পার্ক স্ট্রিট কাণ্ডের পরই প্রশ্নটা আলগাভাবে ছুঁড়ে দেওয়া হয়েছিল প্রশাসনের পক্ষ থেকে। মঙ্গলবার তাতে সম্মতির সিলমোহর দিলেন মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং। মহাকরণে দাঁড়িয়ে রাজ্য পুলিসের ডিজি`কে সাক্ষী খাড়া করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়ে দিলেন, কাটোয়ার ধর্ষণের ঘটনা "সিপিএমের সাজানো"।
কারণ?
মেডিক্যাল রিপোর্টে নাকি ধর্ষণের কোনও প্রমাণই মেলেনি!
অবশ্য মুখ্যমন্ত্রীর এই দাবির অব্যবহিত পরেই কাটোয়া মহকুমা হাসপাতালের চিকিত্সক আর এন মণ্ডল জানিয়ে দিয়েছেন, অভিযোগকারিণীর ফরেনসিক রিপোর্ট এখনও মেলেনি। আর ফরেনসিক রিপোর্ট হাতে না আসা পর্যন্ত `সহবাস` হয়েছে কি না, তা বলা কার্যত অসম্ভব।
মূল প্রশ্নটা কিন্তু অন্যত্র। মেডিক্যাল কিংবা ফরেনসিক রিপোর্ট যে আদৌ ধর্ষণ প্রমাণের আইনি সূচক হতে পারে না, আইনের স্নাতক তৃণমূল নেত্রীর কাছে তা অবিদিত থাকার কথা নয়। অভিযোগকারিণীর ফরেনসিক টেস্টে `সহবাস`-এর ঘটনা প্রমাণ হলেও তা `ধর্ষণ` কি না, তা একেবারেই আদালতের বিচার্য বিষয়, চিকিত্সাশাস্ত্রের নয়।
আর ধর্ষণের মামলায় `প্রমাণ` হিসেবে মেডিক্যাল টেস্টের অপরিহার্যতা?
২০১০ সালের ২৭ এপ্রিল বিচারপতি আর এম লোঢা এবং বিচারপতি পি সতশিবমকে নিয়ে গঠিত সুপ্রিম কোর্টের বেঞ্চের ঐতিহাসিক রায় এ বিষয়ে আইনি দিশানির্দেশ স্পষ্ট করেছে। কর্ণাটকের ম্যাঙ্গালোরে ২০০৪ সালে এক নাবালিকাকে ধর্ষণের মামলার রায় দিতে দিয়ে শীর্ষ আদালত দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জানিয়ে দেয়, মেডিক্যাল কিংবা ফরেনসিক রিপোর্ট আদৌ অপরিহার্য নয়। প্রয়োজন নেই কোনও প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ানও। অভিযোগকারিণীর জবানবন্দিই ধর্ষণের মামলা রুজু এমনকী অভিযুক্তদের শাস্তিদানের ক্ষেত্রে যথেষ্ট।
সংশ্লিষ্ট মামলায় ধর্ষকদের প্রাণনাশের হুমকির ফলে প্রথমে পুলিসে অভিযোগ জানানোর সাহসই পায়নি ধর্ষিতা নাবালিকার পরিবার। ৪২ দিন পর দায়ের করা হয় এফআইআর। ফলে মেডিক্যাল টেস্টে ধর্ষণের পারিপার্শ্বিক প্রমাণ (আঘাতের চিহ্ন) দূরস্থান, ফরেনসিক পরীক্ষায় সহবাসের প্রমাণই মেলেনি। আদালতে সওয়ালের সময় এই ঘটনাকেই হাতিয়ার করেছিলেন অভিযুক্ত পক্ষেরই আইনজীবীরা। কিন্তু সরাসরি এই যুক্তি খারিজ করে দেয় শীর্ষ আদালত।
কিন্তু সাম্প্রতিক অতীতে পার্ক স্ট্রিট কাণ্ডের সময় পুলিস মহলের একাংশের তরফে যুক্তি দেওয়া হয়েছিল, ঘটনার ৪ দিন পর অভিযোগ দায়ের হওয়ার কারণে মেডক্যাল রিপোর্টে ধর্ষণের প্রমাণ মিলবে না। ফলে মামলাটি লঘু হয়ে পড়বে। ধর্ষিতা মহিলার অভিযোগের সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং। কাটোয়ার ক্ষেত্রেও দেখা গেল একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। সেই সঙ্গে ধর্ষণের অভিযোগ নস্যাত্ করতে মেডিক্যাল রিপোর্টের `তত্ত্ব` খাড়া করলেন তিনি। সুপ্রিম কোর্টের সুস্পষ্ট নির্দেশ সত্বেও ধর্ষণের ঘটনার অকাট্য প্রমাণ হিসেবে মেডিক্যাল রিপোর্টের কথা উল্লেখ করে মুখ্যমন্ত্রী নতুন করে বিভ্রান্তি তৈরি করলেন বলেই মনে করছে পুলিস মহলের একাংশ। সেই সঙ্গে তাঁর এই মন্তব্য অপরাধপ্রবণতাকে উস্কে দিতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন তাঁরা।
মেডিক্যাল রিপোর্টই ধর্ষণের প্রমাণ! মুখ্যমন্ত্রীর মন্তব্য ঘিরে বিতর্ক