`শিল্পের ক্ষেত্রে সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি নেতিবাচক`
চব্বিশ ঘণ্টার সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে রাজ্যের প্রাক্তন শিল্পমন্ত্রী নিরুপম সেন।
চব্বিশ ঘণ্টার সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে রাজ্যের প্রাক্তন শিল্পমন্ত্রী নিরুপম সেন।
অনেকেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জমি অধিগ্রহণের বিরোধিতা, সেজ-এর বিরোধিতার মধ্যে সাবেক বাম অভিমুখ দেখতে পান।
আমি মনে করি না এর মধ্যে কোনও বাম অভিমুখ আছে। প্রথমত, বামপন্থীরা কোনও দিনই সরকারি হস্তক্ষেপের বিরোধিতা করে না। জমি অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে সরকারি হস্তক্ষেপ জরুরি। এটা শুধুমাত্র শিল্পস্থাপনের জন্যে বা পরিকাঠামো নির্মাণের নয়। যাঁদের জমি, সেই কৃষকদের স্বার্থরক্ষার জন্যও সরকারের হস্তক্ষেপ খুবই জরুরি। কারণ জমির মালিকরা অল্প জমির মালিক হন। কিন্তু যাঁরা জমি কেনেন তাঁদের ক্ষমতা অনেক বেশি। ফলে এখানে একটা অসম প্রতিযোগিতা হয়। অন্যত্র বাজার যেখানে কাজ করে, জমির ক্ষেত্রে বাজার সেভাবে সক্রিয় নয়। অসম প্রতিযোগিতায় পড়ে জমির মালিকরা ক্ষতিগ্রস্ত হন। সেই কারণেই সরকারি হস্তক্ষেপ প্রয়োজন। সরকার যখন হস্তক্ষেপ করে তখন জমির মালিকের একটা অধিকার থাকে সরকারের কাছে উপযুক্ত মূল্য চাওয়ার বা পুনর্বাসন দাবি করার। যে মূল্য এবং পুনর্বাসন তিনি একটা বেসরকারি মালিকের কাছে চাইতে পারেন না। স্বভাবতই আমরা মনে করি, এক্ষেত্রে সরকারি হস্তক্ষেপটা জরুরি। সুতরাং এই যে একটা ধারণা প্রচার করা হচ্ছে যে, তৃণমূল কংগ্রেসও সাবেক বাম ধারণা নিয়ে চলছে তা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত। এবং বামেদের সম্পর্কে একটা ভ্রান্ত দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই এ রকম একটা ধারণার প্রকাশ ঘটছে।
রাজ্যে শিল্প টানার ক্ষেত্রে গুজরাটে নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে আপনাদের নীতিগত তফাত কোথায়?
দেখুন, গুজরাট এবং পশ্চিমবঙ্গ এক রকম নয়। বর্তমান পরিস্থিতিতে কেন্দ্রীয় সরকারের যে নীতি, সেই নীতির আমরা বিরোধিতা করি। কিন্তু সরকার চালাই যখন তখন সেই নীতির পরিধির মধ্যে দাঁড়িয়েই আমাদের কাজ করতে হয়। বর্তমানে সরকারের নীতি, সরকার শিল্পে নিজে বিনিয়োগ করবে না। বেসরকারি উদ্যোগই বিনিয়োগের প্রধান অবলম্বন। তা যদি হয় তাহলে সব রাজ্যকেই বেসরকারি বিনিয়োগ টানার চেষ্টা করতে হবে। সেক্ষেত্রে গুজরাট সরকারও যা করছে পশ্চিমবঙ্গ সরকারও তাই করবে। বেসরকারি বিনিয়োগ ছাড়া আমাদের পক্ষে সরকারি উদ্যোগে শিল্প করা সম্ভব নয়।
