দুঃস্বপ্নের রাতের দু'বছর পরেও এখনও কালো মেঘে ঢাকা অর্ধেক আকাশ
রায়া
ওয়েব ডেস্ক: দিনটা ছিল রবিবার। দিল্লির হাড় হিম করা শীতের রাতে ঠাণ্ডায় কাঁপতে কাঁপতে প্রায় নগ্ন অবস্থায় রাস্তায় পড়ে ছিল একটি ছেলে আর একটি মেয়ে। অচৈতন্য, মেয়েটির সারা শরীর রক্তে ভেসে যাচ্ছিল। সঙ্গি ছেলেটি ওই রাতে আহত শরীরে প্রায় গোঙাতে গোঙাতে রাজপথ দিয়ে হুস হুস করে বেড়িয়ে যাওয়া গাড়িগুলোর কাছে হাত জোড় করে সাহায্য চাইছিল। যে গুটি কয়েক পথচারী ওই রাতেও রাস্তায় ছিলেন, তাদের কাছে কাকুতি মিনতি করছিল তাঁর বান্ধবীকে যেন একটু হাসপাতালে নিয়ে যেতে সাহায্য করেন তাঁরা। না, টানা ৩ ঘণ্টা ওই অবস্থায় রাস্তায় পড়ে থাকার পরেও ছেলেটির ডাকে থামেনি একটি গাড়িও। সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেননি এক জনও ঘর ফেরতা পথচারী। টহলদারিরত একটা পুলিসের গাড়ি হঠাৎই লক্ষ্য করে দু'জনকে। তাঁদের উদ্ধার করে নিয়ে যাওয়া হয় হাসপাতালে।
তারিখটা ছিল, ১৬ ডিসেম্বর, সালটা ২০১২। আজ থেকে ঠিক দু'বছর আগে। তারপরের ঘটনাটাতো সবারই জানা। দিল্লির চলন্ত বাসে 'নির্ভয়া' ধর্ষণ কাণ্ড, আর তার জেরে রাজধানীতে মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদ। যে প্রতিবাদ স্ফূলিঙ্গের মত ছড়িয়ে পড়েছিল সারা দেশে। সারা দেশ এক সঙ্গে গর্জে উঠেছিল, এক সঙ্গে কেঁদেছিল।
তারপর, গত দু'বছর ধরে যমুনার জল হয়ত আরও কিছুটা কমেছে, কিন্তু বয়ে চলেছে। ওই একটি ঘটনার নৃশংসতা, নির্মমতা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে গেছে রাজধানীর বুকে মেয়েদের নিরাপত্তাটার আসল চেহারাটা। আসলে বোধহয় দেখিয়ে দিয়েছিল সারা দেশেই প্রতিদিন, প্রতিমুহূর্ত কতটা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে এ দেশের অর্ধেক আকাশ। প্রশ্ন উঠেছিল যদি রাজধানীতেই অবস্থাটা এরকম হয়, তাহলে দেশের অন্য প্রান্তগুলির হাল ঠিক কতটা খারাপ।
দেশজোড়া প্রতিবাদ আন্দোলনের জন্য বদলেছে আইন। বদলেছে যৌননির্যাতন, ধর্ষণের সংজ্ঞা। বেড়েছে ফাস্টট্র্যাক কোর্ট, হেল্পলাইনের সংখ্যা। কিন্তু, আসলে বদলেছে কি পরিস্থিতি? সত্যিই কি রাজধানী তথা সারা দেশে একটুও বদলেছে মেয়েদের অবস্থা? বেড়েছে তাদের নিরাপত্তা? মেয়েদের সামাজিক অবস্থান সম্পর্কে একটুও কি বদলেছে সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি?
বাস্তব কিন্তু অন্য কথা বলছে।
দিল্লির মুনরিকার সেই বাস স্ট্যান্ডে গত কয়েকদিন ধরে রাত ভোর চলছে পুলিসের নাইট প্যাট্রলিং। কেন হঠাৎ এত নিরাপত্তার কড়াকড়ি ওই একটি বাস স্ট্যান্ড জুড়ে?
