#ভ্রমণ: কখনও পথ হারিয়েছেন শ্রীরামপুরের মুররাবুরুর শালজঙ্গলে?
আপনার জন্য নিবিড় অপেক্ষায় বর্ষার সজল বাতাস, বসন্তের উজ্জ্বল পলাশ, গ্রীষ্মের অধীর নিশ্বাস আর পূর্ণিমাজ্যোৎস্নার অমিত মদিরতা।
সৌমিত্র সেন
এ লেখার শিরোনামে শ্রীরামপুর দেখে কি একটু আশ্চর্য হচ্ছেন? ভাবছেন, হাওড়া থেকে ট্রেন ধরে এই হাতের কাছের শ্রীরামপুরে পোঁছলেই পেয়ে যাবেন পথ-হারানোর শাল-জঙ্গলপথ? তা আবার হয় নাকি? না, তা একেবারেই হয় না। হচ্ছেও না। এই শ্রীরামপুর পুরুলিয়ার এক 'অখ্যাত' গ্রাম। এ গ্রামটিকে ভ্রমণপিপাসুরা অবশ্য এক ডাকেই চেনেন। নাম তার 'পাখিপাহাড়'।
পুরুলিয়ার বলরামপুরের শ্রীরামপুর গ্রামে রয়েছে এই 'পাখিপাহাড়'। 'পাখিপাহাড়'ও অবশ্য তুলনায় নতুন নাম। শ্রীরামপুর গ্রামের পাহাড়টির প্রকৃত নাম 'মুররাবুরু'। 'বুরু' শব্দের অর্থ পাহাড়। মোটামুটি দু'দশক ধরে এলাকাটি পাখিপাহাড় নামে পরিচিত হয়েছে। শিল্পী চিত্ত দে ৮০০ ফুট উচ্চতার মুররাবুরুতে 'ইন-সিটু রক স্কাল্পচারে'র কাজ শুরু করেছিলেন সেই ১৯৯৭ সাল নাগাদ। সরকারি অনুদানে চার বছর ধরে ২৪ জন শিল্পীকে নিয়ে কাজটি করেন তিনি। মুররাবুরুর বর্তুলাকার গাত্রে প্রায় ৬৫টি ডানা-মেলা পাখি আঁকে এই দলটি। শোনা যায়, সেখানে সব চেয়ে ছোট ডানার দৈর্ঘ্য ৫৫ ফুট আর সব চেয়ে বড় ডানার দৈর্ঘ্য ১২০ ফুট। সেফটি রোপের সাহায্যে খাড়া পাহাড় থেকে ঝুলে ঝুলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে পাহাড়ের গায়ের পাথর কুঁদে কুঁদে সৃষ্টি করা হয়েছে এই সব পাখি-অবয়ব।
আরও পড়ুন: #ভ্রমণ: হাত বাড়ালেই আদিম অরণ্যের অন্ধকার
কিন্তু ঘটনা হল, কেউ যদি পাহাড়গাত্রের এই রক-আর্টের বিষয়ে বিন্দুমাত্রও আগ্রহী না হয় তাতে বিন্দুমাত্রও ক্ষতি হয় না তার। কেননা এখানে আছে প্রকৃতির অপূর্ব সম্পদ ও সৌন্দর্য। ঋতুতে ঋতুতে নব নব রূপে ধরা দেয় তা। শীতে-গ্রীষ্মে-বর্ষায়, শরতে-হেমন্তে-বসন্তে এই পাখিপাহাড় ও তার পায়ের কাছে লুটিয়ে থাকা অরণ্যে যেন নতুন নতুন আলো ঠিকরে পড়ে, আর এর পল্লবের স্তূপে বয়ে যায় আদ্যন্ত নতুন বাতাস। হিম আর শিশির, রোদ আর বৃষ্টি, গোধূলি ও প্রভাত এখানকার গাছমাটিঘাসধুলোপাথরকে যেন নতুন বর্ণে ও গন্ধে প্রাণিত করে। বর্ষায় প্রকৃতি এখানে গভীর সবুজ, বসন্তে প্রকৃতি এখানে অধীর অবুঝ। বর্ষায় এখানে লালমাটির গন্ধে আবিল থাকে বর্ষারেণুমাখা নিবিড় বাতাস; বসন্তে এখানে রঙিন বাতাসে ফুলরেণুর বিলোল উদ্ভাস; হেমন্তে এখানে ঝরাপাতার ধূসর বর্ণমালা; আর শীতে এখানে কঠিন ঠান্ডার মুষ্টিতে মুরগির করুণ গলার মতো বদ্ধ হয় অসহায় প্রকৃতি।