সব রাজ্যকেই এই একই নীতি গ্রহণ করতে হবে এবং বেসরকারি বিনিয়োগ আকর্ষণ করার জন্য প্রতিযোগিতায় নামতে হবে। সেই প্রতিযোগিতায় আপনি বলতে পারেন গুজরাট শিল্প বিনিয়োগ টানার ব্যাপারে কিছুটা এগিয়ে আছে। কিন্তু আমি মনে করি, অন্য ক্ষেত্রে গুজরাটের সাফল্য উল্লেখযোগ্য নয়। বিশেষ করে আপনি যদি মানবোন্নয়ন সংক্রান্ত রিপোর্ট দেখেন তাহলে দেখবেন গুজরাট অনেকটাই পিছিয়ে আছে। শিল্প স্থাপনের ক্ষেত্রে এই রিপোর্টেরও কিন্তু গুরুত্ব আছে। দক্ষ শ্রমিকের ক্ষেত্রেও পশ্চিমবঙ্গ এগিয়ে আছে। পরিষেবা এবং ম্যানুফ্যাকচরিং শিল্পে পশ্চিমবঙ্গে দক্ষ শ্রমিক আছে। অনেক সময়েই গুজরাটে অন্য রাজ্য থেকে দক্ষ শ্রমিক যায়। দক্ষ শ্রমিক থাকায় এই রাজ্য অ্যাডভান্টেজ পায়। আমাদের রাজ্যের ছেলেমেয়েদের দক্ষতা আছে যে সব ক্ষেত্রে সেই সব ক্ষেত্রে শিল্প নিয়ে এসে আমরা আমাদের রাজ্যের ছেলেমেয়েদের যেমন কর্মসংস্থান করতে পারি তেমনই বিনিয়োগকারীদের এই বলে আকর্ষণ করতে পারি যে, তাঁরা স্থানীয় দক্ষ শ্রমিক পাবেন। সুতরাং (গুজরাটের সঙ্গে) কিছু গুরুত্বপূর্ণ তফাতও আছে। আমাদের রাজ্যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি আছে, মানুষের মধ্যে সাধারণ ঐক্য আছে। যদি আমাদের রাজ্য সরকার সক্রিয় হয়, আন্তরিক হয় এবং তাঁদের একটা ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি থাকে, তা হলে পশ্চিমবঙ্গে শিল্প স্থাপন হতে পারে। সেই সম্ভবনা আছে পশ্চিমবঙ্গে।
গত ২০ মাসের অভিজ্ঞতায় বর্তমান সরকারের শিল্পনীতিকে দশে আপনি কত নম্বর দেবেন?
এই সরকারকে নম্বর দেওয়া খুব কঠিন আমার পক্ষে। কারণ এই সরকার গত ২০ মাসে যত বক্তৃতা করেছে, ভাষণ দিয়েছে তার তুলনায় কাজ তো সে রকম কিছু হয়েছে বলে আমার মনে হয় না। বরং যত দিন যাচ্ছে এমন কিছু বার্তা যাচ্ছে বিনিয়োগকারীদের কাছে যা আমাদের রাজ্যের পক্ষে খুবই ক্ষতিকর। সাম্প্রতিক কালে হলদিয়ায় যে ঘটনা ঘটেছে, দুর্গাপুরে যে ঘটনা ঘটেছে, তার আগে এই সরকার যখন বিরোধী দলে ছিল তখন তারা যা কাজ করেছে, হলদিয়া পেট্রো-কেমিক্যাল তালুক গড়ার বিরোধিতা করেছিল, রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে কেন্দ্রকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে যে তারা এই প্রকল্প গড়তে আগ্রহী নয়, ইনফোসিস-এর বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল অনুমোদনের প্রশ্ন, উইপ্রোর অনুমোদনের প্রশ্নে যে দৃষ্টিভঙ্গি এই সরকার গ্রহণ করেছে সবটাই নেতিবাচক। সে ক্ষেত্রে দশের মধ্যে আপনি কী ভাবে একে নম্বর দেবেন তা আপনারাই বলতে পারেন। তবে উনি বারবার শিল্পপতিদের সঙ্গে মিটিং করছেন, তাঁদের আহ্বান করছেন, এটা যদি কিছু নম্বর পাওয়ার যোগ্য হয় তাহলে সেই নম্বরটুকু দেওয়া যেতে পারে।
বামফ্রন্টের নির্বাচনী বিপর্যয়ের পিছনে অনেক সমালোচকই শিল্পনীতিকে দায়ী করেছেন। এর কোনও বাস্তব ভিত্তি আছে কি? সেই সময় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে পদক্ষেপগুলি নিয়েছিলেন মানুষ বেশ কিছু ক্ষেত্রেই তার পক্ষে ভোট দিয়েছেন বলেও মনে করেছে সংশ্লিষ্ট মহল। আপনার কি মনে হয় মানুষ সাধারণভাবে শিল্প স্থাপনের বিরুদ্ধেই মত দিয়েছেন?
