ভিক্ষে মা মমতা, খাদ্যরসিক বুদ্ধ, ভীতু সুব্রত - এমন কিছু চেনা নেতা অচেনা নেতার গপ্পো
রাজনীতিতে সপ্রতিভ হয়ে উঠেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাইপো অভিষেক। পিসির আঁচলে থেকেই রাজনীতিতে তাঁর হাতেখড়ি। কিন্তু তিনি কোনওদিন মমতাকে পিসি বলে ডাকেননি। সবার ‘দিদি’, তাঁর-ও ‘দিদি’
চেনা নেতা অচেনা নেতা || লেখক- সৌরভ গুহ || মূল্য- ২০০ টাকা
প্রথমেই বলে রাখা ভাল, সাংবাদিক সৌরভ গুহের লেখা ‘চেনা নেতা অচেনা নেতা’ বইয়ে যে সব রাজনীতিকের চরিত্র আঁকা হয়েছে, তা যেন এক একটা অনুগল্প। যার হঠাত্ শুরু হঠাত্ শেষ। পাতে আপনার প্রিয় পদ পরিবেশন করা হয়েছে। কিন্তু এতটাই অল্প, চেটে-পুটে খেলেন, তবু মন ভরল না। আর একটু হলে বেশ হতো! এই বইয়ের প্রত্যেকটি চরিত্র পড়ার সময় আপনার এ কথাটা মনে হতেই পারে। বাম, ডান, অতি-ডান রাজনীতিকদের পাশাপাশি সহবস্থান এবং পরিচিত মুখোশের আড়ালে এত কটা অপরিচিত মুখ এ ভাবে এক সারিতে এক নাগালে মেলায়, যারপরনাই খুশি হতে পারেন আপনি।
যেমন ধরুন না এ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা। তাঁর সাহিত্যচর্চা, সঙ্গীতচর্চা ওয়াকিবহাল কম-বেশি মানুষ। যা কিছু করেন চটজলদি। যেন সময়ের কাছে বন্ধক রেখে ধনুক ভাঙা পণ করে এসেছেন মমতা। এটা যে তাঁর সহজাত, তা বোঝাতে লেখক তুলে ধরেছেন মমতার বেশ কিছু মমতা না হওয়ার সময়ের কিছু গল্প। মমতার কালীঘাটের বাড়ির উঠোন লাগোয়া মিলন সংঘের মাঠে ফুটবল টুর্নামেন্ট হলে, হেরো টিম কখনই খালি হাতে ফিরত না। তাদের মনোবল অটুট রাখতে নিজের টিউশন করে পাওয়া মাইনে থেকে সাধ্যমতো সাহায্য করতেন মমতা। বলতেন, “ভাল খেলেছিস। পুরস্কার পাসনি তো কি হয়েছে! মুড়ি কিনে খাস।” মা গায়েত্রীদেবী তাঁর বাপের বাড়ি গেলে এই মমতাই তখন হয়ে উঠতেন পরিবারের গৃহকর্তী। রান্না থেকে বাসন মাজা, ঘর মোছা সব কিছুই নিমেষের মধ্যে হয়ে যেত। সকাল ১০টার মধ্যেই দুপুরের খাবার খাইয়ে দিতেন ভাই-বোনেদের। মুখ্যমন্ত্রী দারুন উল বুনতে পারেন, জানতেন? হ্যাঁ, এমনই সব ছোটো ছোটো কাহিনি এক বিন্দুতে মিশে প্রবাহ সৃষ্টি করেছে অন্য আর একটি গল্পের টানে।
