আজকের মেয়েরা রচনা করুক আগামীর ইতিহাস
অর্ধেক আকাশ! কিন্তু কালো মেঘ সবটা সরেছে তো?
সৌমিত্র সেন
১৯০০ থেকে ২০২১ সাল। কম দিন তো হল না। সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ক্ষেত্রে মহিলাদের অর্জিত সাফল্যের উৎসব এই ৮ মার্চ পালিত হয়ে আসছে একশো বছরেরও বেশি সময় ধরে। শুধু কী হয়েছে তা নয়, অনাগতদিনের নতুন নারীদের নতুনতর অধিকারের আসন্ন সব লড়াইকে জোরদার করাটাও এই দিবস পালনের অন্যতম উদ্দেশ্য।
কিন্তু তবু প্রশ্ন ওঠে। মেয়েদের জন্য আবার একটা দিন কেন? আসলে 'নারী-পুরুষ সমান-সমানে'র এই ঢক্কানিনাদিত সমাজে মেয়েদের মনে-মননে এখনও নানা অদৃশ্য শৃঙ্খল পরানো থাকে, পরিয়ে দেয় পুরুষতন্ত্রই! তেমন একটি সমাজে এমন একটি দিনের প্রয়োজন আজও আছে বইকী!
শৃঙ্খল আছে। তার ইতিহাস দীর্ঘ। শৃঙ্খল ভাঙার ইতিহাসও কি তবে নেই? আছে বইকী!
শৃঙ্খল পরানো বা খোলা, সবটাই সামগ্রিকতার অবদান। যুগে-যুগে স্থানে-অস্থানে কেউ না কেউ কখনও না কখনও দীর্ঘ দিন ধরে বহু তোড়জোড় করে যেমন পরিয়েছে শৃঙ্খল, সেই শৃঙ্খল কেউ কেউ ভেঙেছেও বড় যত্নে। সেই যত্নে মিশে থেকেছে প্রজ্ঞা ও প্রতিজ্ঞা; মিশে থেকেছে স্বপ্ন ও সুধা; মিশে থেকেছে কল্পনা ও কৃষ্টি; মিশে থেকেছে সাহস ও সঙ্কল্প। তার ইতিহাসও কম নয়।
কিন্তু এই মুহূর্তে ইতিহাসের ওই বড় বড় সামগ্রীর দিক থেকে চোখ সরিয়ে যদি আমরা কিছু 'রিসেন্ট ফ্যাক্টসে'র দিকে তাকাই হাথরস-অধ্যুষিত আঁধারদেশেও কিছু আলো আসতে দেখা যায়।
আরও পড়ুন: নারী দিবসে গুগল ডুডলে Women's Firsts
পশ্চিমবঙ্গ-সহ পাঁচ রাজ্যে সামনেই বিধানসভা ভোট। সেই ভোটের প্রেক্ষিতেই নির্বাচন কমিশনের (election commission of india) সরবরাহ করা কিছু সাধারণ পরিসংখ্যান হাতে এল। যেমন, এ রাজ্যে ৭ কোটি ভোটারের মধ্যে মহিলা ভোটার ৪৯ শতাংশ! 'অ্যাডাল্ট ফ্র্যাঞ্চাইজি'টা নেহাত ফেলনা নয় কিন্তু। মত দিতে পারার জায়গায় এসে পৌঁছনো মেয়েরা যদি নিজের মত দৃঢ় ভাবে জানানোর এই চর্চায় নিমজ্জিত হন, আগামী সমাজের পক্ষে এর চেয়ে ভাল আর কী হতে পারে? এমনকি, নির্বাচন কমিশন (EC sources) তার রিপোর্টে জানিয়েই দিয়েছে, দেশের অন্য রাজ্যগুলির তুলনায় ভোটপ্রক্রিয়ায় অংশ নেওয়া মহিলার সংখ্যাটা পশ্চিমবঙ্গে রীতিমতো উঁচুর দিকে (participation of women voters very high in bengal)।
তথ্য আছে আরও। এবারের ভোটে মহিলাপ্রার্থীর সংখ্যাটাও যথেষ্ট সমীহ জাগানো। শুধুমাত্র তৃণমূলের হয়েই ভোটের টিকিট পেয়েছেন ৫০ জন (50 women candidates) মহিলা! শতাংশের হিসাবে সর্বমোট প্রার্থীদের (২৯১) মধ্যে ১৭ শতাংশ! এ-ও নেহাত ফেলনা নয়। ২০১৬ সালের বিধানসভা ভোটের (2016 Assembly polls) চেয়ে ৫জন বেশি!
এহো বাহ্য। রাজ্যের শাসকদলের এবারের ক্যাচলাইনটাও খেয়াল করা যাক-- 'বাংলা নিজের মেয়েকেই চায়' (Bangla Nijer Meyekei Chay /‘Bengal wants her own daughter)। অর্থ খুব স্পষ্ট। শাসকদলের কঠিন প্রতিদ্বন্দ্বী এবারে যখন কোনও এক 'ভূমিপুত্রে'র কথা বারবার বলে ভোটবাজার গরম করছে তখন তাদের এই কয়েনেজের প্রতিস্পর্ধী হিসাবে শাসকদল বেছে নিয়েছে ভূমিকন্যার 'লাইন'। ভূমিকন্যা খুব সহজে ও স্বাভাবিকতায় হয়ে দাঁড়িয়েছে 'বাংলার মেয়ে'। 'মেয়ে' কেননা, এ রাজ্যের শাসকদলের সর্বময় নেতা তো একজন মহিলাই (ভুলে গেলে চলবে না, এই মুহূর্তে ভারতের মতো এত বড় দেশে একমাত্র মহিলা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়)!
ফলে, এবারের ভোটে কোথাও একটা পুরুষতন্ত্র বনাম নারীতন্ত্রের সরব সগৌরব লড়াইয়ের আবহ ইতিমধ্যেই রচিত হয়ে গিয়েছে। আন্তর্জাতিক নারী দিবসের প্রেক্ষিতে দাঁড়িয়ে যা নিয়ে রীতিমতো শ্লাঘা বোধ করতে পারেন বঙ্গনারী, ভারতীয় নারীও। শক্তিমত্তা, প্রভাব, বুদ্ধি, শ্রম, সংগঠন ও আন্তরিকতা নিয়ে যদি ছেলেদের পাশাপাশি লড়ে যেতে পারে মেয়েরা, কত অসাধ্য সাধনই যে হতে পারে! হতে যে পারে, এই বোধটাই তো এমনদিনের সব চেয়ে বড় উপলব্ধি হতে পারে। না হলে শুধু মেয়েদের জন্যই একটি ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের (Her Circle) সূচনা করে নীতা আম্বানি বলেন-- যখন মহিলারা মহিলাদের উপর আস্থা রাখেন তখন অবিশ্বাস্য কিছু ঘটে?
অবিশ্বাস্য! এটা খুব মনে রাখার মতো একটা শব্দ। যা 'অবিশ্বাস্য' তাকে ক্রমশ 'বিশ্বাসযোগ্য' করে তোলে যে, সে-ই তো ইতিহাস রচনা করে! যেমন আজকের মেয়েরা নানা পথ ভেঙে ভেঙে আগামী দিনের জন্য রচনা করছে এক অ-পূর্ব ইতিহাস।
আরও পড়ুন: নারী দিবসে শুধু মহিলাদের জন্যই ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম