#উৎসব: বাঘাযতীনের হাতে শুরু হওয়া সমিতির পুজো পা রাখল ৯৪-য়ে
পাথুরিয়াঘাটার এই সাবেকি কালীপুজোয় যুক্ত ছিলেন স্বয়ং নেতাজিও।
নিজস্ব প্রতিবেদন: একদিকে বনেদি পাড়া, আর একদিকে সাধারণ ও তস্য সাধারণের অকিঞ্চিৎকর গণকল্লোল। নেপথ্যে রিকশার ঠুং-ঠুং, ঠেলাওয়ালার চিৎকার; হারমোনিয়ামের কম্পন, তান-কর্তবের বন্যা। এখানে অভিজাত কলকাতার খোলস থেকে ক্রমশ বেরিয়ে আসে অতি-সাধারণ এক শহরের চেনা গণমুখ। দেশকাল-ভাঙা এই সন্ধিতেই মহীয়ান পাথুরিয়াঘাটার সাবেকি কালী আরাধানা, লোকমুখে যা 'বড়কালী' পুজো।
'বড়'? তা, বড় বইকি। প্রতিমার ৩১ ফুট উচ্চতাটা তো এখানে নিছক এক বাহ্যিক বৈভব, সাধারণ বড়ত্ব; যে কালীপুজোর সঙ্গে জড়িয়ে বাঘাযতীন, সুভাষচন্দ্রের নাম, সে পুজো তো সততই মহান, অ-সাধারণ, অভিজাত। ১৯২৮ সালে পাথুরিয়াঘাটায় প্রতিষ্ঠা হল পাথুরিয়াঘাটা ব্যায়াম সমিতি। প্রতিষ্ঠাতা বিপ্লবী বাঘাযতীন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত এই সমিতিতেই শুরু হয়েছিল এই কালীপুজো। সুভাষচন্দ্র বসু এই পুজোর সভাপতিও হয়েছিলেন ১৯৩০ সালে।
আরও পড়ুন: #উৎসব: ডাকাতরা মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে রক্তচক্ষু মা কালীর মুখ দেখতে পেল!
বাংলার পুজো-পার্বণের সঙ্গে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ও স্বাধীনতা সংগ্রামের যোগাযোগটা অবশ্য নতুন নয়। বঙ্কিমি আঙ্গিকে এবং পরে শ্রীঅরবিন্দের ভাবনায় এই সংযোগ এক উচ্চ ও বিচিত্র রূপকল্প ধারণ করেছিল। সেই ঐতিহ্যই যেন অন্য ভাবে ও অন্য আঙ্গিকে ধরা পড়েছিল পাথুরিয়াঘাটার এই পুজোতেও। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিপ্লবের কর্মকাণ্ডের মধ্যে দিয়েই কলকাতার বেশ কিছু ক্লাবের জন্ম। বিপ্লবীদের নিজেদের প্রস্তুত করার জন্যই তৈরি হত এই সব অনুশীলন সমিতি, গুপ্ত সমিতি। সেই সমিতিগুলির হাত ধরেই পরে পরে কোথাও কোথাও শুরু হয় (দুর্গা বা মূলত) কালীপুজো। এই ধরনের পুজোগুলির মধ্যে অনেকগুলিই দীর্ঘস্থায়ী হয়। তেমনই একটি পুজো এই পাথুরিয়াঘাটা ব্যায়াম সমিতির বড়কালী পুজো। ৯৩টি হেমন্ত অতিক্রম করে এ বছর ৯৪-য়ে পা দিল এই পুজো।
জানা যাচ্ছে, পাথুরিয়াঘাটায় অতুলকৃষ্ণ ঘোষ ও বাঘাযতীন মিলে তৈরি করেছিলেন এই সমিতি। ১৯০৮ সালে বাঘাযতীন নাকি এখানে কালীপুজোর আয়োজনও করেছিলেন। যদিও তা নিয়ে বিতর্ক আছে, সংশয়ও আছে। যাই হোক, এর পরই আলিপুর বোমা মামলা-সহ আরও নানা মামলার জেরে ব্রিটিশ সরকার বাংলায় যে কোনও ধরনের অনুশীলন সমিতি বন্ধ করে দেয়। বন্ধ হয়ে যায় অনুশীলন সমিতির শাখা সংগঠনগুলিও। ভেতরে ভেতরে বিপ্লবীদের নানা বৈঠক বা কর্মসূচি চলতে থাকলেও প্রকাশ্যে পুজো বা কোনও ধরনের কর্মসূতি পালিত হত না। ফলে পাথুরিয়াঘাটা ব্যায়াম সমিতির প্রকাশ্য কাজকর্মও বন্ধ হয়ে গেল। বন্ধ হয়ে গেল পুজোও। ১৯১৫ সালে মারা গেলেন বাঘাযতীন। জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পরে অতুলকৃষ্ণ ঘোষ ১৯২৮ সালে কালীপুজো শুরু করলেন। এর পর থেকে একটানা পুজো হয়ে আসছে। তাই ১৯২৮ সালটিকেই এই পুজোর প্রারম্ভিক সাল হিসেবে ধরা হয়। ১৯৩০ সালে এই পুজোর সভাপতিত্ব করেন স্বয়ং নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু!
পাথুরিয়াঘাটা ব্যায়াম সমিতির সূত্রে জানা যায়, এই দুই অতি বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব ছাড়াও তাদের এই সমিতি এবং সমিতির শ্যামাপুজোর আরাধনার সঙ্গে জড়িয়েছিলেন আরও কিছু বিশিষ্ট মানুষ। যেমন, নাটোরের মহারাজ, লালগোলার মহারাজ, ভূপেন্দ্রনাথ বসু, অশ্বিনীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, গৌরীনাথ শাস্ত্রী, বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র প্রমুখ। এই কালীপুজো কলকাতার অন্যতম প্রাচীন কালীপুজো বলে জানান উদ্যোক্তারা। তাঁদের পুজোকে কেন্দ্র করে পুরনো নিয়ম মেনেই শাস্ত্রীয় সঙ্গীত ও সানাইবাদনের আয়োজন থাকে। পুজোর পরদিন অন্নকূটের আয়োজন হয়ে চলেছে ১৯৯৬ সাল থেকে।
একত্রিশ ফুটের এই প্রতিমার হাতে ৬ ফুটের খাঁড়া। তা আবার রুপোর। কানের দুল, নাকের নথ সবই সোনা অথবা রুপোর। বারোয়ারি পুজো হলেও বনেদি বাড়ির পুজোর মতোই এর আচার ও আয়োজন।
ফলে, তথাকথিত আধুনিক ও ট্রেন্ডি কলকাতার ভিতরের আদি ও অকৃত্রিম কলকাতাকে জানতে গেলে আপনাকে পৌঁছতেই হবে এই পুজোর চত্বরে। আর পৌঁছে গেলেই পুরনো কলকাতার ব্যাকড্রপে এক বিস্ময়কর শ্যামা-আরাধনার সাক্ষী থাকবেন আপনি।
(Zee 24 Ghanta App: দেশ, দুনিয়া, রাজ্য, কলকাতা, বিনোদন, খেলা, লাইফস্টাইল স্বাস্থ্য, প্রযুক্তির লেটেস্ট খবর পড়তে ডাউনলোড করুন Zee 24 Ghanta App)
আরও পড়ুন: #উৎসব: হঠাৎই পরিবেশনরত নববধূর পিঠ থেকে দুটো হাত বেরিয়ে এল!