Martyr's Day Rally: বাদলবাতাসময় শহরের রাস্তায় শুধু কালো-কালো মাথা, হাতে দলীয় পতাকা...
21 July Martyr's Day Rally: ছবিটা একেবারেই অন্যরকম। তিরিশটি বছর কি এরকমই চলছে? রাস্তাঘাটে একটা অন্যরকম উন্মাদনা। হাতে দলীয় পতাকা নিয়ে ছুটছেন রাজনৈতিক কর্মী-সমর্থকেরা। তিরিশটি বছর! কম নয়!
জি ২৪ ঘণ্টা ডিজিটাল ব্যুরো: ২১ জুলাই বৃষ্টি হবেই-- অরণ্যের প্রাচীন প্রবাদ। অনেকটা যেমন সেই বাঙালি মা-মাসিরা বলে থাকেন-- 'ওরে দশহরার দিন একটু বৃষ্টি হবে রে', 'রথযাত্রার দিন বৃষ্টি হবেই'। অনেকটা যেন তেমনই!তা, কথা সত্যিও হল বটে, বৃষ্টি তো পড়ল! তখন মঞ্চে স্বয়ং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনিও ভিজলেন, ছাতা নিলেন না মাথায়। কথা বলে চললেন, তাঁর স্বভাবসুলভ ঝাঁজালো ভাষণে তিনি লক্ষ লক্ষ মানুষকে মাতিয়ে দিলেন, আবার আশ্চর্যজনক ভাবে, ওই বিপুল জনসমষ্টিকে ১ মিনিট নীরবতাও পালন করালেন-- মণিপুরে অপমানিত নির্যাততার স্মরণে, বাংলার পঞ্চায়েত ভোটে নিহত রাজনৈতিক কর্মীদের স্মরণে।
আরও পড়ুন: Martyr's Day Rally: ফিরে দেখা ২১ জুলাই! তাজা রক্তে সেদিন ভিজেছিল শহরের রাজপথ...
কিন্তু তার আগে? তার আগে এ শহরের ছবিটা কেমন?
ছবিটা একেবারেই অন্যরকম। তিরিশটি বছর কি এরকমই চলছে? রাস্তাঘাটে একটা অন্যরকম উন্মাদনা। হাতে দলীয় পতাকা নিয়ে ছুটছেন রাজনৈতিক কর্মী-সমর্থকেরা। গাড়িঘোড়া আছে বটে শহরের রাস্তায়, কিন্তু তেমন যেন তাড়া নেই। কয়েক কিলোমিটারের মধ্য়েই ধর্মতলার মোড়ে তখন সমাবেশে ভিড়় বাড়ছে। গোটা শহর যেন সেই দিকেই। শুধু শহর কেন, গত দুদিন ধরে তো জেলাগুলোও শহরমুখী।
আজ রোদ নেই। বাদলবাতাস ঝিরঝির করে বইছে শহরজুড়ে। শহর জুড়ে খণ্ড খণ্ড শহিদস্মৃতি দিবসের নানা ছবি। উল্টোডাঙার সামান্য আগে, ১৫ নম্বরের কাছে, দেখা গেল এক সদ্য তরুণ, তাঁর হাতে তৃণমূলের পতাকা, তিনি দৌড়চ্ছেন। তখন খান্নামুখী একটি ছোট টেম্পো যাচ্ছিল তাঁর পাশ দিয়ে। গাড়িও থামল, ওই সমর্থকও থামলেন। এক সেকেন্ড পরেই সমর্থকের হাতের পতাকা চলে গেল ওই গাড়ির জানলায়। জানলায় সেটা বেঁধেই টেম্পো ছুটল।
আজ শহরের সব রাস্তার পাশেই বড় বড় বাস দাঁড়িয়ে। যাঁরা সমাবেশে পৌঁছতে পেরেছেন, তাঁরা পেরেছেন, যাঁরা পারেননি, তাঁরা বিভিন্ন জায়গায় জটলা করে দাঁড়িয়ে। রান্না হচ্ছে, বাতাসে রান্নার গন্ধ। মুখে খুশির ভাব। যদিও এগুলি সব ছোট জমায়েত। জেলা থেকে যাঁরা বড় দল পাকিয়ে এসেছেন তাঁদের রাখার ব্যবস্থা হয়েছে শহরেরই বিভিন্ন জায়গায়। ক্যাম্পের মতো ব্যবস্থা। রান্না-বান্না চলছে, খাওয়া-দাওয়া চলছে।
