এক মাইলের ইতিকথা

ইতিহাসে জর্জরিত, শৈত্যপ্রবাহে জবুথবু, ভৌতিকতার জ্বরে তন্দ্রাচ্ছন্ন এক মাইল পথ।

Updated By: Sep 28, 2012, 01:12 PM IST

মাইলটাক হেঁটে শময়িতা চক্রবর্তী
ইতিহাসে জর্জরিত, শৈত্যপ্রবাহে জবুথবু, ভৌতিকতার জ্বরে তন্দ্রাচ্ছন্ন এক মাইল পথ। শহরের বুক চিরে রানির বাড়ির সঙ্গে দুর্গের যোগসূত্র রয়াল মাইল। পৌঁছনোর আগে চোখ বুজলেই স্কটল্যান্ড বলতে মনে পরত স্কচ হুইস্কি, ব্যাগপাইপার, মিনিস্কার্ট পরা সৌম্যদর্শন পুরুষ (পরে জেনেছি ওই স্কার্টের নাম কিল্ট আর চেক চেক প্রিন্টের নাম টারটান) আর বিশ্বখ্যাত লেক দানব নেসি। এক মাইলের বিশাল পৃথিবীর কথা জেনেছি অনেক পরে, এডিনবরার উইভারলি স্টেশনে নেমে।
মাইল পথের এক প্রান্তে হলিরুড প্রাসাদ। রাজ পরিবারের সামার ভেকেশনাবাস। আজও রানি তাঁর নবতিপর রাজাকে সঙ্গে করে এডিনবরার প্রজাদের নিমের পাচন অভ্যর্থনা গ্রহণ করতে আসেন। না, রাজকীয় সম্বর্ধনা, তোপধ্বনি বা কুসুমবিহারে চা-পান আয়োজনে কোনও ত্রুটি হয় না। কিন্তু, স্কটিশদের ঐতিহাসিক ইংল্যান্ড বিদ্বেষ স্বভাবতই রানি এলিজাবেথকে আপন করতে দেয় না। এই বৈরীর একটা উদাহরণ দিই। ফুটবল বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের খেলা যদি হয় জাপানের সঙ্গে, এডিনবরার মাঠ-ঘাট-পাব-খাট জাপানি পতাকায় ঢেকে যাবে। তবে এই চিত্র শুধুমাত্র স্কটল্যান্ডের নয়, নর্দার্ন আয়ারল্যান্ড, ওয়েলসেও এই হিংসুটিপনার পাহাড় প্রমাণ চিত্র পাওয়া যায়। ওয়েলসে তো রাগবি বিশ্বকাপের প্রধান স্পন্সরের বিজ্ঞাপনে ফলাও করে লেখাই থাকে, "আমরা কেবল দুটি দেশকেই সমর্থন করি। প্রথমটি আমার দেশ ওয়েলস, আর দ্বিতীয়, যে দেশই ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে খেলবে, তাকে..."। বলাই বাহুল্য এই বিদ্বেষ দ্বিপাক্ষিক।

