উচ্চদার্শনিকতা থেকে 'বাঁদর'-- রবি-আড্ডায় বাচনের মুক্তোদ্যুতি
একটা অ-কারণ 'ইনফর্মাল' সামাজিকতাই হল আড্ডা-মজলিশের প্রাণ, বলতেন কবি।
সৌমিত্র সেন
সত্যজিৎ রায় তাঁর 'আগন্তুক' ছবিতে একটি দৃশ্যে বাঙালির আড্ডার বিষয়ে আলোচনার সূত্রে তাঁর এক চরিত্রকে দিয়ে প্রশ্ন করিয়েছেন, রবীন্দ্রনাথ কি আড্ডায় অংশ নিতেন? আড্ডার মান যথাযথ হলে, তিনিও আড্ডা দিতেন, এমনটাই সিদ্ধান্ত বেরিয়ে আসে সেই আলোচনা থেকে। রবীন্দ্রনাথের জীবন সম্বন্ধে অবহিত মাত্রেই জানেন, তিনি সাধারণ বাক্যালাপেই কী দীপ্ত শব্দচয়নে পারঙ্গম ছিলেন। এর উপর তো রইল তাঁর তর্কপ্রিয়তা, যুক্তিজালসজ্জার ব্যাপারগুলি।
যদিও আড্ডা বলতে বাঙালি ঠিক উল্টোটাই বোঝে। আড্ডা হল প্রাণখোলা বাচন, যেখানে শব্দচয়ন ও তার উচ্চারণ নিয়ে থাকবে না কোনও বিধি বা নিষেধ। তা হবে মুক্ত, হয়তো কিঞ্চিৎ অ-সামাজিকও। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের কাছে আড্ডাও ছিল একটা শিল্পমাধ্যম। বুদ্ধি ও রসবোধের মিশেলে যা উজ্জ্বল। রবীন্দ্রনাথ তাঁর 'জীবনস্মৃতি'তে তাঁর সময়কার মজলিশের প্রসঙ্গ তুলছেন। বলেছেন যথার্থ আড্ডাধারীর বেশ খাতির হত পরিচিত মহলে।
আরও পড়ুন: সব রকম সংকীর্ণতার নাগপাশ ছিন্ন করার গ্রীষ্মসাধনই তাঁর নিজস্ব 'বৈশাখ'
রবীন্দ্রনাথের নিজের বাচন কী ভাবে মজলিশ-উপযুক্ত হয়ে উঠেছিল? নিশ্চিতভাবে এতে তাঁর পরিবারের অবদান ছিল। তাঁর বাবা মহর্ষির সঙ্গ নিশ্চয়ই তাঁকে এ বিষয়ে গভীর ভাবে সাহায্য করেছিল। এ ছাড়াও জ্যোতিদাদা, কাদম্বরী দেবী এবং কবি বিহারীলাল চক্রবর্তীর সঙ্গও তাঁকে তৈরি হয়ে উঠতে সাহায্য করেছিল।
এ ছাড়াও জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির হাসি-কথা ভরা এক মিষ্টি তপ্ত মধুর জীবনের কথা তিনি বরাবরই বলতেন। যেখানে কোনও কারণ নেই, কোনও সামাজিক প্রয়োজন বা বাধ্যবাধ্যকতা নেই তেমন একটা অ-কারণ 'ইনফর্মাল' সামাজিকতাই হল আড্ডা-মজলিশের প্রাণ, এ কথা তিনি বলতেন। এবং এ-ও বলতেন, তিনি এ বিষয়টি তাঁর তরুণ বয়সে যত দেখেছেন, তাঁর প্রৌঢ়ত্বে আর তেমন দেখেননি। অর্থাৎ, তাঁর মতে আড্ডা তার স্বাভাবিকত্ব হারিয়ে ততদিনে কেজো হয়ে গিয়েছে।