বামফ্রন্ট সরকারের বিরুদ্ধে মানুষের যে রায় তা শুধুমাত্র শিল্প গড়ে তোলার বিরুদ্ধে রায় বলে আমি মনে করি না। এবং জমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধেই মানুষ বামফ্রন্টের বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছেন এ-ও আমি মনে করি না। সিঙ্গুর, নন্দীগ্রামের পরেও বামফ্রন্ট অনেক জমি অধিগ্রহণ করেছে রাজ্যে। এবং সিঙ্গুর, নন্দীগ্রামের আগেও অনেক জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। হলদিয়ায় শিল্প তো আগে ছিল না। মূলত হলদিয়ায় শিল্প গড়ে উঠেছে ১৯৭৭-এর পর। আর '৭৭-এর পর থেকে সিঙ্গুর, নন্দীগ্রামের আগে অবধি বিপুল পরিমাণে জমি অধিগৃহীত হয়েছে। হলদিয়ায় হয়েছে, রাজারহাটে হয়েছে, ন্যাশানাল হাইওয়ের জন্য জমি অধিগ্রহণ হয়েছে, খড়গপুর থেকে হাওড়া, বরাকর থেকে হাওড়ায় অনেক জমি নেওয়া হয়েছে।
সুতরাং জমি অধিগ্রহণের জন্য মানুষ আমাদের বিরুদ্ধে রায় দিয়েছে, শিল্প গড়ে তোলার জন্য মানুষ আমাদের বিরুদ্ধে রায় দিয়েছে, এ আমি মনে করি না। আমরা পেট্রো-কেমিক্যালের জন্য, বক্রেশ্বরের জন্য, সল্টলেকে ইলেক্ট্রনিক্স কমপ্লেক্সের জন্য আন্দোলন করেছিলাম। সেই আন্দোলনগুলির মধ্য দিয়েই তো বারবার মানুষ আমাদের ভোট দিয়েছেন। সুতরাং এটা বলা বোধহয় ঠিক হবে না যে মানুষ শিল্পের বিরুদ্ধে রায় দিয়েছেন। তবে সিঙ্গুর, নন্দীগ্রামকে ঘিরে কিছু বিভ্রান্তি তৈরি করা হয়েছিল। কিছু অপপ্রচার চলছিল। কিছু অসত্য কথা এমন ভাবে প্রচারিত হয়েছিল যার মধ্যে দিয়ে মানুষের মধ্যে একটা সাময়িক বিভ্রান্তি ঘটেছিল। যে বিভ্রান্তি থেকে মানুষের মধ্যে বামফ্রন্ট সম্পর্কে একটা নেতিবাচক মনোভাব তৈরি হয়েছিল। এবং অবশ্যই সেটা ভোটে বিরোধী দল ব্যবহার করতে পেরেছিল। এটা আমি অস্বীকার করব না। কিন্তু সরকারের প্রতি বিরূপ ধারণা তৈরি হওয়ার অনেকগুলি কারণও ছিল। প্রথমত, দীর্ঘ সময় ধরে আমরা এই সরকারে ছিলাম। মানুষের প্রত্যাশা অনেক বেড়েছে। সেই প্রত্যাশার সঙ্গে মিলিয়ে আমরা সব কাজ তাঁদের জন্য করতে পারিনি। এই বর্ধিত প্রত্যাশা, তার সঙ্গে সব কাজ করতে না পারা, তার থেকে ব্যর্থতা, তার থেকে হতাশা- সেটাও কিছুটা নেতিবাচক মনোভাব তৈরি করেছিল। সংসদীয় গণতন্ত্রে সেটাও খুব স্বাভাবিক। এই সবটা মিলিয়েই একটা বিরূপ মনোভাব তৈরি হয়েছে। তার সঙ্গে এই নির্বাচনে সমস্ত বিরোধী শক্তি- অতি-বাম থেকে শুরু করে অতি দক্ষিণপন্থী- সবাই সমবেত হয়েছিলেন বামফ্রন্টের বিরুদ্ধে। এটাও একটা বড় কারণ। তার সঙ্গে রাজ্যের গণমাধ্যমের একটা বড় অংশও এই প্রচারে যুক্ত হয়েছিলে। তার একটা নেতিবাচক প্রভাব নির্বাচনে পড়েছে।
আর আজকে এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে পরিবর্তনের পরিবর্তন কতটা বাস্তব জমি পাচ্ছে?