শহিদ দিবস ঠিকই। কিন্তু একটা আনন্দের আন্ডারটোনও এদিন থাকে। শহিদস্মৃতি তর্পণ হয় বটে, কিন্তু যাঁরা কোনওদিন শহরের মুখ দেখেননি, পা রাখেননি কলকাতায়, তাঁরা একটু ভ্রমণের স্বাদও নেন। শহরটা ঘুরে দেখে নেন কিছুটা। মেট্রোয় চাপেন। রাজনৈতিক অ্যাজেন্ডা নিয়ে শহরে পা রাখলেও শেষ পর্যন্ত তাঁদের মোড অফ অপারেশন যেন বদলে যায়। একটা যেন পিকনিক ভাব।
কিন্তু যাই হোক, এদিন কিন্তু কলকাতা জুড়ে শুধু কালো কালো মাথা। রাজনৈতিক নেতারা যেটা চান, ঠিক সেটাই। সাদা মাথার ভিড় নয়, কুচকুচে কালো মাথার ভিড়। বহু বছর আগে, তখন-বামফ্রন্ট নেতা রেজ্জাক মোল্লা একটু-একটু করে স্বদলের সমালোচনায় লগ্ন হচ্ছেন, বুদ্ধদেব-মডেলকে নস্যাৎ করছেন,তখন তিনি খুব তাৎপর্যময় একটা কথা বলেছিলেন-- 'কালো চুলের মদ্দ ছেলি'! এঁরাই আসলে যে কোনও রাজনৈতিক দলের সম্পদ। আজকের শহর-কলকাতা দেখে সে-কথা মনে হওয়া স্বাভাববিক। যে দিকে দৃষ্টি যায়, যত দূর যায় শুধু কুচকুচে কালো চুলের তরুণ ব্রিগেড-- ঠিক ওই 'কালো চুলের মদ্দ ছেলি'! কেননা, এঁরাই তো গায়েগতরে খেটে গ্রামে-গ্রামে, শহরে-জনপদে গঞ্জে-নগরে যে কোনও দলকে বাঁচিয়ে রাখে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, এ রাজ্যে তৃণমূলের সঙ্গে এখন ঠিক সেই গোষ্ঠীটাই রয়েছে। স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে তাঁরা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্ব মেনে নিয়েছেন, চলে এসেছেন তৃণমূলের পতাকাতলে। আজকের ২১-এর সমাবেশে তাঁদেরই স্বাভাবিক স্বতঃপ্রণোদিত অংশগ্রহণে উজ্জ্বল শহরের পথ-রাজপথ, পার্ক-গলি, লেন-বাইলেন।
এমন একটি জনসভা যেজন্য আয়োজিত হয় তার মূল কারণের সূত্রে আবহাওয়ায় বিধুরতা থাকেই, তবুও সমাবেশের মধুরতাও যেন থেকে যায় কোনও ভাবে। তাই যেন কিছুটা ধন্দে পড়ে একালের প্রজন্ম। তাদের কাছে ২১ জুলাইয়ের ঘটনা বা তাৎপর্য তত স্পষ্ট হয়ে হয়তো ধরা দেয় না। আসুন আজকের দিনে একবার পিছন ফিরে তাকানো যাক:
১৯৯৩ সাল। তখনও তৃণমূল কংগ্রেসের জন্ম হয়নি। হবে আরও ৫ বছর পরে। তখন রাজ্যে যুব কংগ্রেসের সভানেত্রী ছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। রাজ্যে তখন বামফ্রন্ট সরকার। মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা আনতে সচিত্র ভোটার কার্ডের দাবি তোলেন মমতা। সেই দাবি নিয়েই মহাকরণ অভিযানের ডাক দিয়েছিল যুব কংগ্রেস। দিনটি ছিল ১৯৯৩ সালের ২১ জুলাই। সেদিন সকাল ১০টা