সাহিত্য-সংস্কৃতি জগতের প্রথিতযশাদের নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ১৮৯৭ সালে সূচনা করেছিলেন 'খামখেয়ালী সভা' (Kham-Kheyali Sabha) নামের একটি আড্ডা-আসর। পুত্র রথীন্দ্রনাথ তাঁর স্মৃতিকথায় বাবা তাঁর বন্ধুদের অপূর্ব আড্ডার কথা লিখেছেন। কারা কারা থাকতেন সেই আড্ডায়?জগদীশচন্দ্র বসু (Jagadish Chandra Bose), চিত্তরঞ্জন দাশ (Chittaranjan Das), দ্বিজেন্দ্রলাল রায় (D.L. Roy), প্রমথ চৌধুরী (Pramatha Chaudhuri) এবং অতুলপ্রসাদ সেন (Atul Prasad Sen)। রবীন্দ্রনাথ সেখানে তাঁর নিজের লেখা পড়তেন। বাকিরা মত দিতেন। সেখানে সব চেয়ে চিত্তাকর্ষক ছিল রবি-জগদীশ আলাপ। রবীন্দ্রনাথ খোঁজ নিতেন জগদীশ বিজ্ঞানের নতুন কী ভাবছেন আর জগদীশ খোঁজ নিতেন এর পরে কী গল্প ভাবছেন রবীন্দ্রনাথ।
কিন্তু সাধারণ কথাবার্তায় রবীন্দ্রনাথ metaphor বা pun ব্যবহার করে সেই কথায় একটা সূক্ষ্মতা বা গভীরতা এনে দিতেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁর বৃত্তের মধ্যে খুবই রঙ্গ-রসিকতা করতেন। বুদ্ধদেব বসুও তাঁর স্মৃতিকথায় রবীন্দ্রনাথের এই অভাবিত বাক্যালাপের স্রোত ও দীপ্তির কথা উল্লেখ করেছেন। আইনস্টাইন-রবীন্দ্রনাথের (Albert Einstein) বাক্যালাপ, তা আড্ডা না, তর্ক-- কী বলা চলে একে? কিন্তু তা যে-বর্গেরই হোক, নিজের মতকে সুসংবদ্ধ ভাবে শ্রোতার কাছে উপস্থাপন করার শিল্পটাও এখানে নজর করার মতো।
শান্তিনিকেতনে উত্তরায়ণে রবীন্দ্রনাথের কোণার্ক বাড়িতে জমজমাট আসর বসত। সেই আড্ডায় শিল্প-সাহিত্য প্রসঙ্গ থাকতই, সমাজ-রাজনীতি-অর্থনীতিও গুরুত্ব পেত। থাকত সরস কৌতুকও। এ রকম এক আড্ডায় একদিন রবীন্দ্রনাথ সবাইকে চমকে দিয়ে বললেন, তোমরা কি জানো, এ ঘরে একটি 'বাঁদর' আছে? হঠাৎই চমকে ওঠেন সবাই। কিন্তু হতবুদ্ধি হয়ে বসে থাকেন। তখন কবিই স্বয়ং উচ্চৈস্বরে হেসে উঠে জানিয়ে দেন, এই ঘরের বাঁ-দিকে একটা দরজা অর্থাৎ কিনা একটি 'দোর' আছে। সেটাই হল গিয়ে 'বাঁ-দোর' যা ঘরোয়া উচ্চারণে দাঁড়ায় 'বাঁদর'। প্রমথনাথ বিশী শান্তিনিকেতনের অন্যরকম এক আড্ডার কথাও শুনিয়েছেন যেখানে ছাত্রদের সঙ্গে কথালাপে কঠিন শব্দ নিয়ে খেলার আড্ডার ফাঁকে তিনি অজান্তেই তাঁদের ভাষাশিক্ষা দিতেন।
আরও পড়ুন: 'তখন কি মা চিনতে আমায় পারো'--শিশুকবিতার এই চরণই যেন চিরসত্য রবিজীবনে!