হেঁটে এলাম সুজেটের সাথে

Updated By: Dec 11, 2015, 09:53 AM IST
হেঁটে এলাম সুজেটের সাথে
ছবি: সৌরভ

স্বরূপ দত্ত

 

আজ অফিস থেকে বেরিয়ে আর বাড়ির দিকে পাটা গেল না। রোজকার চায়ের দোকানে আজও চুমুক দিলাম বটে। কিন্তু চা-টা কী বাজে যে রোজ খাই, সেই হুঁশ, ফিরে পাওয়াও হয়নি আজ। মনে হল, আজ রাতে বাড়ি নয়। আজ মনের গন্তব্য একটাই। পার্কস্ট্রিট।

৫ ফেব্রুয়ারি ২০১২-র রাতে শহর কলকাতা, রাজ্যের কিংবা দেশের মানুষের মনে যে ঈশ্বরকণা ছুটে বেরিয়ে গিয়েছিল, ২০১৫-র ১০ ডিসেম্বর তো আসলে সেই ঈশ্বরকণাই ঘরে ফিরল। মিশে গেল সেই আগের জায়গায়! সেই রাতে ধর্ষণ নামের ঝড় লন্ডভণ্ড করে দিয়েছিল সুজেটের জীবনটা। সেই ঝড় আছড়ে পড়েছিল সভ্য সমাজের মনেও। ৬ ফেব্রুয়ারি সারাদিন সেই যে টেলিভিশনে দেখা শুরু হয়েছিল খবর, পার্কস্ট্রিট নামটা যেন সেই থেকে একেবারে পাড়ার রাস্তার নাম হয়ে গিয়েছিল। শুধু আমার কিংবা আমার পাশের মানুষের না মনে হয়। গোটা রাজ্যের মানুষ সারাদিনে একবার হয়তো বলেই ফেলত, 'পার্কস্ট্রিট'!

মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সেই যে বললেন, 'সাজানো ঘটনা', তারপর থেকে 'কনে সাজানো' শব্দটাও এখন সাজানো 'ঘটনা' শব্দের থেকে ফিকে হয়ে গিয়েছে। কত কথা শুনেছি গত ৩ বছর ১০ মাসে। আজ অর্থাত্‍ ১০ ডিসেম্বর ২০১৫ তে সেই পার্কস্ট্রিট কাণ্ডের, রাজ্যের কঠোর বাস্তব চ্যানেলে মেগা সিরিয়ালটা যেন জানিয়ে দিল। শেষে কী হবে জানিয়ে দেওয়া হল আজ। কিন্তু এত দিনের মেগা। এত এত টিআরপি। মেয়ে, বুড়ো, ছেলে, বউ, সবাই গোগ্রাসে গিলেছে। মানে, হয় দেখেছে, না হয় শুনেছে। তার জন্য গল্প শেষ হওয়ার পরও একটা দিন এক্সট্রা না দেখালে হয়, যে, কে কী পুরস্কার পেল!

ঠিকই। ওই শাস্তিটা কী হল, সেটা দেখাই যা বাকি। বাদ বাকি সব তো হয়েই গেল। তার মানে এই জয় সুজেটের। এই জয় সুজেটের বাচ্চাদের। এই জয় সুজেটের পরিবার, আত্মীয় বন্ধুদের। তার মানে এই রাজ্যের প্রত্যেকটা মানুষের। তাহলে যে দিন বিচার সত্যিই হল, সেদিন কেমন রিঅ্যাক্ট করে কলকাতা, দেখার ইচ্ছে হল। সারাদিন টেলিভিশনে রিঅ্যাকশন দেখেছি। সকালে আবার খবরের কাগজে কিছু রিঅ্যাকশন দেখা যাবে। সবাই সবার প্রথম প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছে। জানাবে। কিন্তু নিজের অনুভূতিটা আজ একটু চেখে দেখব না? বিশেষ করে গত ৩ বছর ১০ মাস ধরে এই শহরের, এই রাজ্যের বাসিন্দা তো আমিও। তাই মনে হল, আজকের রাতটা পার্কস্ট্রিটেই কাটাবো। সুজেটের ছায়া মূর্তি ঠিক একবার ঘুরতে আসবে ওই নাইট ক্লাবের সামনে।

তাই সহকর্মী এবং ভাই, সৌরভকে সঙ্গী করা। দুজন বেরিয়ে পড়া মিশন পার্কস্ট্রিটের উদ্দেশ্যে। কিছুই না। রায় ঘোষণা তো হয়েই গিয়েছে। এক নারী সবার চাহিদা মতো সুবিচার পেয়েছেন। বিচারক পরিষ্কার করে বলে দিয়েছেন, রায় ঘোষণা করার সময় সুজেটের কথাকেই সবথেকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। তাহলে তো জয় সুজেটের। সেইজন্যই এই রাতের অভিজ্ঞতা মিস করার ইচ্ছে হল না। আগডুম বাগডুম ভাবতে ভাবতে ১২ টা নাগাদ পৌঁছেই গেলাম পার্কস্ট্রিটে। কিন্তু ডিসেম্বরের ১০-এও ঠাণ্ডা কোথায় শহরে! তাই অনেক লোকের ভিড় তখনও। দুলকি চালে হাঁটা শুরু করলাম ময়দানের দিক থেকে মল্লিক বাজারের উদ্দেশ্য। সংখ্যায় অল্প হয়ে আসা গাড়ি ভোঁ করে চলে যাচ্ছে পাশ কাটিয়ে।

শেষ কয়েকটা পান, বিড়ি, সিগারেটের দোকানে তালা পড়ছে। অলিপাবের সামনেটায় একটা পুলিশ জীপ দাঁড়ানো। তাতে রয়েছেন দুজন পুলিশ। সামনে গোটা তিনজন আরও সাদা নীল পোশাকে বসে। আর ওই ফুটপাথের রাস্তায় পোস্টে কোনওরকমে বসে রয়েছেন জনা চার পাঁচেক যুবক। যাঁদের কথা শুনে মনে হল, রোজই বসেন রাতটায় এখানে। এই ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা ভাবেও এই রাস্তায় বসে থাকার কারণ একটাই। ওয়াইফাই। বেশ লাগছিল দেখতে। রাত বাড়ছে। একটা বেজেও গেল দেখতে দেখতে। ওয়াইফাইয়ের অমোঘ টানে তিন-চারজন যুবকই পাশাপাশি বসে এক মনে মাথা নিচু করে মোবাইল ঘাঁটছেন। তাঁদের বাকি পৃথিবীর সঙ্গে কোনও সম্পর্ক নেই। দুজন পুলিশ একটু কম বয়সের। মাথা নিচু তাদেরও। তাঁদের মোবাইলে আঙুলের ছোঁয়ার গতি দেখে মনে হচ্ছিল, ইস মোবাইল যদি স্পর্ষকাতর বিষয় হতো, দিব্যি হতো। তেমনটা হওয়ার সম্ভবনা নেই।

স্পর্শকাতর বিষয় তো মেয়েদের রেপ করা বটেই। তার উপর পার্কস্ট্রিট কাণ্ড। গত ৩ বছর ১০ মাসের কলকাতার একটা ঘটনাও বলতে বলা হলে, সেটা পার্কস্ট্রিট। একটা ঘটনা নিয়ে এত মিডিয়া হাইপই হোক, বা সাধারণের আলোচনার বিষয়, পার্কস্ট্রিট থাকবেই। সেই রাস্তাটা দিব্যি রয়েছে এখন। সুজেটের শরীরে ক্ষত চিহ্ন ছিল।কিন্তু কালো পিচের মসৃণ রাস্তায় কোনও ছড়ে যাওয়ারও দাগ নেই। বরং, মেজাজ বিন্দাস। গাড়িতে গুম গুম করে নতুন হিন্দি গান বাজছে। গাড়ির মধ্যে থেকে কখনও কখনও হুল্লোড়ের আওয়াজ। ট্রিঙ্কাসের পর থেকেই বসে রয়েছে পুলিশ। বিলাসী হোটেল থেকে বেরিয়ে আসছেন সমাজের উঁচু স্তরের মানুষ। যাঁদের রাতটা এমনই কাটে। যাতে জীবন কম মায়া বেশি। যাদের কখনও কিছু হয়ে গেলে, পৃথিবী থেকে চলে গেলে, সাধারণ বলবে, মানুষগুলো এমনই ছিল। গেলেও বা কী না গেলেও বা কী!

