ছায়া মানুষ (ভূত দিবস স্পেশাল গল্প)

Updated By: Nov 10, 2015, 03:09 PM IST

সৌম্য সিংহ

ঘন ঘন বাড়ির জঙ্গল থেকে এ বাড়িটাকে সহজেই আলাদা করা যায়। সিমেন্ট খসে গিয়ে ইটের দেওয়াল দাঁত বের করে হাসে। কার্নিশে গজিয়ে উঠেছে বট, শিকড় অনেক গভীরে। নামী প্রোমোটারও ভয় পান এ বাড়িকে বিজনেস অপারচুনিটি ভাবতে। লোকে বলে—ভূতের বাড়ি, আত্মাদেরও নাকি অনেকেই দেখতে পেয়েছেন বাড়ির অন্দরে, মাঝে মধ্যে অনেকেই কান্নার শব্দ শুনতে পান।

  এ বাড়িতে আমি একাই থাকি। বাড়িতে আমি একমাত্র সদস্য। আমার প্রিয়জনেরা যাঁরা এ বাড়িতে থাকতেন সকলে একে একে চলে গিয়েছেন। তাঁদের সঙ্গে আমার আর কোনও যোগাযোগ নেই। তা হয়ে গেল বেশ কয়েক বছর। আমিই একমাত্র রয়ে গেছি এ বাড়িতে।  

পাড়া প্রতিবেশীরা আমার একাকীত্ব দেখে অনেক সময়ই এ বাড়ি ছাড়ার পরামর্শ দিয়েছেন। আমি সেসব কানে তুলিনি। বলতে বলতে ক্লান্ত মানুষগুলো এখন আর কিছুই বলেন না। রাস্তা ঘাটে হাঁটতে বেরোলেও আমার আর ধার কাছ ঘেঁষে না কেউ। আমিও প্রয়োজন বোধ করি না। আমি একা, একাই ভাল আছি। একা একা বেঁচে থাকা আমার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে অনেক কাল।

বৃষ্টি পড়ছে। আজ সকাল থেকেই বৃষ্টি শুরু হয়েছে। ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি। বিকেল গড়িয়ে গেলেও বেয়ারা বৃষ্টি থামেনি। বাড়িতেই গোটা দিন, গোটা সন্ধ্যা।

স্বামী অভেদানন্দ পড়ছিলাম। আচমকাই খেয়ালটা চেপে বসল। তারপর সোজা চিলেকোঠা—

ঘুলঘুলি আর জানালা দিয়ে আসা স্ট্রিট লাইটের হলুদ আলো ঘুটঘুটে ভাবটা কাটিয়ে দিয়েছে। বদ্ধ ঘরের স্যাঁত স্যাঁতে গন্ধ আর বৃষ্টির শব্দ মিলে মায়াবী করে তুলেছে পরিবেশটাকে। মাঝে মধ্যে সুর কাটছে মুসিক-দৌড়, টিকটিকির টিক টিক। গোল টেবিলের সামনে আমি বসে, এক মনে আত্মা-চিন্তা।   

          সে এসে গেল। আমার সামনে সুকান্ত-স্টাইলে বসে। আমি আর লোভ সামলাতে পারছি না। সরাসরি প্রশ্ন—‘আপনি কে?’

—‘সে প্রশ্ন যে অবান্তর বন্ধু...’

          সে কথা বলছে! অথচ তাঁর সামনেই রাখা পেন্সিল আর রাইটিং প্যাড। আমি ভেবে ছিলাম, আঁকিবুঁকি-হিজিবিজি আপনা থেকেই লেখা হয়ে যাবে সাদা কাগজে। কিন্তু কোথায় কী! সে কথা বলছে!

—‘আচ্ছা বন্ধু, আপনি এলেন কোথা থেকে?’

সে সশব্দে হেসে উঠল—‘কেন, এই বাড়িতেই তো থাকি আমি...এ বাড়ির আনাচ-কানাচে যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে আমার জীবন, এ বাড়ির এদিক সেদিকে আমার অবাধ যাতায়াত...আপনি ডাকলেন আর ওমনি আমি হাজির’

—‘এ বাড়িতে! তার মানে লোকে যে বলে এ বাড়ি ভূতের, সেটা সত্যি!’

