শ্রদ্ধাবীজ, জলপাত্র ও এক 'সম্বুদ্ধ' কৃষক'রত্নে'র কাহিনি

নগরোপান্তে এসে সমস্ত রাজপরিচয় পরিত্যাগ করে কপিলাবস্তু ছেড়ে চিরতরে চলে গেলেন। 

Updated By: May 26, 2021, 02:19 PM IST
শ্রদ্ধাবীজ, জলপাত্র ও এক 'সম্বুদ্ধ' কৃষক'রত্নে'র কাহিনি

সৌমিত্র সেন

পালি সাহিত্যের এক প্রাচীন গ্রন্থ সুত্তনিপাতে এরকম উল্লেখ আছে:

সো বোধিসত্ত্বো এক রতনবরো অতুল্যো।
মনুস্সলোকে হিতসুখতায় জাতো।
সক্যানং গামে জনপদে লুম্বিন্যেব্যে।--

শ্রেষ্ঠরত্নের মতো অতুলনীয় যে বোধিসত্ত্ব, তিনি লুম্বিনী-জনপদে শাক্যদের গ্রামে মানবের মঙ্গল ও সুখের জন্য জন্মগ্রহণ করলেন।

'শ্রেষ্ঠরত্নের মতো অতুলনীয়' কে ইনি? 
গৌতম। যিনি পরে বোধিলাভ করে হবেন 'সম্বুদ্ধ' বা 'বুদ্ধ'। ভগবান বুদ্ধদেব।

কেন 'শ্রেষ্ঠরত্নের মতো অতুলনীয়' ইনি? 

স্ত্রী-পুত্র নিয়ে রাজবৈভবে সুখে কালাতিপাত করা এক তরুণ রাজকুমার একদিন হঠাত্‍ই নৃত্যগীতবাদ্যমুখরিত সন্ধের স্মৃতি ভুলে ঘোর রাতে উঠে তাঁর সারথিকে ডেকে ঘোড়া প্রস্তুত করতে বলেন। রথ নয়, সারথির সঙ্গে সেই ঘোড়ার পিঠেই বসে নগর ত্যাগ করেন। নগরোপান্তে নদীতীরে এসে সমস্ত রাজপরিচয় পরিত্যাগ করে বস্ত্রালঙ্কার সব সারথির হাতে দিয়ে কপিলাবস্তু ছেড়ে চিরতরে রাজগৃহে চলে গেলেন তিনি। বহুদিনলালিত তত্ত্ববিচার ও সত্য অনুসন্ধানের জন্য কী অলৌকিক গহন এই ত্যাগ! রত্নই তো!

আরও পড়ুন: সঙ্ঘজননী সারদাদেবী, এক শাশ্বত মাতৃমূর্তি

রাজগৃহের উরুবিল্ব স্থানটি পছন্দ হল গৌতমের। সেখানেই তিনি এক অশ্বত্থবৃক্ষের নীচে সাধনা শুরু করলেন। উপবাস, হঠযোগ, রাজযোগের পথ দিয়ে হেঁটে অবশেষে তিনি ধ্যানমার্গ অবলম্বন করলেন। তাঁর মনে পড়ল, বাবার সঙ্গে কৃষিকাজ দেখতে গিয়ে জীবনের প্রথম ধ্যানটি তিনি করেছিলেন এক জামগাছের তলায় বসে। তাই এবার তিনি ধ্যানে ডুবে গেলেন। 

দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হয়ে গেল। একসময় গৌতম কিছু অস্বস্তি অনুভব করলেন। বুঝলেন, শরীর ঘোরতর অবসন্ন। আর অবসন্ন শরীরে সত্যের সন্ধান কঠিন। তখন উপবাস থেকে নিরত হওয়া মনস্থ করে দুপুরের দিকে গ্রামের দিকে গেলেন গৌতম। সেখানে স্নান করে এক গ্রাম্য যুবতী সুজাতার দেওয়া পায়সান্ন গ্রহণ করলেন। তারপর সারা বিকেল বৃক্ষনিম্নে বিশ্রাম। সন্ধের মুখে তিনি ফিরলেন তাঁর সাধনস্থলে। এবং ডুবে গেলেন সঘন গহন গভীর নিবিড় ধ্যানে। এদিন রাত্রের শেষ প্রহরে তিনি বোধি লাভ করলেন। সেই দিনটিই ছিল বৈশাখমাসের পূর্ণিমা। ঐতিহাসিক সেই দিনটিই আজ, বুধবার বুদ্ধপূর্ণিমা বলে খ্যাত।