যাক সে কথা। এদের পারস্পরিক যুদ্ধের বিবরণ পেতে বাজারে অষ্টম শ্রেণির ইতিহাস বইই যথেষ্ট। এখন এডিনবরায় ফিরি। রয়াল মাইলের অন্য প্রান্তে কে-বানিয়েছে-এখনও-অজানা-এডিনবরা ক্যাসল। ভলকানিক পাথরে তৈরি একটা পাহাড়। তার উপরের প্রকাণ্ড এক দুর্গ। সারা শহর নজরদারি করতে এর অবস্থান ঈর্ষণীয়। কে বা কারা এই দুর্গ বানিয়েছে সেই নিয়ে ঐতিহাসিকমহল ভারতের নকশালকুলের মতো সহস্রধারায় বিভক্ত। তবে দ্বাদশ শতাব্দীতে এডিনবরা রক্ষা করার জন্যই প্রথম ডেভিড এই দুর্গ ব্যবহার করেছিলেন বলে শোনা যায়। তার পর থেকে হাজার হাজার বছরের ক্ষত বিক্ষত যুদ্ধের স্মৃতি বুকে নিয়ে রয়াল মাইলের এক প্রান্তে স্থিতধী প্রহরীর মতো ঠায় দাঁড়িয়ে রয়েছে এডিনবরা দুর্গ। দুর্গের ভিতরে প্রাসাদ, স্মৃতি সৌধ, অর্ধচন্দ্রাকারে তোপের সারি (হাফ মুন ব্যাটারি, শত্রুপক্ষকে নিধন করার এমন এস্থেটিক বিন্যাসও অভূতপূর্ব), জেলখানা, হাসপাতাল, ধর্মস্থান, মেরি ক্যুইন অফ স্কটের থাকার জায়গা থেকে শুরু করে উনিশ শতকে সেনাপতিদের পোষ্য সমাধিক্ষেত্র, প্রায় সব কিছু মিলিয়ে যুদ্ধ বিরতিতে একবার বুক-ভরা-হাঁপ-নিতে-ব্যস্ত একটা ঐতিহাসিক শহর কল্পনা করে নিতে কোনও অসুবিধা হয় না।
ক্যাসলের মধ্যে সাড়ে ৭৩ লক্ষ ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথকতার মধ্যে মনের মণিকোঠায় জমে যাওয়া গল্পটা বলি। দুর্গের শহরমুখো প্রান্তে একটা পেল্লাই কামান। রবিবার, গুড ফ্রাইডে আর বড়দিন বাদে সারা বছর ঠিক দুপুর ১টায় একটা তোপধ্বনি শহরবাসীকে এর অস্তিত্ব জানান দেয়। শোনা যায়, অনেক আগে দুপুর ১২টায়, সূর্য যখন মধ্যগগনে, ঠিক তখনই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের গৌরবকে কুর্নিশ জানিয়ে গুনে গুনে ১২টা তোপধ্বনি হত। ভৌগোলিক অবস্থানে স্বভাব-মিতব্যয়ী স্কটরা ঠিক করল সাশ্রয়ার্থে তোপধ্বনির সময় এক ঘণ্টা পিছিয়ে দেওয়া হোক। সময়, তোপ, শ্রম সাশ্রয়ের পাশাপাশি, কানেরও কিঞ্চিত বিরাম হয় তাতে। তারপর থেকে দুপুর ১টাতেই এই গগনবিদারী আর্তনাদ শোনা যায়। আদেখলে পর্যটকরা কান পেতে সেই আওয়াজ শুনতে দুর্গের বাইরে ভিড় জমান। তোপধ্বনি শুনতে দর্শনেন্দ্রিয় যে অপ্রয়োজনীয় তা কে বোঝাবে!
এই ফাঁকে একটা গুরুত্বপূর্ণ টিপস দিয়ে রাখি। দুর্গ দেখতে যাওয়ার সময় নির্বাচন করতে গিয়ে মনে রাখবেন পশ্চিম কোলে সূর্য ডুব মারার সময় শহরের উপর একটা আলতো আলোর মায়াসর বিছিয়ে যায়। দুর্গ চূড়া থেকে তখন গোটা শহরের একটা স্বর্গের মর্তে নেমে আসার ছবি ফুতে ওঠে। আমার ধারণা, যুগ কাল ধরে দুর্গে থাকা সেনা থেকে সেনাপ্রধানরা শুধুমাত্র এই দৃশ্য দেখে শীতের অসহনীয় কামড় সহ্য করে, বাড়ি ছেড়ে যুদ্ধে আসার সময় ছেলের কান্নার স্বর ভুলতেন। পারলে একটা ভাল দেখে ছবি তুলে রাখবেন। লালচে আলোয় গথিক শহরটাকে দেখে গিয়ে ঝাপসা চোখে আমার আর ছবি তোলা হয়নি।