মানুষ যা শেখে তা নিজের অভিজ্ঞতা থেকে শেখে। খুব দ্রুত মানুষের অভিজ্ঞতা হচ্ছে। এতটা দ্রুত হবে তা আমরা নিজেরাও আশা করতে পারিনি। এই সরকারকে ধন্যবাদ। যে ভাবে এই সরকার নিজেদের পরিচালনা করছে, যে ধরনের ঘটনা এই রাজ্যে ঘটছে, যে ভাবে মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারের উপরে নিরবচ্ছিন্ন আক্রমণ চলছে, যে ভাবে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা আক্রান্ত হচ্ছে, যে ভাবে সাধারণ মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে, যে ভাবে মেয়েরা নিগৃহীত হচ্ছে, সবটা মিলিয়ে সমাজে একটা চরম অস্থিরতার পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। ফলে দ্রুত মানুষের মোহভঙ্গ ঘটছে। বিশেষ করে তাঁদের যাঁরা এক সময় বামপন্থীদের সমর্থন করেছেন কিন্তু পরে একটা পরিবর্তন চেয়েছিলেন এবং ভেবেছিলেন ভাল হবে। এবং বামপন্থীরাও নিজেদের শুদ্ধ করতে পারবে। তাঁদের মধ্যে চিন্তা শুরু হয়েছে যে, এখন যা ঘটছে তা ঘটা উচিত ছিল না। এবং এটা তাঁরা প্রত্যাশা করেননি। স্বভাবতই, আমার মনে হয় খুব দ্রুত মানুষের চিন্তার জগতে একটা পরিবর্তন আসছে।
আপনি বললেন যে এত দ্রুত পরিবর্তনের পরিবর্তন আসবে তা আপনারা আশা করেননি। তবে নির্বাচনী বিপর্যয়ের পর আপনার দলের ভিতর থেকেই বার বার শুদ্ধিকরণের বার্তা শোনা গিয়েছে। অবস্থার এই দ্রুত পরিবর্তনের ফলে এই শুদ্ধিকরণের পদ্ধতিতে কি কোনও পরিবর্তন আসতে পারে বা গতি শ্লথ হতে পারে?
