মৃত্যুঞ্জয়ী সুভাষচন্দ্র: ১২৩তম জন্মদিনেও তাঁর মৃত্যু নিয়ে দ্বিধাবিভক্ত দেশবাসী
অন্তর্ধান না মৃত্যু— এই প্রশ্নের উত্তর আজও মেলেনি সঠিক ভাবে। তাই নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু আজও লক্ষ লক্ষ ভারতীয়দের কাছে ‘মৃত্যুঞ্জয়ী’, অক্ষয়ী এক বীর সংগ্রামী।
নিজস্ব প্রতিবেদন: আজ ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে সবচেয়ে চর্চিত, হয়তো সবচেয়ে বিতর্কিত নাম সুভাষচন্দ্র বসু। আজাদ হিন্দ ফৌজের ‘নেতাজি’।
১৮৯৭ খ্রিষ্টাব্দের ২৩ জানুয়ারি, অর্থাৎ আজকের দিনেই ওড়িশার কটকে জন্মগ্রহণ করেন সুভাষচন্দ্র বসু। প্রবাসী বাঙালি, বিশিষ্ট আইনজীবী জানকীনাথ বসু ও প্রভাবতী দেবীর নবম সন্তান সুভাষ। ছাত্র হিসেবে অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন তিনি। র্যাভেন ’শ স্কুলে তিনি শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলেন বেনী মাধব দাসের মতো কীর্তিমান শিক্ষককে। স্কুল জীবনেই ক্ষুদিরাম বসুর আত্মত্যাগ তাঁকে অনুপ্রানিত করেছিল। মায়ের কাছে শোনা ভারতের রূপকথার গল্প, বাড়িতে বাবার কাছে শোনা সাহিত্য, সংস্কৃতি, দর্শন তাঁকে এ দেশের চেতনা ও মূল্যবোধের প্রতি আকৃষ্ঠ হন সুভাষ।
পিছনের সারিতে একেবারে ডানদিকে।
১৯১৩ সালে তিনি কলকাতার প্রেসিডেন্সী কলেজে ভর্তি হন তিনি। প্রেসিডেন্সি কলেজের ইংরেজ অধ্যক্ষের ভারতীয় সংস্কৃতি-বিরোধা মন্তব্যে সরাসরি প্রতিবাদ করে কলেজ কর্তৃপক্ষের বিরাগভাজর হন তিনি। বহিষ্কৃত হলেন প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে। ভর্তি হলেন স্কটিশ চার্চ কলেজে। ততদিনে বাংলায় ব্রিটিশ বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম মুখ হয়ে উঠেছেন সুভাষ। ১৯১৮ সালে স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে বিএ পাশ করেন তিনি। ১৯১৯ সালে উচ্চ শিক্ষার পাঠ নিতে ইংল্যান্ডে চলে যান তিনি। সেখানে পৌঁছে তিনি বুঝতে পারলেন ভারতে ব্রিটিশ শাসনের বর্বরতা সম্পর্কে সেখানকার সাধারণ মানুষ খুব কমই জানেন।
১৯২১ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি তিনি দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশকে চিঠি লিখে জানান যে, তিনি ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস (আইসিএস) পরীক্ষায় চতুর্থ হয়েছেন। তবে তিনি ব্রিটিশ সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মী হতে চান না। অর্থাৎ, সরকারি চাকরিতে তিনি যোগ দিচ্ছেন না। দেশে ফিরে তিনি ভারতের সাধারণ মানুষের জন্যই কাজ করতে চান। চিত্তরঞ্জন দাশকে লেখা ওই চিঠিতেই কংগ্রেসে যোগ দেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন তরুণ সুভাষ।
