আহ্লাদে আটখানা হওয়া বড্ড আবোল তাবোল মনে হচ্ছে
স্বরূপ দত্ত
সুকুমার রায় কি খুব ক্রিকেট খেলা জানতেন? নাকি কামসূত্র পড়তেন! জানা নেই। তবে, এই দুটো সন্দেহ কেন প্রকাশ পেল, বলছি। এক, সুকুমার রায়ের ওই 'আহ্লাদে আটখানা' ছবিটা দেখেই জীবনে প্রথম কল্পনাশক্তি এসেছিল নিজের ক্ষেত্রে। শরীরটাকে ওভাবে ৮ টুকরো হতে দেখে কী মজাই যে পেতাম! তাই সুযোগ পেলেই আবোল তাবোলের পাতায় ওই ছবিটা দেখতাম। ৮ টুকরো হওয়ার পরও একটা ছেলে কীভাবে হাসি হাসি মুখ করে দাঁড়িয়ে রয়েছে, ভেবে নিজেরও আহ্লাদে আটখানা হওয়া হতো।
দুই, কামসূত্রে বলা হয়েছে, প্রত্যেক আদরের আটটি বিভাগ হয়। এই দুটো থেকে নিজের সিদ্ধান্ত এমন- ভালো জিনিস টুকরো হলে, ৮ টুকরোই হয়। ওটা সীমারেখা। যা ৮ অতিক্রম করে, তাতে আর ভালো কিছু থাকে না। বেশি পেলে 'নষ্ট নম্বর!'
কেন এসব আগডুম বাগডুম বলে শুরু করা। কারণ, ওই আট। মানে, ৮। আটের পাল্লা থেকে বেরোনোর কোনও উপায় কি নেই! না হলে, কেন চেন্নাই সুপার কিংসের গলা কাটা গেল, ৮ টি আইপিএল হওয়ার পরেই! উত্তর পাচ্ছি না। ম্যাচ ফিক্সিং? বেশ হয়েছে? ধোনি যেমন, তেমন সাজা পেয়েছে, ও খুব বদমাশ? চেন্নাই বড্ড বার বেড়েছিল? শ্রীনিবাসন লোকটাই খুব খারাপ। তাই বেশ হয়েছে? এ উত্তরগুলো আপনাদের। আরও কিছু উত্তর এবং যুক্তি আপনাদের রয়েছে। ঠিক। খারাপ। চেন্নাই সুপার কিংসের সব খারাপ। যাকে দেখতে নারী, তার চলন বাঁকার মতো সব খারাপ।
প্রশ্ন এখানেই। আপনি চেন্নাইকে পছন্দ করেন না। চেন্নাই মানে এক্ষেত্রে অবশ্যই চেন্নাই সুপার কিংস। না হলে খুব বেশি করে তামিলনাড়ুর বিরুদ্ধে গলাও বা ফাটাবেন কীভাবে! ওই রাজ্যের চিকিত্সাতেই তো ১/১০ বাঙালি সুস্থ রয়েছে (কথার কথা)। হ্যাঁ, তা যা বলছিলাম। চেন্নাই সুপার কিংস নামের ওই হলুদ রঙের দলটা আপনার চোখের বালি। তাতে সেই মানুষটার কী, যে এক ফোঁটা তামিল না জেনেও গত ৮ বছর ধরে চেন্নাই সুপার কিংসের একটা ম্যাচও মিস করেনি। চেন্নাইতে গিয়ে দেখেনি হয়তো। কিন্তু অফিসের কাজ ফেলে, বাড়ির বকা খেয়ে, টিউশনিতে কামাই করে, প্রেমিকার অভিমান সয়ে, ৮ বছরে যে মানুষটা ৬৪ কলার একটা ফোঁটাও মিস করেনি, সেই মানুষটার বুকের ব্যথা আজ একটু বুঝতে পারছেন? হচ্ছেন সহমর্মী?
আপনার পাড়াতেই তো, একটা কী দুটো বাড়ির পরের বাড়ির ছেলেটা ধোনি বলতে পাগল। কত তর্ক করেছেন হয়তো পাড়ার নান্টুদার চায়ের দোকানে অথবা রবিদার মোবাইল রিচার্জের দোকানে। সে শুধু বলত, চেন্নাই, চেন্নাই, আর ধোনি, ধোনি। অবশ্য কোনও কোনও ম্যাচের পর স্যার জাদেজা, রায়না, অশ্বিন আর ডোয়েন ব্রাভো অবশ্যই আসতো। আজ সেই ছেলেটার মুখে কোনও সার নেই না? কেমন যেন লুকিয়ে রয়েছে মনে হচ্ছে না?