যাদবপুরে বুদ্ধসাম্রাজ্য এখন অনেকটাই ভগ্নদশায়। কিন্তু এই যাদবপুরকে ঘিরেই প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের কত স্মৃতি ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে! কবি হিসাবে তাঁকে যাদবপুর যতটা চেনে, তার চেয়ে বেশি চেনে খাদ্য রসিক হিসাবে। পার্টি সম্মেলনে খাসির মাংস রাঁধা হলে টিফিন বাক্স ভরে বাড়ি নিয়ে যেতেন বুদ্ধ। এর জন্য যদি তাঁকে এক ঘণ্টা দাঁড়াতে হয়, তাতেও রাজি তত্কালীন মুখ্যমন্ত্রী। আবার যাঁরা তাঁকে ফুল দিয়ে সম্বর্ধনা জানাতেন, তাঁদের বুদ্ধ বলতেন, “আপনারা বক, কুমড়ো ফুল নিয়ে আসতে পারেন তো! সম্বর্ধনা জানানো হয়, পরে তা দিয়ে বড়া করে খাওয়াও যায়।” এমনই খাদ্য রসিক বুদ্ধ! জ্যোতি বসুর পর একই ট্র্যাডিশনে শ্বেতশুভ্র, পাট ভাঙা ধুতি পরিহিত মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধবাবুর প্রচ্ছন্ন ‘শিশুসুলভ’ চরিত্রটিকে স্বল্প শব্দেই তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছেন লেখক।
রাজনীতিতে সপ্রতিভ হয়ে উঠেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাইপো অভিষেক। পিসির আঁচলে থেকেই রাজনীতিতে তাঁর হাতেখড়ি। কিন্তু তিনি কোনওদিন মমতাকে পিসি বলে ডাকেননি। সবার ‘দিদি’, তাঁর-ও ‘দিদি’। মমতাই অভিষেকের ‘ভিক্ষে মা’। তাই যত আবদার, অভিযোগ মমতার আঁচলে মুখ ঢেকে জানাতেন অভিষেক। তৃণমূলের যুবরাজের জীবনে মমতার ছায়াই যে প্রশস্ত হচ্ছে, দলের অন্দরে অনেকেই তা মানেন। মমতা-অভিষেকের এই রসায়ন সুনিপুণভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে এই বইয়ে। অধিকারী পরিবারের গপ্পোও বাদ যায়নি। শিশির অধিকারীর উর্বর জমিতে কোন কৌশলে তাঁর মেজ ছেলে শুভেন্দু শস্য-শ্যামলায় পরিণত করেছেন, তার রহস্য সযত্নে উদঘাটন করেছেন লেখক। নন্দীগ্রাম আন্দোলনের পর মেদিনীপুরে মহানায়ক হয়ে ওঠা, সে সময় নবজাতকের নাম শুভেন্দু নামে রাখার হিড়িক এ সবই ছুঁয়ে গিয়েছেন লেখক। মমতার ক্যাবিনেটের মন্ত্রী- সুব্রত মুখার্জি, পার্থ চট্টোপাধ্যায় এবং ফিরহাদ হাকিম (বর্তমানে কলকাতার মেয়র) – এই তিন জনের ‘অদ্ভুত ব্যামো’ লেখক না তুলে ধরলে হয়ত আম-পাঠক জানতেই পারতেন না! প্রচণ্ড ভূতের ভয় সুব্রতর। এতটাই যে মোবাইলে মা ভবতারীনির ছবি ওয়ালপেপার করে রেখে দিয়েছেন। বিপদ দেখলেই মাথা ঠোকেন মোবাইলে! জরুরীকালীন সময়ে রাইটার্সে ভূত দেখার অভিজ্ঞতা এখনও ধাওয়া করে সুব্রতকে। অন্য দিকে শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের ‘মাছের মুড়োর’ প্রতি দুর্বলতার কথা শুনলে অবাক হতেই হয়। নেতাজি নগরে ‘ভূপেন কেবিনে’ সাজানো মাছের মাথা দেখে কতবার চোখ চলে গিয়েছে