবে ছয় বছরে পা দিয়েছে। নাম কৃত্তিকা। যদিও ফুটফুটে মেয়েটা গত কয়েক বছর ধরে মায়ের কোল ছাড়া। এরমধ্যে আবার যোগ হয়েছিল করোনা ভাইরাসের থাবা। তাই সেই সময় ওঁর মেয়ের সাথে যোগাযোগের মাধ্যম ছিল শুধুই ভিডিও কল! এটা প্রথম যন্ত্রণা হলে, দ্বিতীয়টা ছিল আরও যন্ত্রণার। ফিফা প্যানেলভুক্ত রেফারি হওয়ার পরেও, তাঁকে কলকাতা লিগের তৃতীয় ও চতুর্থ ডিভিশনের ম্যাচ পরিচালনা করতে হচ্ছিল। সৌজন্যে ‘সিআরএ পলিটিক্স’। তবে ডাকাবুকো কণিকা কিন্তু এই দুটো যন্ত্রণা নিয়েই এগিয়ে গিয়েছেন। পেরিয়ে গিয়েছেন একটা করে ধাপ।
মেয়ের প্রসঙ্গ উঠতেই বললেন, "মেয়েকে ছেড়ে থাকা যে কোনও মায়ের পক্ষেই খুব কষ্টের। কিন্তু আমি একটা স্বপ্নের পিছনে দৌড়াচ্ছি। তাই ওকে বাপের বাড়িতে রাখা ছাড়া আর কোনও উপায় নেই। সবাই তো আর জীবনে সবকিছু পায় না।" কেরিয়ারের শুরু থেকেই একাধিক উত্থান-পতন দেখেছেন। তবুও সব বাধা অতিক্রম করে আগেই ফিফা’র কাছ থেকে স্বীকৃতি পেয়েছিলেন এই বঙ্গতনয়া। স্বাভাবিকভাবেই ফেডারেশন কর্তারাও তাঁকে পছন্দ করেন। তবুও সিআরএ থেকে যোগ্য সম্মান পেলেন কোথায়? রেফারি টেন্টের কর্তাদের দিকে সরাসরি অভিযোগ না করলেও বলে দিলেন, "কোনও ম্যাচ ছোট নয়। তবে একটা উচ্চতায় যাওয়ার পর ভেবেছিলাম সিআরএ থেকে বাড়তি সম্মান পাব। কিন্তু সেটা পেলাম না। তাই বেশি কিছু না ভেবে নিজের কাজটা করে যাই। পারফরম্যান্স ভাল করলে একদিন আবার প্রিমিয়ার ডিভিশনের ম্যাচ পরিচালনা করার সুযোগ আসবেই।"
কলকাতা লিগ থেকেই ওঁর যাত্রা শুরু। বর্তমানে ভারতের দুজন মহিলা ফিফা প্যানেলভুক্ত রেফারির একজন, অন্যজন মণিপুরের রঞ্জিতা দেবী। শিলিগুড়ির শালুগাড়া এলাকা থেকে নিজের যোগ্যতায় পৌঁছে গিয়েছেন বিশ্ব ফুটবলের দরবারে।
অথচ শুরুতে আদপেই বোঝা যায়নি যে ফুটবলের রেফারি হিসেবেই ইতিহাস লিখতে চলেছেন কণিকা। শালুগাড়ার এক সাধারণ পরিবারে জন্ম, ৯ নভেম্বর, ১৯৯৩ সালে। সাত বছর বয়স থেকে অ্যাথলেটিক্সের দিকে ঝোঁক। ভাই দীপু খেলত ফুটবল। তাঁর অধরা স্বপ্ন সফল করলেন তাঁর পুত্র ও কন্যা। তবে অ্যাথলেটিক্সে বেশ কিছু বছর কাটানোর পর কণিকা বুঝলেন, এখানে কিছু হবে না। তাই বুদ্ধিমতী কণিকা ১৬ বছর বয়সেই মনোনিবেশ করলেন ফুটবলে। নতুন কেরিয়ার গড়ার লক্ষ্যে। ফলও মিলেছিল হাতেনাতে। সহজাত প্রতিভা এবং অ্যাথলেটিক্সের প্রশিক্ষণ তাঁকে দ্রুত এগিয়ে যেতে সাহায্য করল। অচিরেই জুটে গেল বারাসাত যুবক সংঘের মহিলা দলের হয়ে খেলার সুযোগ। এরপরে তালিকায় যুক্ত হল আরও একাধিক ক্লাব। দ্রুত ছড়িয়ে গেল তাঁর দক্ষতার খ্যাতি।
শুধু রেফারিং নয়। ফুটবলার হিসেবেও ভারতের প্রতিনিধিত্ব করছেন কণিকা। ২০১১ সালের শেষে শিলিগুড়িতে আয়োজিত উত্তরবঙ্গ উৎসবে এক ফুটবল প্রতিযোগিতায় নিজের দলের জয় নিশ্চিত করেন কণিকা। মনোনীত হন ‘প্লেয়ার অফ দ্য টুর্নামেন্ট’ হিসেবে। সেই সময়েই শিলিগুড়ির কাঞ্চনজঙ্ঘা স্টেডিয়ামে চলছিল আই-লীগের দ্বিতীয় ডিভিশনের খেলা। এবং এখানেই তিনি দৃষ্টি আকর্ষণ করেন পশ্চিমবঙ্গ ফুটবল রেফারিজ অ্যাসোসিয়েশনের সেক্রেটারি উদয়ন হালদারের। কণিকার প্রতি তাঁর একটাই প্রশ্ন ছিল। “রেফারি হবি?”
