গুলিয়ে যাচ্ছে ওয়ার্ক, দিশেহারা হোম! লাইফস্টাইলের ভারসাম্য রক্ষায় বাজারে এল ছদ্ম-অফিস
ইতিমধ্যেই পশ্চিমের দেশগুলোয় এই ডোমেস্টিকেশনের সঙ্কট কাটাতে শুরু হয়েছে নানা কাণ্ড। বাজারে এসেছে ছদ্ম অফিস! আসলে ওয়ার্ক ফ্রম হোমই। কিন্তু ঘরে নয়, হোটেলে।
ঊষসী মুখোপাধ্যায়: এতদিন ঠিক এটাই চেয়েছিলাম! বাড়িতে আরেকটু বেশি সময় কাটাতে চেয়েছি। রোজকার দৌড়দৌড়ি থেকে দুদণ্ডের বিশ্রাম চেয়েছি। পরিবারের সঙ্গও তো কম চাইনি! শহুরে মধ্যবিত্তের জীবন থেকে ফুরসত উধাও হয়েছে বেশ কয়েক দশক আগেই। কতবার বলেছি, কয়েকদিন ছুটি নিয়ে স্রেফ বাড়িতে থাকতে চাই।
কিন্তু আজ যখন ওয়ার্ক ফ্রম হোম 'নিউ নর্ম্যাল' হয়ে যাচ্ছে, তখন এত হাঁসফাঁস লাগছে কেন? বাড়িতে কাজ করলেও সেটা অবশ্যই পরিশ্রম। ছুটি নয় মোটেই। কিন্তু ড্রয়িংরুমে বসে কাজ করার মধ্যে সেই বহুকাঙ্খিত ফুরসতের আমেজ একটু হলেও তো আছে! আজ তাহলে অসুবিধেটা কোথায় হচ্ছে? কেন ওয়ার্ক আর হোম দুটোই এত বিরক্তিকর লাগছে?
অফিস নয়, বাড়িও নয়। অসুবিধের প্রধান কারণ আমাদের লাইফস্টাইল। বহুদিন ধরে একটু একটু করে যে ওয়ার্ক-লাইফ ব্যালেন্স আমারা তৈরি করেছিলাম, একধাক্কায় সেটা চুরমার করে দিয়েছে কোভিড নাইনটিন। ফলে 'ওয়ার্ক' ব্যাপারটা যেমন গুলিয়ে গিয়েছে, তেমনই 'হোমের' আমেজও দুরমুশ।
স্বীকার করুন বা না করুন, অফিস-স্পেস যে অনেকাংশেই একটা এসকেপ রুট। বাড়ি থেকে এসকেপ। ব্যক্তিগত হাজারো সমস্যা থেকেও খানিকক্ষণের দূরত্ব! এতদিনে এটুকু বুঝেছি, সকালের ঝগড়াঝাটি বিকেল পর্যন্ত না-গড়ানোর একটা বড় কারণ অফিসের এই দূরত্বটাই।
মনে করে দেখুন, বড়রা একসময় বলতেন কাজে ডুবে থাকলে মন ভালো থাকে। রোজকার ঝঞ্ঝাট থেকে ডিসট্র্যাকশন। ম্যারিটাল কম্পালশনগুলো থেকেও ক্ষণিকের দূরত্ব। সর্বক্ষণ একছাদের তলায়, একসঙ্গে থাকতে আমরা আর অভ্যস্ত নই। আমাদের মানসিক ভাবে একটু দূরত্ব দরকার। ব্যক্তি-মানুষের নিজস্ব সেই এসকেপ রুটটা তৈরি করে দিয়েছিল আমাদের এই অফিস।
কিন্তু এখন, সে গুড়ে বালি। ফলে, লাইফস্টাইলের টানটান সুতোটা একটু একটু করে ভারসাম্য খোয়াচ্ছে। টুইটার ইতিমধ্য়েই সংস্থার সব কর্মীকে আজীবন ওয়ার্ক ফ্রম হোম করার স্বাধীনতা দিয়েছে। ফেসবুক ঘোষণা করেছে, আগামী এক দশকের মধ্যে সংস্থার অর্ধেক কর্মীকে পাকাপাকি ভাবে বাড়িতে কাজ করার অনুমতি দেবে।