খারাপ লাগাটা শুরু হয়ে গিয়েছে, ওটা বুঝতে পেরেই। কেন এমনটা হবে। এই টি-২০ জিনিসটা একবারে সুঁচ হয়ে ঢুকে ফাল করে গেল! ২০০৭ এ আমাদের বিসিসিআই কর্তারা কত কথা বলতেন। ধুর ওটা আবার ক্রিকেট নাকি! ইস, ও আবার কেউ খেলে! না, বাবা আমরা ওসব খেলব টেলব না। বিশ্বকাপ হবে! হোক গে যাক। আমরা দলও পাঠাবো না। শেষে কিছুতেই না পেরে বড় চুলের ছোট্ট ছেলে ধোনির হাতে ১০-১২ টা ছেলে দিয়ে বিসিসিআই কর্তারা বলে দিল, যাও কদিন ঘুরে টুরে চলে এসো। সঙ্গে মাস্টারমশাইয়ের মতো কোথাকার এক বুড়ো লালচাঁদ রাজপুত নামের কোচ।
ও মা। তারপর যে ওই বড় চুলের বাহারি ছেলেটা এ খেলাটা এমন শিখে নেবে কে ভেবেছিল! কোথাকার ইউসুফ পাঠান, কোথাকার যোগিন্দর শর্মা, রবীন উথাপ্পাদের নিয়ে সে কিনা বিশ্বকাপটাই জিতে এলো! বিসিসিআই কর্তারা আর যায় কোথায়! ললিত মোদি তখন এদের দলেরই লোক ছিলেন। আসলে কর্তাদের তো ইকুয়েশন বোঝা যায় না। আজ কে কার ভালো বলবে। কাল কে কার খারাপ ধরবে। এটা আগাম তো দূর, পরে বসে বিচার করতে গেলেও আপনাকে পিথাগোরাসের থেকে ভালো গণিতজ্ঞ হতে হবে। এবং সেই পরীক্ষায় ফেল করা স্বাভাবিক। তাই ললিত মোদি আর বিসিসিআই কর্তারা শুরু করে দিলেন আইপিএল।
আর আবার সেই চক্কর আটের! শুরু হল ২০০৮ এ। খেলবে কিনা সেই ৮ টিই দল! আর সেখানে কোথাকার রাঁচির ছেলে হয়ে গেলেন চেন্নাইয়ের আইকন ক্রিকেটার! প্রথমবার তিরে গিয়েও তরী ডুবেছিল। কিন্তু আট বারের আইপিএলের পর দেখা গেল, সবথেকে সফল দল ওটাই। চেন্নাই। দুবার চ্যাম্পিয়ন। চারবার রানার্স! এই তথ্যগুলো আদৌ প্রমাণ করে না, চেন্নাই সুপার কিংস দলটা ঠিক কতটা দল হয়ে উঠেছিল। দুদিনের ক্রিকেট দেখা মানুষও দিব্যি বলে দিতে পারত গড়গড়িয়ে ১১ টা নাম, ম্যাককালাম, মুরলী বিজয়, রায়না, ধোনি, জাদেজা, অশ্বিন, মর্কেল, একের পর এক।
হলুদ রঙের জার্সি। বুকে আঁকা সিংহ। আর ওই হুইসল পোড়ু! সামনে ধোনি। দুপাশে রায়না আর জাদেজা। দুই বিদেশি ব্রাভো আর মর্কেল। আর মাঠের পিছনে স্টিফেন ফ্লেমিং। জেতার সূত্র কী? আগের বাক্যগুলো একসঙ্গে জুড়ে দিলে সাফল্য পাওয়া যায়। সেটা শেষ হয়ে গিয়েছিল লোধা কমিশনের রিপোর্টের পরই। জানা গিয়েছিল চেন্নাই, রাজস্থান দু বছরের জন্য নির্বাসিত আইপিএল থেকে। মেনেও নিতে হয়েছিল। কিন্তু আজ যখন ধোনি, রায়না, অশ্বিন, জাদেজা, ব্রাভো, ম্যাককালামরা সব পুনে বা রাজকোটের হয়ে গেল, হলফ করে বলতে পারি, এই শহরের, এই রাজ্যের, এই দেশের অনেক ক্রিকেটপ্রেমীর বুকটা ফেটে ৮ টুকরো হয়ে গিয়েছে। (আহ্লাদে নয়, অসহ্য যন্ত্রণায়)