এই বাসস্ট্যান্ড থেকেই তো দুঃস্বপ্নের সেই রাতে বন্ধুর সঙ্গে সেই বাসে সওয়ার হয়েছিল বছর ২৩-এর প্যারামেডিক্যাল ছাত্রী। ওই বাস স্ট্যান্ড থেকে নিয়মিত বাসে যাতায়াত করেন এক যুবতীর মতে পুলিসের হয়ত মনে পড়ে গেছে 'নির্ভয়া ধর্ষণ' কাণ্ডের 'বার্ষিকীর' কথা। তাই হয়ত অতি তৎপর দিল্লি পুলিস। চিরকালই ভারতে ধুমাধাম করে 'দিবস গুলি পালিত হয়'। আর 'শপথগুলি'...তারতো পাকা ঠিকানা ডাস্টবিন।
সমাজের মেয়েদের অবস্থান সম্পর্কে মানসিকতা পরিবর্তন নিয়ে কোনও সরকারই কোনওদিনও এদেশে তৃণমূলস্তর থেকে কোনও চেষ্টাই করেনি। উপরে উপরে শুধু নিয়ে আসা হয়েছে কিছু আইন। যার যথাযথ প্রণয়ন সম্পর্কে ধোঁয়াশা প্রশাসন স্তরেই।
দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনতো দূরের কথা, নির্ভয়া কাণ্ডের পর দিল্লির মোড়ে মোড়ে, অলিতে গলিতে আলো বসাবার আশ্বাস দিয়েছিল প্রশাসন। আশ্বাস ছিল যথাযথ পুলিসি প্রহরার। কিন্তু, ওই প্রথা মাফিক এখনও সেই আশ্বাসের আর ডিমের খোলস ভেঙে বের হয়ে আসা হয়নি।
হিন্দুস্তান টাইমসে প্রকাশিত একটি সমীক্ষা অনুযায়ী, দিল্লির ২,৫৫৭ জনের মধ্যে ৯০% মহিলা জানিয়েছেন রাজধানীতে বিন্দুমাত্র নিরাপত্তার উন্নতি তাঁদের চোখে পড়েনি। ৮৬% মহিলা অন্ধকারে বাড়ির বাইরে বেরতে এখনও ভয় পান।
পুলিস ও সরকার অবশ্য দাবি করছে মহিলাদের নিরাপত্তা বাড়াতে বহু পদক্ষেপ নিয়েছেন তারা। কিন্তু তার সঙ্গে এটাও স্বীকার করে নিয়েছেন, মেয়েদের উপর যৌন বা যেকোনও ধরণের অত্যাচারের শিকর সমাজের এত গভীরে বিস্তৃত, মাত্র দু'বছরে তার আমূল পরিবর্তন সম্ভব নয়।
শুধু ধর্ষণ নয়, প্রতিনিয়ত ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স, পাচার, অনান্য যৌন নির্যাতন, শারীরিক নিগ্রহ, বাল্য বিবাহ, অ্যাসিড অ্যাটাকের শিকার হচ্ছেন ভারতীয় মেয়েরা। বহুকাল জুড়ে এদেশের সমাজের পিতৃতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গী জন্ম থেকেই শিখিয়ে আসছে মেয়েরা আসলে পুরুষদের থেকে নীচু শ্রেণীর মানুষ। মানুষ নয়, আজও এদেশে একজন মেয়ের প্রথম পরিচয় তিনি কারোর 'মা', 'বোন', 'স্ত্রী' বা 'কন্যা'। এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজ আজও মানুষ হিসাবে মেয়েদের আলাদা অস্তিত্ব মেনে নেয়নি।
রাজধানীতেই সারা দেশের সব শহরগুলির মধ্যে ধর্ষণের সংখ্যা সর্বাধিক। সারা পৃথিবীতে মেয়েদের জন্য দ্বিতীয় অনিরাপদ শহর দিল্লি। প্রতিদিন পুলিসের খাতায় অন্তত ৪০টি করে নারী নির্যাতনের ঘটনা নথিভুক্ত হয়। দিল্লির উবের-এর ক্যাবে ধর্ষণের ঘটনা সামনে আসার পরে প্রশাসন আর উবের কর্তৃপক্ষ পরস্পরকে দোষারোপে ব্যস্ত থাকলেও আসলে আবার সামনে চলে এসেছে রাজধানীর মহিলাদের নিরাপত্তার কঙ্কালসার চেহারাটা।
এ কথা ঠিক, আগের থেকে অনেক বেশি সংখ্যক মহিলা নিজেদের উপর হওয়া অত্যাচার সম্পর্কে এখন অনেক বেশি সোচ্চার হয়েছেন। কিন্তু, বাস্তব পরিস্থিতির তুলনায় যে সংখ্যাটা নেহাতই নগন্য।
না, তবে সমাজ অতটাও স্থবির বোধহয় আর নেই। সেই দিন রাতে সব অত্যাচার সহ্য করে নিজের বান্ধবীর পাশে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত থেকে একটা ছেলে বুঝিয়ে দিয়েছিল খুব ধীর গতিতে হলেও বদলাচ্ছে সমাজ, বদলাচ্ছে মানসিকতা। শুধু মহিলারাই নয়, তাদের পাশে সমানুধিকারের লড়াইয়ে এগিয়ে আসছেন বহু পুরুষও। লিঙ্গ বৈষম্যের বিরুদ্ধে সুর চড়াচ্ছেন তারাও। বোঝাচ্ছেন লড়াইটা কোনও বিশেষ লিঙ্গের নয়, লড়াইটা মানুষের।
যদিও, সেই সংখ্যাটা কম, তাও আমরাতো এই 'আকালেও স্বপ্ন দেখি'। আশা রাখি কোনও এক ১৬ ডিসেম্বর আসবে যেদিন দিন রাতের বিভেদ ঘুচিয়ে নিজের স্বাধীনতার আনন্দে এদেশের প্রতিটি রাস্তায়, প্রতিটি গলিতে নিরাপদে ঘুরে বেড়াবেন এদেশের মহিলারা। আশা রাখি 'মা', 'বোন', 'স্ত্রী' বা 'কন্যা' নয় মানুষ পরিচয়ে নিঃশ্বাস নেবে আকাশের অর্ধেকটা।