সুজেটের মতোই। আজ তিনি জিতেছেন। অথচ, কী কপাল, তিনি পৃথিবীতেও নেই। কিন্তু সেই একই নাইট ক্লাবের মধ্যে থেকে প্রতি দু মিনিটে বেরিয়ে আসছেন একের পর এক উচ্চবিত্তের সুন্দরী। অন্তত, তাঁদের পোশাকে তেমনটাই মনে হয়। কখনও বাইরে এসে গাড়িতে উঠে বসার আগে পাশের পুরুষের সঙ্গে ফিল্মি স্টাইলে খুনসুটি। অথবা বলা যায়, কেমন যেন একটা। লোকে দূর থেকে অমন করলেও মনে হল, ওরাও মানুষ হলে আমরাও কি মানুষ? একই শহরে থাকি বটে আমরা সবাই। কিন্তু চালচলনে কত রকমফের। কারও কোনও হুঁশই নেই, বছর চারেক আগেই এরকম একটা রাতে ঘটে গিয়েছিল সেই ঘটনাটা। রেপ, না রেপ নয়, সাজানো ঘটনা, মহিলার চরিত্রই খারাপ, খারাপ বলে কি রেপ করা যায় নাকি! কেন ওই মহিলা গিয়েছিলেন আর এক নেতার বাড়িতে। দময়ন্তী সেন কী ভালো মানুষ। সেইজন্যই তো তাঁকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। কত কত কথা। যে যার মতো করে পেরেছে, বলেছে। আর অবশ্যই মোমবাতি মিছিল।

তা ওই মোমবাতি মিছিলের কথায় মনে পড়ল। রাত ৩ টে পর্যন্ত পার্কস্ট্রিট চত্বরেই কাটালাম। একই দৃশ্য। সৌরভ ছবি তুলছিল বলে পুলিশরাও রাতে একটু কথা বলার সঙ্গী পেল। দু-একটা হালকা দুলকি চালের কথা। সেখানে নো পার্কস্ট্রিট, নো সুজেট। আর ওই অত রাতেও ঠিক দুজন পোস্টের নিচে বসে মোবাইলে আঙুল ঘসছে। আর সেই নাইট ক্লাবের সামনে মাঝে-মাঝেই খিলখিল হাসি নিয়ে বেরিয়ে আসছেন রঙ বেরঙের ছোট পোশাকের তরুণী। হাতে হাত, কোমরে হাত দিয়ে একসঙ্গে চার পা কোনওরকমে হেঁটে চলার পরই গাড়িতে উঠে যাওয়া। এইসব দেখতে দেখতে দেখতে এগিয়ে এলাম ট্রিঙ্কাস পেরিয়ে। বছর ২৪-২৫-এর দুই বন্ধু। পাশাপাশি বসে। জিজ্ঞেস করলাম, কেন এত রাতে এখানে? সন্দীপন কর্মকার থাকে দত্তপুকুরে। ছবি তুলতে বেরিয়েছে রাতের শহরের। সঙ্গী অভিজিত্‍ ঘোষও তাই। সে অবশ্য টালিগঞ্জে থাকে। দুজনে একসঙ্গে ছবি তুলে সকালে যে যার বাড়ি যাবে। আজকের রাতটা কি একটু স্পেশাল নয়? বিশেষ করে সুজেট যখন মৃত্যুর পরও বিচার পেলেন? এই কথা শুনে সন্দীপন, অভিজিতের সরল স্বীকারোক্তি। 'আমরা এই জানলাম।তাই? আজ রায় বেরিয়েছে? কাল শাস্তি!' বুঝলাম, ওরা সমাজটা থেকে কত দূরে আছে। ১০ ডিসেম্বর রাতে আজকের ডেটের দুই ২৫ এর যুবক খোঁজও রাখছে না সুজেটের। পার্কস্ট্রিটে বসেই! বোধহয়, আমার মুখ দেখে সামান্য গিল্টি ফিল হল সন্দীপনের। নিজেই বলল, 'সেই সময় কলেজে পড়তাম। আমিও মোমবাতি নিয়ে মিছিল করেছিলাম। ইস, আজ জানিও না!'বললাম, সত্যিই তোমরা কী অদ্ভূত না? সকালে ফেসবুকে বসে, ঠিক কত কত কথা বলবে, এই পার্কস্ট্রিট, সুজেটকে নিয়ে? সবাই সব খবরে থাকবে। কিন্তু অনুভবটা আর কেউ করবে না!কারও একবার আজকের রাতটায় একটু হেঁটে এসে বাড়িতে সবার সঙ্গে শেয়ার করে বলতে ইচ্ছে করবে না যে, 'আজ সুজেটের সঙ্গে হেঁটে এলাম!'