বহু সমাজতত্ত্ববিদ বলছেন, কর্পোরেট চাকুরেদের উপর এই দীর্ঘ ওয়ার্ক ফ্রম হোমের বিরূপ প্রতিক্রিয়া হতে বাধ্য। এর প্রভাব পড়ছে কাজের মানেও। তাঁদের মতে, কালেকটিভ ওয়ার্ক, মানে যেখানে সবাই ব্যস্ত, সবাই কাজ করছে, সেখানে আপনার প্রোডাকটিভিটি অনেকাংশেই বেড়ে যায়। মনঃসংযোগে সাহায্য় করে। যে ডেস্কে বসে কাজ করেন, আপনার মস্তিষ্ক সেই ডেস্কটাকে প্রোডাকটিভিটির সঙ্গে একাত্ম করে দেয়। কিন্তু এখন দু'কামরার ফ্ল্যাটের দুটো ঘরে ল্যাপটপে মুখ ডুবিয়ে বসে আছেন স্বামী-স্ত্রী। কিংবা যেখানে বসে আপনি সাধারণত ডিনার খান, আজ থালার জায়গায় বসেছে ল্যাপটপ। ঘরে হয়তো আপনার বাড়ির খুদে সদস্য রাইমস মুখস্থ করছে, বা ব্যাট-বল পেটাচ্ছে! এতে না রাইমসটা ঠিকঠাক হচ্ছে, না আপনার কাজ!
তাহলে উপায়? উপায় আছে!
ইতিমধ্যেই পশ্চিমের দেশগুলোয় এই ডোমেস্টিকেশনের সঙ্কট কাটাতে শুরু হয়েছে নানা কাণ্ড। বাজারে এসেছে ছদ্ম অফিস! আসলে ওয়ার্ক ফ্রম হোমই। কিন্তু ঘরে নয়, হোটেলে। লকডাউনে বাড়িতে বন্দি মানুষজন অফিস করার জন্য হোটেলের ঘর ভাড়া নিচ্ছেন। নিজের মতো করে খুঁজে নিচ্ছেন বহুকাঙ্খিত ব্রেক! বলাই বাহুল্য, এর ফলে লকডাউনে মাছি তাড়ানো হোটেলগুলোও হাতে চাঁদ পেয়েছে। তবে হ্যাঁ, স্বাস্ব্যবিধি মানতে হবে। একটা ঘরে একজনই কাজ করতে পারবেন।
আমাদের দেশে এমন সর্বজনীন ওয়ার্ক ফ্রম হোম এই প্রথম। কিন্তু আমেরিকার টেক-ইন্ডাস্ট্রিতে বাড়িতে বসে কাজ করা খুবই সাধারণ ব্যাপার। ২০১৫ সালে এই ধরণের কাস্টমারদের জন্য সে দেশে তৈরি হয় হোটেল বাই ডে নামে একটি সংস্থা। এরা দিনের বেলার জন্য, সকাল ১০টা থেকে রাত ৮ টা পর্যন্ত হোটেলের ঘর ভাড়া দেয়। আমেরিকার এই আইডিয়া এখন বিশ্বজনীন। ২০১৬ সালে ২৬০টি শহের ৫০০-রও বেশি এমন হোটেল শুরু হয়েছে।
এই সংস্থা বলছে, লকডাউনের পর থেকে হু-হু করে বাড়ছে তাদের ব্যবসা। আগের থেকে ৯০% বেশি অতিথি আসছেন। সোল্ড আউটও এখন আর বিরল ঘটনা নয়। সুযোগ বুঝে ঘর-বুকিংয়ের সঙ্গে নিখরচার স্ন্যাক্সের অফারও দিচ্ছে হোটেলগুলো।
জুন-জুলাইয়ের পরিসংখ্যাণ বলছে, লস অ্যাঞ্জেলেস থেকে ইতালির লেক কোমো পর্যন্ত, হোটেল ভাড়ার হিড়িক চোখে পড়ার মতো। ক্রেতার মন বুঝে কৌশলী পথে পা বাড়িয়েছে ছোট থেকে বড় সব হোটেলই। অফিসের জন্য মাস-ভিত্তিক ভাড়ার ব্যবস্থাও শুরু হয়েছে অনেক জায়গায়। হাই প্রোফাইল কাস্টমারদের কথা মাথায় রেখে জন্য বেভারলি হিলসের নামকরা হোটেল 'দ্য লন্ডন' পয়লা জুন থেকে আস্ত একটা প্যাকেজই ঘোষণা করে ফেলেছে। নাম, 'অফিস অ্যাট দ্য় লন্ডন'। এককথায় হোটেল-অফিস! কী আছে সেই প্যাকেজে?