বুদ্ধদেব সারাজীবন ধরে নানা ভাবে তাঁর মত, তাঁর দর্শন, তাঁর ভাবনার প্রচার ব্য়াখ্যা উপদেশ নির্দেশ করেছেন। আবার পরিচিত-অপরিচিতদের সঙ্গে তাঁর ক্ষণিক ব্যবহার বা কথোপকথনও কোথাও-কোথাও বিদ্যুত্‍-দ্যুতিতে ঈঙ্গিত দিয়েছে শাশ্বত সত্যের।

যেমন, একদিন ভিক্ষায় বেরিয়েছেন বুদ্ধ। ভরদ্বাজ নামের এক ব্রাক্ষণের ক্ষেতের কাছে গিয়ে তিনি ভিক্ষার্থে দাঁড়ালেন। ব্রাক্ষণ ভিক্ষালাভেচ্ছু শ্রমণকে দেখে বললেন, তুমি আমারই মতো চাষবাস, লাঙ্গল দেওয়া, বীজ বপন, শস্যসংগ্রহ ইত্যাদি করে খাও। ভিক্ষা করো কেন? 

বুদ্ধদেব স্মিত হেসে তাঁকে বললেন, আমিও চাষি। আমি শ্রদ্ধার বীজ বপন করি। এর উপর তপস্যার বৃষ্টি পড়ে। প্রজ্ঞা আমার লাঙ্গল। উত্‍সাহ আমার বলদ। পাপলজ্জা, ঈর্ষা, চিত্ত আমার দড়ি। জাগ্রত-অবস্থা হল আমার লাঙ্গলের ফাল। শরীরে ও বাচনে আমি সংযম পালন করি। সত্যের সাহায্যে আমি মনের দোষরূপ আগাছাগুলির উপর নিড়ানি দিই। সন্তোষই আমার বিশ্রাম। এসবের পরে আমি এমন এক জায়গায় যাই যেখানে শোকের কোনও সম্ভাবনা নেই।

বলাই বাহুল্য, ভরদ্বাজ এই কথার তাত্‍পর্য বুঝলেন এবং তিনি বুদ্ধের শিষ্যত্ব গ্রহণ করলেন। 

আর একদিনের ঘটনা। ভগবান বুদ্ধ তখন রাজগৃহের কাছে বেণুবনে অবস্থান করছেন। রাহুলও কাছাকাছি থাকেন। একদিন বুদ্ধ সন্ধের ধ্যানকর্ম শেষ করে রাহুলের কাছে গেলেন। রাহুল আসন ও পা ধোওয়ার জল দিলেন। বুদ্ধ পা ধুলেন এবং ওই জলপাত্রে অল্প কিছু জল রেখে রাহুলকে বললেন, 

হে রাহুল, তুমি এই অল্প জলটুকু দেখতে পাচ্ছ কি? 
রাহুল বললেন, হ্যাঁ। 
বুদ্ধ বললেন, যাদের মিথ্যে বলতে লজ্জা হয় না, তাদের শ্রমণতা এই জলের মতোই অকিঞ্চিত্‍কর। 

এরপর বাকি জলটুকু ফেলে দিয়ে বুদ্ধ বললেন, তুমি কি ওই ফেলে-দেওয়া জলটুকু দেখতে  পাচ্ছ? 
রাহুল-- হ্যাঁ।
-যাদের মিথ্যে বলতে লজ্জা বোধ হয় না, তাদের শ্রমণতা এই জলের মতোই ত্যাজ্য। 

এরপর বুদ্ধ ওই জলপাত্র উপুড় করে রাহুলকে বললেন, যাদের মিথ্যে বলতে লজ্জা বোধ হয় না, তাদের শ্রমণতা এই পাত্রটির মতো উপুড় বলে বুঝতে হবে।

এবার পাত্রটি চিত করে বুদ্ধ বললেন, এই রিক্তপাত্রটি দেখছ কি?
রাহুল-- হ্যাঁ।
-যাদের মিথ্যা বলতে লজ্জা বোধ হয় না, তাদের শ্রমণতা এই পাত্রটির মতো রিক্ত।

বিশাল বিপুল গভীর গৌতমবুদ্ধের জীবন। নানা তার তল ও তাত্‍পর্য। শাস্ত্রবদ্ধ উপদেশ ছাড়াও তাঁর জীবনের এই সব ছোটখাটো ঘটনাও মানবজাতিকে মহান শিক্ষা দিয়ে গিয়েছে। ত্যাগ, তিতিক্ষা এবং সত্যের সাধন-- এই-ই সম্ভবত তাঁর সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা। অন্তত এ বিঘ্নিত কালের ও স্খলিত সময়ের নিরিখে তাঁর সত্যের প্রতি অবিচল নিষ্ঠার শিক্ষাই সব চেয়ে মহত্‍।   

আরও পড়ুন: যেন বাংলার যুযুধান রাজনীতির দিকে তাকিয়েই মহাবাণী উচ্চারণ করেছেন এই মহামানব!

.