জিভ ছিঁড়ে নিলেও প্রতিবাদ কিন্তু বন্ধ হবে না!
ভারতের মতো বহুস্তরীয় দেশে এ ধরনের ঘটনার নানা সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক অভিমুখ
সৌমিত্র সেন
ইউক্রেনের ওকসানা মাকার। হাউস্টনের এলিজাবেথ পেনা। হাথরসের বছর উনিশের দলিত কন্যা।
এদের মধ্যে কোনও মিল আছে?
আছে বইকি! এঁরা সকলেই গণধর্ষণের শিকার। অনুযোগ, ধর্ষণের পরে এঁদের সকলকেই শ্বাসরোধ করে মারার চেষ্টা করেছে ধর্ষকেরা। পুরুষের নগ্ন লালসা এক সুতোয় বেঁধে দিয়েছে ইউক্রেন, হাউস্টন, হাথরস, দিল্লি, মুম্বই, তেলেঙ্গনা....এ ভাবেই হয়তো বেঁধে দিতে দিতে যাবে আরও আরও কোনও কামদুনি, বিহার, নয়ডা, ওড়িশা... এবং এ ভাবেই...। শেষ নেই যে, শেষ কথা কে বলবে!
কিন্তু আমরা কি শেষ পর্যন্ত শেষ করব না? আমরা থামব না? আমাদের বিকৃতকাম পুরুষসমাজ দাঁড়িয়ে একটু ভাববে না? কলকাতার বাসকন্ডাক্টরেরা যেমন সচরাচর বলে থাকেন, 'পিছনের দিকে এগিয়ে যান', তেমন করেই কি অন্ধ ভাবে শুধু পিছনের দিকে 'এগিয়ে যাব'! কত পিছনে যাব? এতটাই পিছনে কি-- যেখানে আদিম কামের অগ্নি-জ্বালায় পুড়ে খাক হওয়া রক্তমাখা অস্ত্রহাতে আদিম কোনও দুর্বোধ্য পুরুষ কোনও আদিম নারীকে যে-নিষ্প্রাণ শক্তিমত্তায় গ্রহণ করে, সেরকম কোনও বোবা যাপনের গূঢ় ক্লেদের আঁধারে!
অধ্যাপক ও মনোরোগ বিশিষ্ট ড. ওমপ্রকাশ সিং যেমন একটা গুরুত্বপূর্ণ দিকে নজর টেনেছেন। তিনি বলছেন, 'মেয়েদের ওপর অত্যাচার তো শুধু সেক্স নয়। এটা ম্যানিফেস্টেশন অফ পাওয়ার। মহিলাদের ওপর অত্যাচার করে তাঁদের পরিবারকেও কখনও কখনও শাস্তি দেওয়া হয়। এবং সেখানে পুরুষতান্ত্রিকতার অন্যরকম চেহারা ঘাপটি মেরে থাকে। মেয়েদের তারা পণ্য হিসেবে দেখে এবং মনে করে এই পণ্য তার প্রাপ্য। ধর্ষণের মধ্যে দিয়ে তারা আসলে তাদের ওই প্রাপ্যটাই ছিনিয়ে নেয়।'
তা হলে, এই যে বিপুল জটিলরঙিন আমর্ম সভ্যতা-- এর মানে কি? এই আকাশচুম্বী বিজ্ঞানের জয়পতাকা, প্রযুক্তির বিজয়-বৈজয়ন্তী, শিক্ষা-স্বাক্ষরতার উড্ডীন পতাকার সংখ্যাতাত্ত্বিক উল্লাস? যেখানে পোশাকি ভদ্রতার মান্য কেতার মোড়কে অবলীন হতে-হতে প্রতিদিন আমরা একটু একটু করে ভীষণ 'সভ্য' হয়ে উঠি, সেইরকম কোনও এক অন্তর্লীন শূন্যপুরাণের নিরালম্ব সংস্কৃতির জড়ত্বেই কি রোজ জিব বের করে হ্যা-হ্যা মুক্তি পাচ্ছে আমাদের প্রতিস্পর্ধী প্রণম্য সভ্যতা!
হ্যাঁ! এ না হলে তো নির্ভয়া হয় না, হাথরসও হয় না।
আর হলে, কী করি আমরা? ক্ষতিপূরণ দিই। তদন্ত কমিশন বসাই। বিচারব্যবস্থারও আয়োজন করি। হয়তো শাস্তিও পায় ধর্ষকেরা। কিন্তু তারপর। যে-মেয়েকে একটু-একটু করে বড় করে তুলছিল বাবা-মা, তাঁদের দলাপাকানো বুক ভারী করা অশ্রুকষ্টের কথা মনে রাখি? স্বয়ং ভিক্টিম যে-মেয়েটি নিজের মধ্যে একরাশ অমর স্বপ্নের লাবণ্য লালন করতে করতে একটু-একটু করে এই পৃথিবীর আলোজলবাতাসের মধ্যে মাথা তুলছিল, তার আলোকিত অন্তরের পবিত্রতাকে খুঁজি আমরা? না, করি না। পারি না। কেননা, আমরা ভুলে যাই। গণস্মৃতি এমনিতেই দুর্বল।
ঘোরতর সবল শুধু আমাদের পুরুষতন্ত্র। যে-পুরুষতন্ত্রেরই অংশ তো ওই অলজ্জ ধর্ষকের দল। যারা কাম চরিতার্থ করেও ক্ষান্ত হয় না। তারা নিষ্ঠুরতা-নৃশংসতার শেষ দেখে ছাড়ে। তারা কখনও ধর্ষিতার চোখ উপড়ে নেয়, জিভ ছেঁড়ে, কখনও শ্বাসরোধ করে, মেরুদণ্ড ভাঙে, যোনি থেকে টেনে বের করে অন্ত্র! হায়! অন্ধ মূঢ় শক্তির উৎসবে তখন একটু-একটু করে মরতে থাকে আমার-আপনার ঘরের অসহায় একাকী নির্জন মেয়েটি।
কেন এই নৃশংসতম নিষ্ঠুরতার সযত্ন অনুশীলনে মাতে ধর্ষকেরা?