না, আমি তা মনে করি না। এটা পার্টির এক নিরন্তর প্রক্রিয়া। আমরা যখন সরকারে ছিলাম তখনও আমরা এই প্রক্রিয়া থেকে নিজেদের বিরত রাখিনি। তখন নিজেদের মধ্যে যে ত্রুটি লক্ষ করেছি তার বিরুদ্ধে নিজেদের মধ্যেই লড়াই করেছি। এবং সেগুলিকে কাটানোর চেষ্টা করেছি। এখনও যে ভাবে আক্রমণ হচ্ছে আমাদের কর্মীদের উপর সেই আক্রমণ সত্ত্বেও তো মানুষ এগিয়ে আসছেন। হাজারে লাখে কর্মীদের জমায়েত হচ্ছে। সেই কর্মীরাই যাঁরা আগে সরকারে ছিলেন এখন বিরোধী, আক্রান্ত হচ্ছেন। মানুষ উপলব্ধি করছেন যে না এঁরা শুধুমাত্র সুবিধা গ্রহণ করতেই রাজনীতি করতেন তা না। এঁরা একটা আদর্শের জন্য রাজনীতি করেন। আমরা সরকারে থাকার সময় যাঁরা পার্টিতে এসেছেন তাঁদের সম্পর্কেও মানুষের ধারণা পাল্টাচ্ছে। মানুষ বুঝতে পারছেন তাঁরা শুধু ক্ষমতার লোভে দলে আসেননি। মতাদর্শের জন্য এসেছেন। মানুষের জন্য তাঁরা কাজ করছেন। এই উপলব্ধিটা আমাদের কর্মীদেরও উৎসাহিত করছে। নিজেদের শুদ্ধ হতে সাহায্য করছে। ঠিক তেমনই মানুষের মনোভাবেরও পরিবর্তন হচ্ছে।
'ল্যান্ড ব্যাঙ্ক' জমি-সমস্যা কতটা দূর করতে পারবে বলে আপনি মনে করেন।
আমরা যখন সরকারে ছিলাম তখনও ওরা এ কথা বলেছে। 'ল্যান্ড ব্যাঙ্ক' মানে কী? সরকারের হাতে কত জমি আছে তার খতিয়ান। সরকারের অনেকগুলি দফতর আছে। বিভিন্ন দফতরের জমি থাকে। সেচ দফতর, প্রাণিসম্পদ ইত্যাদি দফতরের হাতে নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যে জমি থাকে। ওই দফতরের কাজের জন্য, সম্প্রসারণের জন্য জমি থাকে। সরকার যদি মনে করে সেই জমি শিল্পের জন্য ব্যবহার করবে তাহলে সেই জমিও শিল্পে ব্যবহৃত হতে পারে। জিন্দলকে স্টিল প্ল্যান্টের জন্য যে জমি দেওয়া হয়েছিল তা আমরা প্রাণিসম্পদ দফতরের কাছ থেকে নিয়েছিলাম। এর বাইরে কী জমি থাকতে পারে? সরকার যে জমি ভেস্ট করেছে। ভূমি সংস্কার আইন অনুযায়ী ঊর্ধ্বসীমার উপরে যে জমি সরকার অধিগ্রহণ করেছে, সেই জমি। বামফ্রন্ট সরকারের নীতি ছিল সেই জমি গরিব কৃষকদের মধ্যে বিলি করা হবে। আমরা ১০-১১ লক্ষ একর জমি বিলি করেছি। সেই জমি তো আর সরকারের হাতে নেই। এছাড়া কিছু টুকরো জমি থাকতে পারে। সেখানে তো আর কলকারখানা করা যাবে না। এছাড়া আরও কিছু জমি আছে যা বামফ্রন্ট সরকারই করে গিয়েছিল। ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক তৈরি করার জন্য কিছু জমি নেওয়া হয়েছিল। যেমন, খড়গপুরে বিদ্যাসাগর পার্ক (১১০০ একর), নৈহাটিতে ঋষি বঙ্কিমচন্দ্র পার্ক (১০০ একর), পানাগড়ে একটি জমি (১৫০০ একর) জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছিল। রঘুনাথপুরে প্রায় ২০০০ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। ওখানে ডিভিসি-র যে বিদ্যুৎ প্রকল্প হচ্ছে আমরাই তা অধিগ্রহণ করে দিয়েছি। এই জমি তো রাজ্য সরকারের হাতে আছে। সেই জমি তো বামফ্রন্টই রাজ্য সরকারকে দিয়ে গিয়েছে। সম্প্রতি রাজ্য সরকার যাদের যাদের জমি দিয়েছে তা সবই বামফ্রন্টের আমলে অধিগৃহীত জমি। যেমন আইটিসি-কে হাওড়াতে ফুডপার্কের জন্য যে জমি দিয়েছে তা বামফ্রন্টের আমলেই নেওয়া। পানাগড়ে সার কারখানার জন্য জমি আমরাই দিয়েছি। এখন ওরা বলছে ওরা দিয়েছে। কিন্তু তা তো নয়। আমরাই দিয়েছি ওই জমি। যাই হোক এই জমিগুলো শিল্প দফতরের হাতে আছে। সেই জমিতে কারখানা হতেই পারে। একে যদি ল্যান্ড ব্যাঙ্ক বলা যায় তাহলে তাই। এ তো বামফ্রন্টের আমলেই ছিল। এটা তো নতুন কিছু না। এই সরকার এমন কিছু করেছে তার তো কোনও রিপোর্ট নেই। কারণ এই সরকার তো জমি অধিগ্রহণই করেনি।
আপনি এর আগে বলেছিলেন নতুন সরকারের যদি কোনও রকম সাহায্য লাগে তা হলে আপনাদের দরজা সবসময়ই খোলা। পরামর্শ চেয়ে কখনও কোনও ফোন এসেছে?
