জানেন, সরস্বতীপুজো কীভাবে একত্রে গেঁথে দিল রবীন্দ্রনাথ-সুভাষচন্দ্র ও জীবনানন্দকে?

জীবনানন্দ নিজেও ব্রাহ্ম আদর্শেই বিশ্বাসী ছিলেন। কিন্তু ছাত্রদের ধর্মাচরণে বাধা দেওয়ার বিরোধী ছিলেন তিনি।

Updated By: Feb 5, 2022, 01:11 PM IST
জানেন, সরস্বতীপুজো কীভাবে একত্রে গেঁথে দিল রবীন্দ্রনাথ-সুভাষচন্দ্র ও জীবনানন্দকে?

সৌমিত্র সেন

আজকের দিনে স্কুল-কলেজে মহা সমারোহে সরস্বতীপুজোর আয়োজন দেখে বোঝা কঠিন, একদা এক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই সরস্বতীপুজোর আয়োজন নিয়ে কী দুর্ঘটই না ঘটেছিল! আর ভেবে হয়তো আরও আশ্চর্য লাগবে যে, এই বিতর্কে জড়িয়ে পড়লেন রবীন্দ্রনাথ ও সুভাষচন্দ্রের মতো ব্য়ক্তিত্বও; এবং পরোক্ষে সেই বিতর্কের বলি হয়েছিলেন তরুণ কবি জীবনানন্দ দাশ। 

সময়টা ১৯২৮ সাল। এল বাগদেবীর আরাধনা-লগ্ন। কলকাতার অনেক ছাত্রাবাসেই ঘটা করে পালিত হত সরস্বতী পুজো। এই সময়ে সিটি কলেজের রামমোহন হস্টেলের হিন্দু ছাত্ররা ঠিক করলেন, তাঁরাও এবার সরস্বতী পুজো করবেন। শুরু হল প্রস্তুতি। কিন্তু এই পুজো করা নিয়ে ছাত্রদের সঙ্গে গোল বাঁধল কলেজ কর্তৃপক্ষের।

ব্রাহ্ম সমাজের আনন্দমোহন বসুর হাতে সিটি কলেজের প্রতিষ্ঠা। তাই এই কলেজের পিছনে নিয়ন্ত্রণ ছিল ব্রাহ্মসমাজের। সব ধর্মের ছাত্রদের পঠনপাঠনই চলত এখানে। তবে কলেজ ও ছাত্রাবাসের জীবনধারায় ক্ষীণ হলেও ব্রাহ্ম প্রভাব কিছুটা ছিলই। সেই প্রভাবের সূত্রেই রামমোহন হস্টেলে সরস্বতী পুজো তথা মূর্তিপূজা নিয়ে কড়া আপত্তি জানালেন কলেজ কর্তৃপক্ষ। অধ্যক্ষ হেরম্বচন্দ্র মৈত্র সরাসরি ছাত্রদের পুজো করার বিষয়ে সংযত হতে বললেন। 

ছাত্রদের মন গেল ভেঙে। তবে তাঁরা পুজোর আয়োজন করার জন্য ঐকান্তিক ছিলেন। ফলে কিছুটা ক্ষোভ এসেও দানা বাঁধতে শুরু করল। এই প্রেক্ষিতে ছাত্রদের দাবির সপক্ষে এসে দাঁড়ালেন স্বয়ং সুভাষচন্দ্র বসু। তিনিই তখন বাংলার তরুণ-তুর্কী নেতা। সবটা শুনে সুভাষ জানিয়ে দিলেন, সরস্বতী পুজো হবে।

কলেজটা ব্রাহ্ম-ভাবাপন্ন বলেই হয়তো রবীন্দ্রনাথও সেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আয়োজিত হতে চলা সরস্বতীপুজো নিয়ে এই অবস্থায় মন্তব্য করে ফেললেন। এমনিতে উদার ও সমন্বয়বাদী কবি এই বিতর্কে হাজির হলেন অনেকটা 'ছোট' আকারে; একেবারেই ব্রাহ্ম সমাজের নিছক এক প্রতিনিধি হিসাবে। তিনি 'দ্য সরস্বতী পূজা ইন দ্য সিটি কলেজ হস্টেল' শীর্ষক প্রতিবেদনে লিখলেন-- 'সিটি কলেজ ব্রাহ্মদের, এবং ব্রাহ্মরা প্রতিমাপূজক নহেন, এ-কথা প্রত্যেক ছাত্রই জানেন। কলেজ প্রতিষ্ঠার ৫০ বৎসর পরে হঠাৎ সেখানে প্রতিমা পূজা করার জন্য জিদ অশোভন।' 

অন্যদিকে সুভাষচন্দ্রের বক্তব্য ছিল-- কলেজের কর্তৃপক্ষ কখনোই নিজেদের ধর্মবিশ্বাস ছাত্রদের উপর চাপিয়ে দিতে পারেন না। এ বিষয়ে অ্যালবার্ট হলের সভায় তিনিও একটু কড়া ভাষায় বললেন, 'আলোকপ্রাপ্ত এবং অগ্রসর ব্রাহ্ম ভদ্রলোকেরা হিন্দু ছাত্রদের উপর নিজেদের ধর্মবিশ্বাস চাপিয়ে দেওয়ার জন্য এত নিচে কী করে নামলেন, আমি তা অনুধাবন করতে অক্ষম।'