ধোনি। সেই ২০০৩ সাল থেকে মানুষটা ঢুকে পড়েছিলেন সোয়া ১০০ কোটির দেশের মানুষের মনে। সেই মানুষটাকে চোখ বন্ধ করে ছবি দেখতে গেলে, কী কী ভাসে আজও? বড় চুল। দুটো আলাদা দেখতে ট্রফি হাতে সবার মাঝে দাঁড়িয়ে। এমন এক 'ঈশ্বর', যার বাহন বাইক। আর তিন রঙের পোশাকে তাঁকে দেখা যায়। নীল, সাদা এবং হলুদ। আজ ১৫ ডিসেম্বরের পর তো সেই ফ্যানটাসিটাই শেষ হয়ে গেল। ধোনির গায়ে উঠবে, অন্য রঙেরও জার্সি! মেনে না নিলে, টিকে থাকবেন কীভাবে! তাই মেনে তো শেষ পর্যন্ত আপনি নেবেনই। কিন্তু মানবে তো আসলে আপনার ঘাড়টাই। মন কি আর মানবে? মন কি আর মানবে যখন পরের আইপিএলে এক সপ্তাহ খেলা হয়ে যাওয়ার পরও হলুদ রঙা চেন্নাইকে দেখতে পাবেন না? মনে হয় না পারবেন বলে, তাও আপনি মিলিয়ে নেবেন।
হলুদ রঙের খেলার মাঠে জয়জয়কার। ফুটবলের ব্রাজিলকে দেখেন না? হলুদ রং সৌভাগ্যের। হলুদ রঙের মানে অনেক কিছু। বুদ্ধি, একতা, সংহতি এবং গৌরব। শেষ যে চারটে শব্দ বললাম, ওগুলো চেন্নাই সুপার কিংসের সঙ্গে যায়। ফিক্সিং করেছে? কে করেছে? তাদের ধরুন, শাস্তি দিন, ঠিক আছে। কিন্তু যাঁরা ক্রিকেট রোম্যান্টিকতায় বাঁচেন চেন্নাইয়ের ফ্যনটাসিতে বাঁচেন, তাঁদেরকে বোঝাবেন কীভাবে? ওই মেয়েটি খারাপ বলে, সবাই মিলে সমাজ থেকে এক ঘরে করে দিলেন। অথবা দূর করে দিলেন। এতে সেই ছেলেটার কী দোষ বলুন তো যে, মেয়েটাকে আজও বড় ভালোবাসে? ওই মেয়েটির চরিত্র খারাপ জেনেও তাঁকেই চোখের সামনে দেখতে চায়। আপনি এটা বুঝতে না পারলে জানবেন এবং দু-চারদিন সময় নিয়ে বুঝবেন, ক্রিকেট নয়, অন্য কোনও খেলাই আপনার বেশি প্রিয় হওয়া উচিত।
ধোনি-রায়না, মাঝে হাইফেন এসে গেল আজ। কেমন লাগল, কী বোঝাবো? পুনে আর রাজকোট নামের দুটো নতুন শিশুর জন্ম হল আইপিএলে। সবাই হাসছে। আনন্দ পাচ্ছে। কিছু মানুষ সত্যিই আজ আনন্দ নয়, কষ্টই পাচ্ছে। কেন? না, নতুন শিশুর জন্ম নিয়ে ভাবার সময় নেই তাঁদের। কারণ, তাঁদের বুকটা ভেঙে যাচ্ছে এই জন্য যে, ৮ বছর ধরে স্নেহ, মমতায় বড় করা বাচ্চা দুটোর আজ অফিসিয়াল মৃত্যু তারিখটা লেখা গেল। কীভাবে? 'আইপিএল ড্রাফটে ধোনিকে নিল পুনে'! এই একটা লাইনেই কি বুকের বাঁ দিকটা চিনচিন করে উঠল না? যদি সত্যিই আপনার না করে থাকে, ভুল বুঝবেন না। এ লেখা আপনার জন্য নয়। সময় নষ্ট করানোর জন্য আন্তরিক দুঃখিত। ভাবছি, সুকুমার রায় কী আবোল তাবোল লিখতেন! না হলে কেউ লেখেন, 'আহ্লাদে আটখানা!' কষ্টেও যে কত মানুষের বুকটা আট খানা হয়!