এখনও পর্যন্ত কোনও বার্তা আমি পাইনি। আমার মনে হয় না সেরকম কোনও বার্তার প্রয়োজনও আছে। বিরোধী দলের সঙ্গে কথা বলাটাইতো তাঁদের কাছে ঘোরতর নিষিদ্ধ ব্যাপার। সুতরাং তাঁরা আমাদের সঙ্গে পরামর্শ করবেন, সেটা আশা করা যায় না। আমরা বরাবরই বলেছি আমরা গঠনমূলক বিরোধীতার পক্ষে। রাজ্যের স্বার্থে যে কোনও কাজ আমরা করব। আমরা কখনওই কোনও নেতিবাচক মনোভাব নিইনি। একটা ছোট উদাহারণ দিই। রবিবার আমি হলদিয়ায় গিয়েছিলাম। যুব ফেডারেশনের পক্ষ থেকে একটা পদযাত্রার আয়োজন করা হয়েছিল। দাবি ছিল শিল্প গড়তে হবে। এরাজ্যে শিল্প চাই। দু'দিন পরেই বেঙ্গল লিডস। তারও উদ্দেশ্য শিল্প গড়তে হবে। এ রাজ্যে শিল্প চাই। দুটির যদি একই উদ্দেশ্য হয় তা হলে সেই পদযাত্রায় অশান্তি করা, জনগণকে সভায় আসতে বাধা দেওয়া অর্থহীন। একই দাবি যখন, তখন একে অপরের পরিপূরক হতে পারত। কিন্তু তা না করে যে বার্তাটা তাঁরা দিলেন তা হল, যাঁরা শিল্প করতে চাইছেন তাঁরাই আক্রান্ত হচ্ছেন। এতো খুব ভাল বার্তা নয়। এই বার্তাও দেওয়া যেতেই পারত শাসকদল-বিরোধী দল সকলে মিলেই শিল্প করতে চাইছে। যারা বিরোধী দল তারা তো শিল্পের বিরোধিতা করছে না।
রাজ্যে বন্ধ কল কারখানা পুনরুজ্জীবিত করা কতটা বাস্তব সম্মত?