সত্যিই, এই অনুভূতিটা মিস করতে চাইনি। জানি, আজ সকাল থেকে সবাই যে যার কাজে লেগে পড়বেন। পার্কস্ট্রিট সকলের আলোচনায় থাকবে। পার্কস্ট্রিট কত মানুষের কাজের অঙ্গ হয়ে থাকবে। পার্কস্ট্রিট কাণ্ড নিয়েই টেলিভিশনে সারাক্ষণ কত কত মানুষের বাইট দেখানো হবে। কিন্তু সুজেটের জয়ের দিনে, ওর সঙ্গে পার্কস্ট্রিটের রাস্তায় হেঁটে বেড়ানোর অনুভূতিটা যে, আমি আর সৌরভই নিয়ে এলাম। তার রেশ যে চিরকাল থেকে যাবে। গত ৩ বছর ১০ মাসে যারা রাস্তায় হেঁটে ছিলেন, তাঁদের কেউ কেউ ১০ ডিসম্বরের রাতটা পার্কস্ট্রিটে কাটিয়ে যেতে পারতেন। এমন কিছু শরীর খারাপ হত না। এই ফেসবুক আন্দোলন আর খবরটা ছেড়ে বেরিয়ে এবার সত্যিই আমাদের একটু অনুভব করার সময় হয়েছে। না হলে সারাদিন শুনব, এত বড় জয়। আর তার সেলিব্রেশন হবে নাক ডেকে ঘুমিয়ে! নিতে পারলাম না জাস্ট। এভাবে চললে, কাল আরও একটা সুজেট। আবার কিছু লোকের মোমবাতি মিছিল। আবার খবর। আবার পরেরটা। এভাবেই ঈশ্বরকণার গতিতে আমাদের অনুভূতিগুলো চলে যাবে। খুব একটা বাকি অবশ্য নেইও যাওয়ার। অফিসে ভোরবেলায় ঢুকে মেশিনটা খুলতে যেতে সহকর্মীই প্রথম জিজ্ঞেস করল। 'কী আজ পার্কস্ট্রিটে কোনও খবর ছিল নাকি রাতে!'

মনে মনে হাসলাম। শুধু খবর হচ্ছে। কেউ আর অনুভব করছি না আমরা। তাই কোনও কিছুতেই আমাদের কোনও প্রতিক্রিয়া নেই, রাতে। তখন যে মিডিয়া থাকে না। ক্যামেরা সামনে না থাকলে, আমার ঘরই ভালো। আর ক্যামেরা এলে? চলো শুরু করা যাক আমাদের আজকের স্মরণসভা আর মোমবাতি মিছিল। এমন কেন হল? জবাব চাই। বলে ঘুমোতে যাই। ঘুমোক সবাই। সুজেটও। আমরাও। আর থাকল পরে দোষীরা? থাক, ভুল হয়ে গিয়েছে। সুজেটের গায়ে কোন জায়গাটায় লাথিটা মারা হয়েছিল, কোন জায়গাটায় অত্যাচার করা হয়েচিল, সেটাই যখন দেখতে ইচ্ছে করল না বিচারের এমন জয়ের রাতটায়, তাও শহরের সেরা রাস্তাটায় গিয়ে। অথচ, দু সপ্তাহ বাদেই এ শহরের কত মানুষ সারাটা রাত কাটাবেন ওই রাস্তাতেই। অত বড় দিনের কাছে এসব ছোট দিনের কোনও মানে আছে!সেখানে নাসের খান, সুমিত বাজাজ, রুমান খানের কথা ভাবতে কারও বয়েই গিয়েছে। তাই চলুন সবাই ঘুমাই। সকাল থেকে খবর নেব সবকিছুর। এবার একটু ঘুমোই। আজ রাতে হাঁটতে হাঁটতে সুজেটের কাল্পনিক কথাগুলো কানে বাজছে। সেগুলো একটু নিজেই ভালো করে অনুভব করে নিই। সাজানো ঘটনার চক্করে পড়ে, মানুষটার জীবন-মরণ সব অগোছালো হয়ে গিয়েছে যে। তাই তাঁর জয়ের পরও আফশোসটা যাচ্ছে না। 

.