থেকেই জমায়েত শুরু হয়। মোট পাঁচটি এলাকা দিয়ে মিছিল করে এগোতে থাকেন যুব কংগ্রেসের কর্মী-সমর্থকেরা। রাস্তায় নামেন স্বয়ং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এছাড়াও ছিলেন সৌগত রায়, শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়, জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক, মদন মিত্রের মতো নেতারা। এদিকে যুব কংগ্রেসের মহাকরণ অভিযানকে আটকাতে যথারীতি পথে নামে পুলিসও। শহরের বিভিন্ন রাস্তায় তৈরি হয় ব্যারিকেড। আর বাধা পেয়েই উত্তপ্ত হয় পরিস্থিতি। বিভিন্ন জায়গায় পুলিসের সঙ্গে ধস্তাধস্তি শুরু হয় আন্দোলনকারীদের। প্রায় খণ্ডযুদ্ধের পরিস্তিতি। অভিযোগ, পুলিসকে লক্ষ্য করে শুরু হয় ইট ও পাথরবৃষ্টি। বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে পাল্টা কাঁদানে গ্যাসের শেল ফাটায় পুলিসও। ব্রেবোর্ন রোডে চলছিল এরকমই এক ধাক্কাধাক্কি এবং কাঁদানে গ্যাস ছোড়ার পরিস্থিতি। সেখানে ধোঁয়ায় অসুস্থ হয়ে পড়েন স্বয়ং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রায় রণক্ষেত্রের চেহারা নেয় মেয়ো রোড ও রেড রোডের সংযোগস্থলও। বোমাবাজি হয় বলেও অভিযোগ। আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয় পুলিসের ভ্যানে। অভিযোগ, পুলিসের দিকে মারমুখী হয়ে ছুটে যান যুব কংগ্রেসের কর্মী-সমর্থকেরা। আর অভিযোগ, তখনই, (ভয়ে বা মাথা ঠিক রাখতে না-পেরেই হয়তো) পুলিস গুলি চালিয়ে দেয়। তাতে মৃত্যু ১৩ জন যুব কংগ্রেস কর্মীর। ঘটনায় আহতও হন অনেকে। সেই শহিদদের ভোলেননি মমতা। সেই ১৩ জন শহিদকে আজও বছরের পর বছর ধরে স্মরণ করে চলেছে তৃণমূল কংগ্রেস। পাশাপাশি, প্রতিবছর এই মঞ্চ থেকেই নিজের দলের কর্মীদের আগামীদিনের কাজের গাইডলাইনডও দেন তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
আরও পড়ুন: TMC Shahid Diwas 2023: একুশের চোখে এবার চব্বিশের লড়াই
আজকের মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, আগামী লোকসভা ভোটে এনডিএ-র সঙ্গে লড়ার জন্য কদিন আগেই যে বৃহত্তর মঞ্চে সামিল হয়েছেন, ২৬টি দলের সেই সর্বভারতীয় জোটের কথা এদিনের মঞ্চ থেকে বলেছেন। সমবেত কর্মী-সমর্থকেরা সেই প্রতিজ্ঞাও নিয়েছেন। কিন্তু সব প্রতিজ্ঞা-স্মরণ-শপথ-নীরবতার মধ্যেই যেন উঁকি দিয়ে গিয়েছে বিপুল বহরের এক রাজনৈতিক সমাবেশে সামিল হওয়ার খুশি-আনন্দ-উজ্জ্বলতা। যার ছবি সারাদিন ধরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকল এ শহরের পথে-পথে।