১৯২১ সালে কংগ্রেসে যোগ দেওয়ার পরে সুভাষচন্দ্রর প্রথম উল্লেখযোগ্য কর্মসূচী ছিল ‘প্রিন্স অব ওয়েলস’-এর ভারত সফর বয়কট করার আন্দোলন গড়ে তোলা। ‘প্রিন্স অব ওয়েলস’-এর অভ্যর্থনার আসরেই খাদির বস্ত্র বিলি ও বিক্রি করার চেষ্টা করেন সুভাষচন্দ্র ও তাঁর কয়েকজন অনুগামী। আন্দোলন ঠেকাতে তখন কংগ্রেসের নেতা-কর্মীদের গণহারে গ্রেফতার করা হয়। গ্রফতার হন চিত্তরঞ্জন দাশ আর সুভাষচন্দ্রও। এর পর চৌরি-চৌরার ঘটনায় গান্ধীজি তাঁর অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহার করে নেওয়ায় হতাশ সুভাষচন্দ্র নবগঠিত স্বরাজ পার্টিতে সম্পাদক হিসেবে যোগ দেন। ১৯২৭ সালে কংগ্রেসে আবার ফিরে আসেন সুভাষ। ১৯২৮ সালে ‘অল ইন্ডিয়া ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রস’-এর সভাপতি নিযুক্ত হন তিনি।
ব্রিটিশ বিরোধী অসহযোগ আন্দোলনের ক্ষেত্রে গান্ধীজির সঙ্গে বরাবরই মত পার্থক্য ছিল সুভাষ আর ভিত্তালভাই প্যাটেলের। গান্ধীজি যেখানে অহিংস আন্দোলনের রাস্তা বেছে নেয়ার কথা বলছিলেন, সেখানে সুভাষের দর্শন বা মত ছিল, অস্ত্রের জবাব অস্ত্রেই দিতে হবে। গান্ধীজির সঙ্গে মত বিরোধের জেরে দু’বারের কংগ্রেস সভাপতি সুভাষচন্দ্র দলত্যাগ করে নতুন দল গঠন করেন সুভাষ। দলের নাম দেন ‘ফরোয়ার্ড ব্লক’। জাতীয় কংগ্রেসে যোগ দেওয়ার পর তাঁর প্রায় ২০ বছরের রাজনৈতিক জীবনে সুভাষচন্দ্রকে মোট ১১ বার গ্রেফতার করে ব্রিটিশ সরকারের পুলিস প্রশাসন।
১৯৪১ সালে কলকাতার বাড়ি থেকে উধাও হয়ে গেলেন সুভাষ। ১৯৪২ সালে বার্লিন থেকে তাঁর কন্ঠ শোনা যায় ‘আজাদ হিন্দ’ রেডিও স্টেশনে। ভারতের স্বাধীনতার জন্য ১৯৪৩ সালে হিটলার-সহ জার্মানির উচ্চপদস্থ সামরিক কর্তাদের সঙ্গে কথা বলেন সুভাষ। তখন রাসবিহারী বসুর উদ্যোগে জাপানে শুরু হয়ে গিয়েছে ‘আজাদ হিন্দ ফৌজ’ গঠনের প্রক্রিয়া। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের হাতে বন্দী ভারতীয় ব্রিটিশ সেনাদের একত্রিত করে ‘আজাদ হিন্দ ফৌজ’-এর লক্ষ্য এবং কার্যপ্রনালী তখনও স্থির হয়নি। সুভাষ জাপানে এসে পৌঁছাতেই ‘আজাদ হিন্দ ফৌজ’-এর দায়িত্ব তাঁর হাতে সঁপে দিলেন রাসবিহারী বসু। সুভাষ যোগ দিতেই ‘আজাদ হিন্দ ফৌজ’-এর কার্যকলাপ ও সক্রিয়তা বহুগুণ বৃদ্ধি পায়। সুভাষচন্দ্র বসু হয়ে উঠলেন ‘আজাদ হিন্দ ফৌজ’-এর ‘নেতাজি’। পরবর্তীকালে ওই নামেই তাঁকে বেশি চেনেন দেশ-বিদেশের লক্ষ লক্ষ মানুষ। নেতাজির নেতৃত্বে ব্রিটিশ বাহিনীকে পরাজিত করে কোহিমা দখল করে ‘আজাদ হিন্দ ফৌজ’। কিন্তু তার পর হিরোসিমা, নাগাসাকিতে মার্কিন পরমানু বোমার আঘাত সামরিক রসদে ভাঁটা পরে। থমকে যায় ভারতের প্রথম স্বাধীন সেনার জয়যাত্রা।