সেই শুরু। রেফারি ট্রায়ালের জন্য নির্বাচিত হলেন কণিকা। এ দিকে ২০১২ সালে যোগ দিলেন কলকাতা পুলিসে। পাশাপাশি অবশ্য তখনও চলতে থাকল কলকাতার আশেপাশে বিভিন্ন লিগে ফুটবল খেলা। এরপর শুরু হল নিয়মিত ম্যাচ পরিচালনার কাজ। খেলাতে লাগলেন একের পর এক ম্যাচ। পুরুষ এবং মহিলা, উভয়েরই। মাঝে শারীরিক অসুস্থতার কারণে বছর দুয়েকের বিরতি নিতে হয়, যা কাটিয়ে আবার ময়দানে নেমে পড়েছিলেন কণিকা। তবে সেটা নিয়েও ওঁকে অনেক কটাক্ষ হজম করতে হয়েছিল।
আগেই লিখেছি যে ওঁর যাত্রাপথ একেবারেই মসৃণ ছিল না। “শুরুরদিকে অনেকেই ঠাট্টা করত। মুখের ওপরেই বলত, এ তো একটা বাচ্চা মেয়ে, এ রেফারি? পারবে নাকি?" হাসতে হাসতেই বলেন কণিকা। “পরে ধীরে ধীরে সবাই বুঝতে শুরু করল, যে না, এ পারবে।" সেই ‘পারা’র মধ্যেই অবশ্য লুকিয়ে থাকে অসংখ্য চ্যালেঞ্জ। আচ্ছা ছেলেদের ম্যাচ পরিচালনা করা তো মারাত্মক চাপের ব্যাপার। যদি মাথা গরম করে কিছু করে ফেলে?কণিকা আবার হাসিমুখে বললেন, "এই পেশায় মেয়ে হওয়ার অসুবিধে যেমন আছে, তেমনি সুবিধেও তো আছে। আমি মেয়ে বলেই চট করে কোনও ফুটবলার গায়ে হাত তুলতে পারবে না। ধাক্কাধাক্কি করতে পারবে না। একবার ইস্টবেঙ্গল বনাম এরিয়ান কলকাতা লিগের ম্যাচে জেমস মোগাকে হলুদ কার্ড দেখিয়েছিলাম। ইস্টবেঙ্গল মাঠে খেলা হলেও ভয় পাইনি। জেমস মোগা আমার দিকে তেড়ে এলেও, নিজের সিদ্ধান্তে অটল ছিলাম।"
সাউথ এশিয়ান ফুটবল গেমসে ইতিমধ্যেই রেফারিং করেছেন কণিকা। ২০২০ সালের জানুয়ারি মাসেই পেয়েছিলেন ফিফার স্বীকৃতি। এ বার এএফসিও তাঁকে সম্মান জানাল। তাই এখানেই থামতে রাজি নন। মুখে বাঁশি নিয়ে ৯০ মিনিটের যুদ্ধে নিজের জাত চেনাতে চান।
আরও পড়ুন: East Bengal: অবশেষে স্বস্তি, দীর্ঘমেয়াদী চুক্তির পথে লাল-হলুদ, ইমামি
আরও পড়ুন: Diego Maradona: কত দামে নিলামে উঠল ১৯৮৬ বিশ্বকাপ ফাইনালের জার্সি? জেনে নিন