এ ক্ষেত্রেও আমি প্রথমে বলি যে, এক ভয়ঙ্কর মিথ্যাচার করা হয়েছিল। তৃণমূল কংগ্রেসের ইশতাহারে বলা হয়েছিল, আমাদের রাজ্যে ৫৬ হাজার কলকারাখানা বন্ধ। এখন আমরা জিজ্ঞাসা করতে পারি এখন ওঁরা সরকারে আছেন, ৫৬ হাজার বন্ধ কারখানার তালিকা প্রকাশ করুন। এটা সম্পূর্ণই একটা ভ্রান্ত তথ্য। কিন্তু এটা প্রচার করা হয়েছিল।
দ্বিতীয় যেটা প্রচার করা হয়েছিল তা হল বন্ধ কারখানার জমি অধিগ্রহণ করে সেখানে নতুন শিল্প হোক। এতে অনেক মানুষ বিভ্রান্ত হয়েছিলেন। গত ১৮-২০ মাসে এমন একটিও উদাহরণ আপনি দিতে পারবেন না যেখানে সরকার বন্ধ কারখানার জমি অধিগ্রহণ করতে পেরেছে এবং সেখানে শিল্প স্থাপনের উদ্যোগ নিতে পেরেছে। কারণ আমাদের দেশের যে আইন তাতে বন্ধ কারখানার জমি উদ্ধার করে শিল্প গড়া খুবই কঠিন কাজ। এবং সেই কাজটা কেউই করতে পারছে না। কেন্দ্রীয় সরকারের বন্ধ হওয়া কারখানার জমি আমরা চেয়েছিলাম। এমনকী বাজার দরে সেই কারখানা কিনতে চেয়েছিলাম। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার আইন দেখিয়ে সেই জমি আমাদের দেয়নি। কিন্তু এই সরকার যখন বিরোধী দলে ছিল তখন এটাকেই ব্যাপক ভাবে প্রচার করেছে। আজকে তারা নীরবতাকেই শ্রেয় বলে মনে করেছে।
তৃতীয়ত, সব বন্ধ কারখানা খোলা বাস্তব সম্মত নয়। কারণ অতীতে আমাদের রাজ্যে যে কলকারখানাগুলি ছিল অতীতে সেগুলি প্রযুক্তিগত ভাবে এবং উৎপন্ন সামগ্রীর দিক থেকে বর্তমান সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারে না। ফলে সেগুলিকে পুনরুজ্জীবিত করা অবান্তর এবং অবাস্তব। এছাড়াও এই সব বন্ধ হয়ে যাওয়া কলকারখানা অনেক ক্ষেত্রেই ব্যাঙ্কের ঋণে জর্জরিত। এই সব সম্পত্তি ব্যাঙ্কে বন্ধক আছে। শ্রমিক কর্মচারীদের বকেয়া পাওনা আছে। সেই সব বকেয়া না মিটিয়ে এই কারখানাগুলি চালু করা সম্ভব নয়। যাঁরা কারখানা বন্ধ করে দিয়েছেন তাঁরা বকেয়া মিটিয়ে কারখানা চালু করতে উদ্যোগী হন না। তাহলে আরেকটাই উপায় থাকে সরকারের এই সব কারখানা অধিগ্রহণ করা। সরকারের আর্থিক সামর্থ্যে তা কুলোয় না। এই রাজ্য সরকার যদি তা পারে আমরা তা সমর্থন করব। অথবা বন্ধ কারখানার মালিকদের এঁরা বাধ্য করতে পারে। যে দাবি তাঁরা আমাদের কাছে করেছিলেন তা তাঁরা নিজেরাই করতে পারেন। একটি কারখানা আমরা খুলেছিলাম। খুবই গুরুত্বপূর্ণ কারখানা। সেটিও এই আমলে বন্ধ হয়ে গিয়েছে। সেটা ডানলপ। এই সমস্যা সারা দেশের।
আগামী দিনে রাজ্যে শিল্প সম্ভবনাকে কী ভাবে দেখছেন?
বেঙ্গল লিডস হচ্ছে ভাল। শিল্পপতিরা যদি আসেন, তাঁদের কথা বলেন এবং সে কথা শুনে রাজ্য সরকার যদি দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টায়, এই রাজ্যে যদি আইন-শৃঙ্খলা নিশ্চিত করে তাহলে এ রাজ্যে শিল্প হবে। শিল্পপতিরা আসবেন। এখনও পর্যন্ত সেই ইঙ্গিত নেই। তবে আশা করতে পারি, আগামী দিনে অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে পদক্ষেপ গ্রহণ করলে রাজ্যের মঙ্গল, আগামী প্রজন্মের মঙ্গল। আশা করি, সেই কাজ সরকার করবে।