১৯৪৫ সালের ১৮ই আগস্ট বিমান দুর্ঘটনায় নেতাজীর মৃত্যুর খবর ছাপা হয়েছিল জাপানের সংবাদপত্রগুলিতে। কিন্তু ভারতে সুভাষের মৃত্যু সংবাদ অনেকেই মেনে নিতে পারেননি। ঐতিহাসিক লিওনার্ড এ গর্ডনের লিখিত তথ্যের উপর ভিত্তি করে নেতাজির মৃত্যুর বিষয়ে সেখানে লেখা হয়েছে, তাইপেইর তাইহোকু বিমানবন্দরে দুপুর ২টো ৩০ মিনিট নাগাদ একটি বিমান দুর্ঘটনায় শরীরের প্রায় ৯০ শতাংশ পুড়ে গিয়েছিল নেতাজির। ‘থার্ড ডিগ্রি বার্ন ইঞ্জুরি’ নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি করা হয় তাঁকে। সেখানেই স্থানীয় সময় রাত ৯টা থেকে ১০টার মধ্যে মৃত্যু হয় নেতাজির।
আরও পড়ুন: অন্তর্ধান না মৃত্যু! ৭৪ বছর পেরিয়ে আজও রহস্যে নেতাজি
বসু পরিবারের সদস্য, নেতাজির প্রপৌত্র চন্দ্রকুমার বসু ১৮ অগস্ট দিনটিকে সুভাসচন্দ্র বসুর মৃত্যুদিন হিসাবে মেনে নিতে চান না। তাঁর মতে, এখনও এমন কোনও নথি সামনে আসেনি যা থেকে এটা নিশ্চিতভাবে বলা সম্ভব যে, ১৮ অগস্ট ১৯৪৫ সালে তাইহোকু বিমানবন্দরে হওয়া বিমান দুর্ঘটনাতেই মৃত্যু হয়েছিল নেতাজির। চন্দ্রকুমার বসু জানান, সম্প্রতি নেতাজি সম্পর্কিত মোট পাঁচটি ফাইলের কথা জানিয়েছিল জাপান সরকার, যার মধ্যে মাত্র দুটি ফাইলই প্রকাশ করেছে তারা। যে দুটি ফাইল জাপান সরকার সামনে এনেছে তাতে নেতাজির অন্তর্ধান বা মৃত্যু সম্পর্কে তেমন কোনও তথ্যই মেলেনি। তবে বাকি তিনটি ফাইল কিন্তু এখনও সামনে আসেনি। চন্দ্রকুমার বসুর দাবি জানান, এই তিনটি ফাইলে ঠিক কী তথ্য রয়েছে, কেন এই তিনটি ফাইল প্রকাশকরতে চাইছে না জাপান সরকার, সে সম্পর্কে জানতে উদ্যোগ নিক কেন্দ্র।
ভারতবাসীকে স্বাধীনতা অর্জনের ক্ষেত্রে অহিংস আন্দোলনের পরিবর্তে সশস্ত্র আন্দোলন গুরুত্ব বুঝিয়েছিলেন তিনি। স্বাধীন ভারতের জন্য সেনা-বাহিনী গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে দেশের মানুষকে সচেতন করেছিলেন সুভাষচন্দ্র। ভারতের জাতীয় রাজনীতিতে নতুন যুগের সূচনা হয়েছিল তাঁর হাত ধরেই। কিন্তু দেশের স্বাধীনতার লাভের ৭৩ বছর পরও তাঁর মৃত্যু নিয়ে রহস্যের জট কাটানো যায়নি। অন্তর্ধান না মৃত্যু— এই প্রশ্নের উত্তর আজও মেলেনি সঠিক ভাবে। তাই নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু আজও লক্ষ লক্ষ ভারতীয়দের কাছে ‘মৃত্যুঞ্জয়ী’, অক্ষয়ী এক বীর সংগ্রামী।