আগুন (সপ্তমীর গল্প)
সৌম্য সিংহ
খাতায় কলমে পুজো শুরু হলেও উত্সবের রেশটুকু নেই কল্পনা বাজারে। কল্পনা বাজার শুনশান। পুজোর মুখেই ভয়াবহ আগুন গ্রাস করেছে কল্পনা বাজার।
অন্যবার আলো দিয়ে সাজানো হয়। বাজার ও ব্যবসায়ী কমিটির একটি বারোয়ারি পুজো হয়। পুজোর দিনগুলিতে বাজার থাকে জমজমাট। দশকর্মার বাজার বসে, ফুল-ফল আর পদ্ম’র মার্কেট। এবার সে সবের চিহ্ন নেই। পোড়া দোকানগুলো দাঁত বের করে কল্পনা বাজারের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে।
এ বাজারেই দোকান অরূপদার। তাঁতের শাড়ির দোকান—সত্যনারায়ণ শাড়ি সেন্টার। সারা বছর মাছি তাড়ান, পুজো আর পয়লা বৈশাখেই যা বিক্রি। স্বচ্ছল অবস্থা। বাড়তি পাওনা সপ্তমীর দিন খোঁচা খোঁচা দাড়ির ফাঁকে দৃশ্যমান হলদেটে দাঁত বের করে কল্পনারই নানা দোকান থেকে এটা সেটা কিনে বাড়ি ফেরা। এবার তেমনটা হয়নি। নতুন মাল পুড়ে ছাই। ঋণের বোঝা নিয়ে এখন পথে বসতে হয়েছে অরূপদাকে।
অরূপদার সংসার নেই। ভালবাসা আছে। রামবাগানের রানিকে ভালবাসেন অরূপদা। সমাজ রানিকে বেশ্যা বলে। লোকমুখের এই কলঙ্কই আটকে দিয়েছে রানি-অরূপদার সংসার। রানিই চাইনি অরূপদাকে কলঙ্কে জড়াতে। মনে মনে ভালবাসলেও থিস্তি-খেউর করে অরূপদাকে বহুবার দূরে সরাতে চেয়েছে রানি। কিন্তু ভবি ভোলবার পাত্র নন অরূপদা, লেজ নাড়তে নাড়তে রানির কাছেই ছুটে গিয়েছেন বারবার।
সর্বস্ব খোওয়ানোর পর অবশ্য রানির ঘরের দরজা মাড়াননি অরূপদা। বাড়িও ফেরেননি। আগুন লাগার দিন সর্বস্ব পুড়ে যেতে দেখে যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে দৌড়েছিলেন অরূপদা। জ্ঞানশূন্য সে দৌড়। কতক্ষণ দৌড়েছিলেন তা মনে নেই। তারপর নাম না জানা নদীঘাটের চাতাল। সেখানেই আশ্রয়। এ গ্রামের মানুষরা পাগল ভেবে অরূপদাকে কিছু বলেনি। বরং কেউ কেউ খাবার দিয়ে গেছে।
এখন নদীঘাটের চাতালে বসেই অঙ্ক কষেণ দিনরাত। আগুনের অঙ্ক। কিন্তু সে অঙ্ক মেলে না। এক-দুই-পাঁচ-ছয়, আগুনে ভস্মীভূত হয় বারবার। আর তখনই মাথা থেকে পা পর্যন্ত জ্বলতে থাকে। অঙ্কগুলো বদলে যায় শব্দে—অস্বস্তি-মুখ দেখানোর লজ্জা-ছাই ভবিষ্যত্-পোড়া কপাল...
আজ সপ্তমী। মনটা কিছুতেই স্থির করতে পারছেন না অরূপদা। ভারী চঞ্চলতা। এলোমেলো অক্ষর। এক-দুই-পাঁচ-ছয়ের হিসেব নিকেশ আজ আর শব্দও হচ্ছে না। দূর থেকে ভেসে আসছে ঢাকের শব্দ। জোয়ারের জলে সেই ঢাকের শব্দ মিলে মিশে একাকার। ছন্দ এনেছে চাঁদের মোহময়ী আলো। রানির চাঁদপানা মুখখানি ছায়াছবির মতো ভেসে উঠছে বারবার।
অরূপদা উঠে দাঁড়ান। এরপর রেডি-স্টেডি-অন ইওর মার্ক....
সারা শরীর জ্বলছে। সপ্তমীর আলো পিছনে ফেলে অরূপদা দৌড়চ্ছেন। ক্লান্তিহীন দিশাহীন সে দৌড়। মাঠ-ঘাট-রেলপথ-বড় রাস্তা পার করে অরূপদা দৌড়চ্ছেন...দৌড়েই চলেছেন।