এখানে নিকটবর্তী মাঠায় হাট বসে। দেখার মতো উপাদেয় গ্রামীণ এই হাট। দেশি মুরগি, হাঁস, ছাগল, তাজা শাক-সবজি, নানা কিসিমের মশলা, গজা-জিলিপি। ক্রেতা-বিক্রেতার কলরবে, নানাজনের উপস্থিতিতে রঙিন এই হাটই যেন একবেলার এক বিশুদ্ধ আউটিং।
না হলে শুধু বসে বসেই সময় বয়ে যায় এখানে। অজস্র সেগুনগাছের নিভৃতির মধ্যে সারাদিনের রোদ আর ছায়ার লীলার মধ্যে দাঁড়িয়ে পাহাড়ের অনুচ্চ মাথার উপর পাখির ডানার স্পর্শ অনুভব করতে করতেই এখানে বইয়ে দেওয়া যায় বহু মুহূর্ত। আর যদি কোনও পূর্ণিমালগ্নে পৌঁছে যেতে পারেন এই ভূমিতে? তা হলে অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হবেন আপনি!
কী ভাবে পৌঁছবেন এখানে? খুবই সহজ। কলকাতা থেকে ট্রেনে পুরুলিয়া স্টেশন বা বরাভূম স্টেশন। পুরুলিয়া স্টেশন থেকে পাখিপাহাড় সড়ক পথে ঘণ্টাখানেক। তুলনায় বরাভূম থেকে দূরত্ব কম। মিনিট চল্লিশেক। একটা মিষ্টি নামের মোড় আছে এখানে-- ভুচুন্ডী মোড়। এখান থেকে আঁকাবাঁকা পথ ধরে ট্রেকও করতে পারেন। না চাইলে এটুকুও গাড়ি করেই পৌঁছে যেতে পারেন শ্রীরামপুর গ্রামের পেটে, পাখিপাহাড়ের পায়ের কাছে।
সৌভাগ্যবশত এখনও এখানে হোটেল গড়ে ওঠেনি। কয়েকটি হোম স্টে আছে। এরকম হোম স্টে'তে থাকতে মন্দ লাগবে না। ঘরোয়া পরিবেশে থাকা, ঘরোয়া খাওয়া-দাওয়া। খরচও সাধ্যের মধ্যে। জনপ্রতি ৮০০-১০০০ টাকা প্রতিদিন।
আর যদি শুধু গ্রামটুকুর মধ্যেই থেকে যেতে চান, সেক্ষেত্রে সকাল-সন্ধে এলোমেলো হেঁটে চলার কোনও বিকল্প নেই। যদি একটু দূরের দিকে যেতে চান, তা হলে হাজার তিন-চার টাকায় সারাদিনের জন্য গাড়ি বুক করে বেরিয়ে পড়ুন। অযোধ্যা পাহাড়, ব্রাহ্মণী ফলস, টুর্গা বাঁধ, খয়রাবেড়া ড্যাম; একটু অন্য দিকে যেতে চাইলে নোরাহারা ড্যাম, মুরগুমা ড্যাম, দেউল ইত্যাদিও ঘুরে নিতে পারেন।
তা হলে, আর কী? পাহাড়িয়া বাঁশির উন্মনা সুরে সুর মিলিয়ে এবার বেরিয়ে পড়ুন। আপনার জন্য নিবিড় অপেক্ষায় বর্ষার সজল বাতাস, বসন্তের উজ্জ্বল পলাশ, গ্রীষ্মের অধীর নিশ্বাস আর পূর্ণিমাজ্যোৎস্নার অমিত মদিরতা।
(Zee 24 Ghanta App: দেশ, দুনিয়া, রাজ্য, কলকাতা, বিনোদন, খেলা, লাইফস্টাইল স্বাস্থ্য, প্রযুক্তির লেটেস্ট খবর পড়তে ডাউনলোড করুন Zee 24 Ghanta App)
আরও পড়ুন: #ভ্রমণ: ছুটিতে যেতে চান নির্জন সৈকতে? চলুন লাল কাঁকড়ার দেশে