এই রবীন্দ্রনাথ-সুভাষচন্দ্র বিতর্ক বহুদিন ধরেই ক্ষুণ্ণ করে রেখেছিল বাঙালির রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক পরিসর। এই দুই মহাব্যক্তিত্বের মধ্যেকার টেনশন ছুঁয়ে দিয়েছিল শিক্ষিত মধ্য়বিত্ত বাঙালির চিত্তকে। তবে এই বিতর্কের একটা পরোক্ষ ও নেতিবাচক ফল সরাসরি গিয়ে পড়ল তরুণ কবি জীবনানন্দের উপর!

জীবনানন্দের জীবনের প্রথম চাকরি সিটি কলেজেই। এখানে অস্থায়ী শিক্ষক ছিলেন তিনি। ইতিমধ্যেই (১৯২৭ সালে) প্রকাশ পেয়েছে তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ--'ঝরা পালক'। আর এর মধ্যেই তাঁর জীবনে নেমে এল বিপর্যয়। চাকরিটি খোয়ালেন তিনি। 

(চাকরি খোয়ানোর ঘটনাটি নিয়ে অবশ্য নানা মিথ প্রচলিত। ঠিক কী কারণে কবির চাকরি যায়, সেটা পরিষ্কার হয়নি কোথাও। অনেকে বলেন, কবিতায় অশ্লীলতার অভিযোগেই বহিষ্কার করা হয়েছিল তাঁকে। তবে) জীবনানন্দের বাবা সত্যেন্দ্র দাশকে সিটি কলেজের অধ্যক্ষ হেরম্বচন্দ্র মৈত্র নাকি এই সময়ে লিখেছিলেন-- আর্থিক কারণে আপাতত তাঁর ছেলেকে ছাঁটাই করা হলেও আবার যখন অধ্যাপক নেওয়া হবে, তখন তাঁকে নেওয়া হবে! 

কিন্তু হঠাৎ কেন এই আর্থিক সঙ্কট? 

সেই প্রশ্নের উত্তরই লুকিয়ে আছে সরস্বতী পুজো এবং তা নিয়ে রবীন্দ্র-সুভাষ বিতর্কে। 

এই বিতর্কের জেরে এবং সিটি কলেজ কর্তৃপক্ষের অনড় মনোভাবের ফলে রামমোহন ছাত্রাবাসে সরস্বতী পুজো মুলতুবিই রইল। তবে, সুভাষচন্দ্রের প্রত্যক্ষ উদ্দীপনায় কলেজের বাইরে সেই পুজো হয়েছিল বলেই শোনা যায়। এটা ভেতরে ভেতরে সিটি কলেজ কর্তৃপক্ষকে যতই ক্ষুব্ধ করুক , এর জেরে তাঁদের পক্ষে ছাত্রদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব ছিল না। তবে হস্টেলে পুজোর আয়োজন করার জন্য ৪ ছাত্রকে বহিষ্কার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন হেরম্বচন্দ্র। আর এর জেরে দেখতে দেখতে প্রায় সব হিন্দু ছাত্রই সিটি কলেজ ছেড়ে দিতে লাগলেন। স্বাভাবিক ভাবেই টান পড়ল কলেজের অর্থভাণ্ডারেও। আর এই সমস্যারই পরোক্ষ শিকার হলেন জীবনানন্দ এবং জীবনানন্দের মতো আরও কয়েকজন অস্থায়ী শিক্ষক। চাকরি গেল তাঁদের। 

প্রসঙ্গত, জীবনানন্দ নিজেও ব্রাহ্ম আদর্শেই বিশ্বাসী ছিলেন। কিন্তু শোনা যায় ছাত্রাবাসের হিন্দু ছাত্রদের নিজস্ব ধর্মাচরণে বাধা দেওয়ার বিরোধী ছিলেন তিনিও। তা হলে, কোনও ভাবে তাঁর এই মনোভাব কি পৌঁছে গিয়েছিল ছাত্রদের উপর খড়্গহস্ত কলেজ কর্তৃপক্ষের কানে? আর সেটাও কি ত্বরান্বিত করেছিল তাঁর বরখাস্ত-হওয়া? কে জানে? কে বলবে?

Zee 24 Ghanta App দেশ, দুনিয়া, রাজ্য, কলকাতা, বিনোদন, খেলা, লাইফস্টাইল স্বাস্থ্য, প্রযুক্তির লেটেস্ট খবর পড়তে ডাউনলোড করুন Zee 24 Ghanta App)  

আরও পড়ুন: #Netaji125: হৃদয়ে রক্তাক্ত ক্ষতের বীভৎসতা নিয়েই মহা-কালের দিকে মৃত্যুহীন এক যাত্রা তাঁর

.