অন্তত ৭২৫ স্কোয়ার ফিটের একটা ঘর। সকাল ১০টায় চেক ইন, সন্ধে ৬টায় চেক আউট, সঙ্গে ফ্রি কফি এবং ওয়াইফাই। দক্ষিণা মাসে ৫,০০০ ডলার!
অনেক বহুজাতিক সংস্থাই কর্মীদের স্বস্তির কথা ভেবে এই হোটেল অফিসের ভাড়া মেটাতেও সম্মত হয়েছে। একই কৌশল নিয়েছে ওয়াশিংটনের ৩১৮ ঘরের হ্যামিলটন হোটেলও। সেখানে শুরু হয়েছে 'HOME AWAY FROM HOME OFFICE'। তারা ভাড়া নিচ্ছে দিনের হিসেবে। বিকেল ৪টে পর্যন্ত হোটেলে থাকা তো যাবেই। সকাল সকাল এলে ফ্রি ব্রেকফাস্টও পাবেন। কফি-টফিও মিলবে বিনামূল্যে।
আর যদি কেউ একলা, বদ্ধ ঘরে সারাদিন কাজ করতে না চায়?
তার জন্য 'কালেকটিভ প্রোডাকটিভির' ব্যবস্থাও হয়েছে! অফিস-অফিস একটা অনুভূতি এনে দিতে বহু হোটেলেই কনফারেন্স রুম, বলরুম কিংবা ব্যাঙ্কোয়েট হল খুলে দেওয়া হচ্ছে। এক্কেবারে অফিসের ধাঁচে ডেস্ক-চেয়ার বসানো হচ্ছে সোশ্যাল ডিসটেন্সিং মেনে। যাতে, অফির ফ্লোরের মতো একটা ইমেজে ক্লায়েন্টের কাজের গতি বাড়ে!
অফিস-বাড়ির সুস্থ দূরত্ব বজায় রাখার তাড়না যে বিশ্বজুড়েই মাথাচাড়া দিয়েছে এই ট্রেন্ডে তা স্পষ্ট। যার যেরকম ট্যাঁকের জোর, সেরকম অফিস-হোটেল খুঁজে নিচ্ছেন তাঁরা। সংসার আর চাকরি, দু জায়গাতেই স্বস্তি ফিরছে!
আমরাও কিন্তু প্রথমদিকে একটা ব্যালেন্স করার চেষ্টা করছিলাম। অবসর-উদযাপনের চেষ্টা করেছিলাম। পঞ্চব্যঞ্জন থেকে ডালগোনা, দিব্যি চলছিল। বেশ গান হচ্ছিল, নাচ হচ্ছিল, ছবি আঁকা, আবৃত্তি... সবই ছিল। কিন্তু বন্দিদশা যত দীর্ঘায়িত হয়েছে, একে একে উদযাপন কমতে শুরু করেছে। জমাট বেঁধেছে বিরক্তি।
প্রাক-করোনা যুগে ওই যে, বাড়ির জামাকাপড় ছেড়ে বাইরের পোশাক গায়ে চাপাতেন, কিংবা রাস্তায় বেরিয়ে দুটো লোকের মুখ দেখতেন, কিংবা অটো-বাসের লাইনে একসুরে সবাই মিলে ক্ষোভ উগরে দিতেন... তাতেও বিরক্তি ছিল ঠিকই, কিন্তু সঙ্গে মনের অগোচরে অফিস আর বাড়ির মাঝখানে একটা বাফার জোন তৈরি হয়ে যেত। দুটোকে আলাদা করে রাখাতো এই বাফার জোন।
তা এখন বাফার যখন উধাও, তখন ফেক-বাফার তৈরি করে দিয়েছে এই হোটেল-অফিস। ছদ্ম-অফিস ঠিকই। তবু এই অভিনব বিভাজনে অফিস-বাড়ি দু'জায়গাতেই স্বস্তি তো থাকছে!
এই চরম অসময়ে, এটুকু প্রাপ্তিই বা মন্দ কীসের!