ভারতের মতো বহুভাষী বহুসাংস্কৃতিক বহুস্তরীয় এক দেশে এ ধরনের ঘটনার নানা সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক অভিমুখ থাকে। এবং পরতে-পরতে জড়িয়ে থাকে নানা নিভৃত নীরব অন্ধকার।
বিশিষ্ট নাট্যব্যক্তিত্ব কৌশিক সেন হাথরস প্রসঙ্গে যেমন বলেন, 'এটা শুধু ধর্ষণ নয়। এটা জাতপাতের লড়াই। দেশে যে বিপজ্জনক সরকার আছে, তারই উত্তরপ্রদেশ উইং একটা রাজ্য চালায়। সেখানে ধারাবাহিক ভাবে এই ধরনের ঘটনা ঘটেই চলেছে। বিরোধীরা নয়, আমার মতে, নারী হিসেবে বিজেপি'র মধ্যে থেকেই স্মৃতি ইরানিরা গর্জে উঠুন। আঙুল তুলুন। না হলে কিন্তু এ জিনিস বন্ধ হবে না।'
বন্ধ হবে না, ঠিকই। কিন্তু আমাদের অন্তর কেঁপে ওঠে। আমাদের প্রত্যকের ঘরেই আছে না ওই হাথরসের উনিশ, হাউস্টনের ষোলো! তা হলে? তারা কি ঘরের মধ্যে মুখ লুকিয়ে বসে থাকবে! ভয় পাবে! ভয়ে কুঁকড়ে গিয়ে আসলে পুরুষতন্ত্রের হাতটাই আরও শক্ত করবে? না, কি প্রতিবাদ করবে?
না, প্রতিবাদেও যে ঘোর অ্যালার্জি পুরুষের, ধর্ষকের, ক্ষমতার। সে যাতে কোনও দিন কোনও ভাবেই আর মুখ তুলতে না পারে তাই তো তার মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়া ঘাড় ভেঙে দেওয়া! কিন্তু প্রতিবাদের মুখ এ ভাবে যে বন্ধ করা যায় না সে-কথাই জোরের সঙ্গে মনে করালেন এ শহরের বিশিষ্ট মনোবিদ ড.অনুত্তমা বন্দ্যোপাধ্যায়। বললেন, 'ঘটনাটি অত্যন্ত লজ্জাজনক। হাথরসে যা ঘটেছে সেটা কিন্তু শুধু নারীবিদ্বেষ নয়, এটা একরকম শ্রেণিবিদ্বেষও। কেননা এখানে ভিক্টিম একজন দলিত কন্যা। সব চেয়ে বড় কথা, ইদানীং ধর্ষণের পরে ধর্ষিতার উপরে নৃশংসতার একটা ট্রেন্ড দেখা যাচ্ছে। আসলে ধর্ষকেরা জানে, এখনকার কোনও মেয়ে ধর্ষিতা হলে সে আর লজ্জায় মুখ ঢাকবে না, বরং সে প্রতিবাদ করবে। সে যেহেতু চুপ করে থাকবে না, তাই তাকে পুরোপুরি চুপ করিয়ে দেওয়ার এই অপচেষ্টা। তাই তার জিভ ছিঁড়ে নেওয়া। তবে ধর্ষকদের মনে রাখা উচিত, একাধিক মেয়ের জিভ ছিঁড়ে নিলেও কিন্তু প্রতিবাদ বন্ধ হবে না।'
তবে তাই হোক!
আমার ক্ষতিপূরণ চাই না, চাকরি চাই না, সান্ত্বনা চাই না, অনুকম্পা চাই না। শুধু আমার ঘরের মরা মেয়েটির হয়ে আরও হাজার হাজার মেয়ে ওই ছেঁড়া জিভ, ওপড়ানো চোখ, ভাঙা দাঁত আর রক্তের মধ্যে থেকে একযোগে কথা বলে উঠুক, প্রতিবাদে মুষ্ঠিবদ্ধ করুক হাত, শনাক্ত করুক অপরাধীদের। উৎপীড়িতের ক্রন্দনরোল বন্ধ হোক!
আরও পড়ুন: হাথরসে গণধর্ষিতা তরুণীর মৃতদেহকে অপমান করছে যোগীর পুলিস, মোদীকে নিশানা অভিষেকের