ক্যাসলের সিংহদ্বার থেকে বাইরে এসে সোজা খানিকটা হাঁটলে ডানহাতে রাস্তার উপরেই মোজেয়েকের হৃদয় দেখতে পাবেন। বললে বিশ্বাস করবেন না, ওটাই সারা শহরের পিক-দান। ওই পথে যেই যায় হৃদিমাঝারে খানিকটা থুতু দিয়ে যায়। শুনলাম, থুতুদানে ভাগ্যলাভও হয়। আরও পরে যা শুনলাম তাতে আমাদেরই হৃৎপিণ্ড আরও দ্রুতবেগে কম্পমান। এই পাষাণ হৃদয়ের নাম হার্ট অফ মিডলোথিয়ান। পঞ্চদশ শতাব্দীতে এখানে বিচার করে লোক সমক্ষে অপরাধীদের শাস্তি দেওয়া হত। পোষাকি নাম টোলবুথ। শোনা যায়, চুরি করলে একজিকিউশন পিলারে চোরের কানে পেরেক পুঁতে আটকে রাখা হত। টানা ২৪ ঘণ্টা এই চলত এই নির্মম রক্তক্ষরণ। শাসক পক্ষ ইংরেজ হওয়ায় স্বভাবতই স্কট জাত্যভিমানেও ছুরির তীক্ষ্ণ ফলার আঘাত লাগত। অষ্টাদশ শতাব্দীতে এই পাশবিক শাস্তি প্রদান বন্ধ হয়ে, থুতু প্রদান শুরু হয়। শহরে বাকি জায়গাতে থুতু ছেটালে কড়কড়ে ৫০ পাউন্ড জরিমানা নেবে সিটি কাউন্সিল। শুধু পাষাণ হৃদয়ে থুতু ফ্রি।
এডিনবরা পায়ে হেঁটে ঘোরার শহর। আর এই গোটা একমাইল জুড়ে ছোট, বড়, মাঝারি নানা মাপের হোটেল, ব্যাকপ্যাকার্স, পাব, রেস্তোরাঁ, বাজার আর প্রচুর লোক। বস্তুত, এই রয়াল মাইল রাস্তাটা হেঁটে হেঁটে আর চারপাশ দেখেই কাবার করে দেওয়া যায় সারা দিন । স্কটিশরা তাদের মাথাগরম স্বভাব আর জাত্যাভিমানের জন্য বিখ্যাত । তার বাইরেও স্কটিশদের আমোদপ্রিয় ফুর্তিবাজ যে চেহারাটা আছে, সেটা বুঝতে গেলে রয়াল মাইলে আসতেই হবে । আলো হাসি গান বাজনা মিলিয়ে প্রতি সন্ধ্যেবেলা এক রঙিন কার্নিভালে মেতে ওঠে এই পথ । সেই কার্নিভালে যেমন মিশে আছে বিখ্যাত ভুতুড়ে স্কটিশ প্রাসাদ যাকে বুঝতে গেলে ভূত দেখার ট্যুরে পায়ে হেঁটে ঘোরা মাস্ট, তেমনি মিশে আছে স্কটিশ পাব কালচারের ঐতিহ্য যা ধারে ভারে সমানে পাল্লা দেবে কলকাতার সাংস্কৃতিক ইতিহাসে কফি-হাউসের ঐতিহাসিক গুরুত্বের সঙ্গে।
এডিনবরার মত রহস্য আর ইতিহাস ঘেরা শহরের পুরো বর্ণনা দিতে গেলে হয়ত একটা আস্ত বই ফুরিয়ে যাবে। সে চেষ্টা না করে তাই এই লেখায় শুধু তুলে ধরলাম রয়াল মাইলের কথা । সিন্ধু দর্শন হল কি না জানি না, তবে শহরের ইতিহাসের গুরূত্ব ও প্রাসঙ্গিকতার পটভূমিতে এই রাস্তার অবস্থান যে মোটেও মাত্র বিন্দু-তুল্য নয়, তা হয়ত কিছুটা বোঝানো গেল। তবে একবার স্কটল্যান্ড পৌঁছলে হ্যাগিস (উইথ নিপ্‌স অ্যান্ড ট্যাটিস) খেতে ভুলবেন না। জাতীয় খাবার। বিস্তারিত বিবরণ পাবেন আগামীর কোনও সংখ্যায়।

.