বিসর্জন!
করোনার বিসর্জন, সুস্থতার বোধনের প্রার্থনায় শেষ হল দুর্গাপুজো!
সৌমিত্র সেন
দেখতে-দেখতে বিজয়া এসে পড়ল। আজ সন্ধে থেকেই শূন্য মণ্ডপ। একলা প্রদীপ। সুনসান চারিপাশ। লক্ষ্মীপুজোর আগের দিন পর্যন্ত প্যান্ডেলের চেহারা থাকবে এমনই।
করোনা-আবহে এ বার যে বাঙালি খুব জমিয়ে পুজো করতে পেরেছে তা নয়। পুজো নিয়ে কম বিতর্ক হয়নি। শেষমেশ সে বেরিয়েছেও খুব মেপেজুপে। আকণ্ঠ আনন্দের বান ডেকে যায়নি পাড়ায়-পাড়ায়। কিন্তু দুর্গোৎসব কি বাঙালির কেবল পথে-প্রান্তরে? শুধু রাজপথে, পার্কে, পাড়ার মাঠে, আটচালায়? না! দুর্গাপুজো আসলে বাঙালির মনে।
আকাশজোড়া বর্ষামেঘ থাকলেও সেই মনেই সে বর্ষামেঘের ভ্রূকুটি উপেক্ষা করে। সেই মনেই সে শরতের ফিনফিনে রোদ্দুর যাচ্ঞা করে। হাতে তেমন টাকা-পয়সা না থাকলেও সেই মনেই সে নতুন পোশাক কেনে, স্পেশাল মেনু বানিয়ে পরিবারের সঙ্গ উপভোগ করে। হাতে ছুটি না থাকলেও মনে-মনেই সে ভিড়ে যায় অমিত বলশালী পুজোভিড়ে, বেরিয়েও পড়ে দূরে-কাছে।
বাইরে কী হল না হল-- এ নিয়ে তার মন তত বিঘ্নিত থাকে না। কেননা, ছোট থেকেই সে আগাগোড়া মনটা দিয়েই এই শারদোৎসবকে উপভোগ করে। বৎসরান্তের এই উৎসবের শাঁসের ভিতর যে শুভ্র আনন্দের সূর্য সদাজাগরূক থাকে, সেটাই তার মনে আবাল্য আলো ছড়ায়। আর সেই আলোর পিছনে ছুটতে-ছুটতেই সে কত পুজো যে পার হয়ে যায়!
এ যদি না হত, তবে এ বারই সে সব চেয়ে বিমর্ষ, হতাশ থাকত। অথচ তা হয়নি। যথারীতি পুজোর আয়োজনে মেতে উঠেছিল বাঙালি। পুজোর আগে হাতিবাগান-গড়িয়ায় ভিড়ও হয়েছে, প্যান্ডেলে-প্যান্ডেলেও ঢুকে পড়েছে তারা সদলবলে। করোনা তাকে পুরোপুরি হতোদ্যম করে দেয়নি। করোনার চোখরাঙানিকে পরাজিত করেই দীপ্ত হয়ে উঠেছিল তার শারদীয় উদযাপন।
কিন্তু এত কিছু আয়োজনের আজই সমাপন। আজ দেবীমূর্তির নিরঞ্জন। আজ ঢাকের তালে 'ঠাকুর থাকবে কতক্ষণ/ঠাকুর যাবে বিসর্জনে'র মনকেমনিয়া বোল। আজ মা ফিরবেন কৈলাসে। আজ স্তব্ধ মণ্ডপে শুধু নিবিড় নির্জনতার ঢেউ। এই শুভ বিদায়-উৎসবে মধুরেণ সমাপয়েৎ কি হল?
সম্ভবত না। কেননা, এখনও মানুষ আতঙ্কে আছে। কবে করোনা ভ্যাকসিন আসবে, তা নিয়ে অধীর আগ্রহ আর অতল উদ্বেগ তাকে কুরে কুরে খাচ্ছে। সে মনে-মনে জানে, এ ভাবে বাঁচা কঠিন। সে জানে মায়ের মুখে মাস্ক এঁকে চমকে দেওয়া যায়, কিন্তু করোনাকে থমকে দেওয়া যায় না। সে জানে স্বামী-পুত্র-স্ত্রী-কন্যা-বাবা-মা-বন্ধু-পরিজন নিয়ে এ ভাবে মিনমিন করে দিন কাটানো কী ভয়ঙ্কর কঠিন!
তাই মায়ের কাছে এ বারে সে মেয়ের বিয়ে, ছেলের চাকরি, মা-বাবার রোগমুক্তি, নিজের প্রোমোশন নিয়ে আর ঘ্যানঘ্যান করেনি। করোনা বাঙালির হৃদয়কে বড় করে দিয়েছে। সে তার নিজের জন্য, পাড়ার মোড়ের চা-ওয়ালার জন্য, দিল্লির মন্ত্রীর জন্য, মুম্বইয়ের তারকার জন্য, সাগরপারের সেলেব্রিটির জন্য করোনামুক্তির টিকা প্রার্থনা করেছে।
বিশ্ববাসীর জন্য তার মন জেগে উঠেছে এ বারে! সে চায়, এ বারে যা হয়েছে হোক, সামনের বারে যেন অন্তত করোনা-মুক্ত পুজোর দিন হাতের মুঠোয় পায় সে। ঠিক যে ভাবে সে হাতের মুঠোয় নেয় সন্ধিপুজোর পঞ্চপ্রদীপের পবিত্র উত্তাপ!
আরও পড়ুন: সম্প্রীতির ভাসানে নেই প্রাণের টান