মন্ত্রীমশাইয়ের, তার ইয়ত্তা নেই। ফুরসত পেলেই ভূপেন কেবিন থেকে মাছের ঝোল আনিয়ে কব্জি ডুবিয়ে খেতেন তিনি। তবলায় চাঁটি মারতে ওস্তাদ ছিলেন বামপন্থী গীতিকার শিবদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাগ্নের। আর এক জন হলেন চেতলার ফিরহাদ। মরা পোড়ানো ছিল হবি, আর মিষ্টি খাওয়া ছিল নেশা। মিষ্টির প্রতি তাঁর এতই দুর্বলতা, ফ্রি-তে খাওয়ার জন্য মরা পোড়ানোকে হাতিয়ার করে নিয়েছিলেন ফিরহাদ হাকিম। কারণ, পোড়ানোর দিনেও মিষ্টি, শ্রাদ্ধের দিনও মিষ্টি - সম্পূর্ণ ফ্রি-তে পাওয়া যায়। এক বার মামাতো বোনের বিয়ে বাসর জাগতে গিয়ে ৫০০ মিষ্টি খাওয়ার চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েন ফিরহাদ। জিতলেই ৫ হাজার টাকা! এমন সুযোগ হাত ছাড়া করা তো দূর, ২০০টা মিষ্টি যখন উতরে দিয়েছেন কনেপক্ষ ববির হাতে পায়ে ধরাধরি। থামো-থামো, এই নাও তোমার ৫ হাজার টাকা। পাড়ার মিষ্টি দোকান ‘অমৃত কুম্ভের’ মালিক এক বার তাঁকে সাজানো রসমালাইয়ের ট্রে হাতে ধরিয়ে বলেন, “ওই দফায় দফায় খাওয়ার থেকে একবারেই খেয়ে নিন। তা হলে আমারও বাঁচি।” সে দিন বিব্রত হননি ববি, চোঁক করে এক ট্রে রসমালাই মেরে সবাইকে অবাক করে দিয়েছিলেন আজকের মহানগরের মেয়র।
আরও পড়ুন- গত ৬ বছরে দেশে কাজ হারিয়েছেন ২ কোটি মানুষ: ন্যাশনাল স্যাম্পেল সার্ভে
সবজি ভক্ত সুব্রত বক্সী- তাঁকে এমন নামে ডাকলে বড় ভুল হবে না। তৃণমূলের রাজ্য সভাপতি, সাংসদ ও-সব তাকে তোলা থাকে যখন সকালে থলে হাতে বাজারে যান সুব্রত। মাছের পেট টিপলেই বোঝেন কতটা ফ্রেশ, কোন সবজি কার কাছে মেলে, এটা ছিল তাঁর নখদর্পনে। বক্সীবাবুর মেজাজ যিনি বোঝেন, সেই ব্যাপারী বছরের পর বছর টিকে যান। পুজোর সময় নতুন জামা উপহারও আসে বক্সীবাবুর তরফে। ঠিক সময়ে ঠিক কাজটি না হলে তাঁর তিরিক্কি মেজাজও জুটতে পারে যে কারওর ভাগ্যে। কেন এমন ব্যবহার করেন সত্যরঞ্জন বক্সীর ভাইপো! লেখকের সৌজন্যে বক্সীর গোপন কথাটি আর গোপন রইল না।
সিপিএম-র এক সময়ের দোর্দণ্ডপ্রতাপ নেতা সুভাষ চক্কোত্তির হেঁসেলের খবর সুনিপুণভাবে দিয়েছেন লেখক। রিপোর্টার বলেই হয়ত আড়ি পেতে হেঁসেলের খবর সংগ্রহ করতে পেরেছেন তিনি। এক সময় সিপিএমের পলিটব্যুরো মজতো চক্কোত্তি বাড়ির পূব বাংলার রান্নায়। সুভাষ চক্রবর্তীর মা লাবণ্যপ্রভার হাতে ইচামুড়া খেতে পছন্দ করতেন প্রমোদ দাশগুপ্ত। বুদ্ধবাবুর সঙ্গে রাজনৈতিক কারণে তাঁর দূরত্ব তৈরি হলেও, বাড়িতে ভাল পদ হলেই বুদ্ধবাবুর চালক ওসমানের কাছে পৌঁছে যেত তিন থাক ওয়ালা টিফিনবাক্স। জ্যোতি বসুর জন্মদিনে নিজে হাতে প্রতিবার খাওয়াতেন সুভাষের স্ত্রী রমলা। এমনই সব টুকরো টুকরো দৃশ্য জোড়া লাগিয়ে, বাম সরকারের পরিবহণ মন্ত্রীর প্রতিবিম্ব তুলে ধরেছেন লেখক। ‘বাড়ি ছাড়া বিমান’ও ধরা দিয়েছেন অন্য ভূমিকায়। বালিগঞ্জের অভিজাত প্রাসাদোপম বাড়ি ছেড়ে কার্যত তাঁর সন্ন্যাসগ্রহণ, প্রমোদ দাসগুপ্তের মানসপুত্রের পার্টি হোলটাইমার হওয়া এবং তাঁর পায়েস রান্না- ছোট্ট-খাটো মানুষটির কয়েনের উলটো পিঠের মতোই তুলে ধরেছেন লেখক। অন্য দিকে মাছ ধরার নেশার টানে রবিন দেবের কুমিল্লা যাত্রার কাহিনি পড়ে বিহ্বল হয়ে যেতে পারেন আপনিও।
আরও পড়ুন- জনতা ও জওয়ানদের কাছে ক্ষমা চাইতে হবে রাহুল গান্ধীকে, তোপ অমিত শাহর
হাজি মস্তানের ডেরায় পৌঁছে যাওয়া শিয়ালদহের সোমেন মিত্তির মনে করেন আজ যদি সঞ্জয় গান্ধী বেঁচে থাকতেন, হয়ত গল্পটা অন্য ভাবে শুরু হত। এক সময় তাঁর কথায় শিয়ালদহে বাঘে-গরু এক ঘাটে জল খেত, এ হেন চরিত্রের ছোড়দা কয়েক দিন আগে হাসপাতালের বেডে শুয়ে ভবতারীনির উদ্দেশে কেঁদে বলেছিলেন, তা হলে কি সব শেষ! অনেক কিছু যে করা হল না। লাজুক সোমেন, স্ত্রী শিখার সঙ্গে খুনসুটি সাবলীলভাবে ধরা পড়েছে বইয়ে। সুনামীর সময় পোর্টব্লেয়ারে দুর্গতদের সাহায্য করতে সে দিনের রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবকের একনিষ্ঠ কর্মী দিলীপ কীভাবে দিনরাত এক করে ফেলেছিলেন, তা সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন লেখক। তিনি শুধু বাক্যবোমায় বিখ্যাত নন, লাঠি চালনা, প্রাণোচ্ছ্বল কথা এবং রন্ধনে সিদ্ধহস্ত দিলীপ। তাই প্রথম দেখায় ববি হাকিমকে দেখে বলেন, কেমন আছো ববি। আজ কিন্তু আলোচনার টেবিলে তোমার পাশে বসব। সিকিউরিটি নিতে একদমই পছন্দ করেন না। প্রশ্ন করলে বলেন, এত দিন আমি সবাইকে সিকিউরিটি দিয়ে এসেছি, আজ আমায় কে সিকিউরিটি দেবে?
ইতিউতি বানান বিভ্রাট ছাড়া অত্যন্ত প্রাণবন্ত ভাষায় সব কটি চরিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন লেখক সৌরভ গুহ। যার পাতায়-পাতায় চরিত্রগুলি সুনিপুণ বুননে বর্ণময় হয়ে উঠেছে, প্রচ্ছদে তার ঝলক দেখা মিললে পাঠককে আরও দৃষ্টি আকর্ষণ করা যেতে পারতো। বাকিটা কুড়িয়ে পাওয়া দু’আনার মতো- পাঠকরা মুচকি হেসে তা বলতেই পারেন।