—‘আজ্ঞে, সে তো সত্যিই...’

—‘তার মানে আপনি পাসিং স্পিরিট...’

—‘তা বলতে পারেন, পাসিং স্পিরিট, অবশ্য এ শব্দদ্বয়ের অনেক বড় ব্যাখ্যা...’

—‘কিন্তু আমি তো রবীন্দ্রনাথকে ডেকে ছিলাম...সে এলো না, অথচ আপনি চলে এলেন...’

—‘হ্যাঁ, আমি জানি...আসলে কী জানেন, আমার ভিতরেও একটা রবীন্দ্রনাথ রয়েছে, প্রত্যেক বাঙালী যুবকের ভিতরেই তিনি থাকেন...আপনিও তো এক সময় নিজেকে রবীন্দ্রনাথ ভাবতেন, কবিতা লিখতেন...’

—‘সে সব তো তরুণ বয়সের পাগলামী...কিন্তু আপনি জানলেন কীভাবে!’

—‘সব জানি মশাই, ভূতেদের সব কিছু জানা বাধ্যতামূলক...’

—‘বলেন কি!’

—‘ঠিকই বলছি মশাই—ঘোষদের বাগানে আমচুরি, মিত্তিরদের ঘাটে কলেজ লাইফে বন্ধুদের সঙ্গে প্রথম বিড়ি ফোঁকা, এই চিলেকোঠাতেই সায়রা বানুর কথা মনে করে নিজেকে আদর, তার পর এর ওর মন কাঁদিয়ে ব্যাচেলার জীবন কাটিয়ে দেওয়া—সবই আমি জানি...’

          ওর কথাগুলোয় আমার হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে। সারা শরীর বরফে পরিণত হচ্ছে ক্রমাগত। রেফ্রিজারেটর থেকে ঠাণ্ডা জল বের করে আনলে যেমন বিন্দু বিন্দু করে বোতলের গায়ে জল জমে, তেমনই আমারও কপালে ঘাম জমতে শুরু করেছে। সে বলে ওঠে—‘জল খাবেন?’

—‘নাঃ থাক...’

—‘চা কিংবা কফি....কিংবা আপনার প্রিয় স্কচ...’

—‘এটাও জানেন!’

—‘ওসব কথা বাদ দিন এখন। আগে আপনি একটু সুস্থ হয়ে নিন...আমি বুঝতে পারছি আপনার মাথার মধ্যে অনেক খানি চাপ দিয়ে ফেলেছি আমি...’

—‘তা দিয়েছেন বটে...’

—‘আসলে কি জানেন, আমি একদম আপনার ছাঁচ...আপনি যেমন কাউকে কষ্ট দিতে পারেন না, আমিও পারি না...আপনি যেমন আত্মভোলা প্রকৃতির, আমিও অনেকটা সেরকম...আপনি যেমন চিরটাকাল সিনিয়র সিটিজেনদের সম্মান করে এসেছেন, আমিও ঠিক সেরকমই...’

—‘কিন্তু ভাই আমি উঠে গেলে যে আপনিও উঠে পড়বেন, আমার যে তখন আর প্রশ্নগুলি করা হবে না...তার থেকে বরং আমি জল পরে খাব, আগে প্রশ্নগুলি করে ফেলি...’

—‘কি যে বলেন স্যার! আমি এসেছি আপনার ডাকে, আপনার কথা শুনতে-গল্প করতে...আর আপনিই যদি অসুস্থবোধ করেন, তাহলে তো সব ভেস্তে যাবে...আপনাকে উঠতে হবে না, আমিই জল নিয়ে আসছি...’

          মুহূর্তের মধ্যে ভ্যানিশ। গোল টেবিলটার সামনে আমি একাকী। এভাবে বেশ কিছুক্ষণ। আর প্রতিটা ক্ষণেই আমার চোখের সামনে ছায়াছবির মতে ফ্ল্যাশব্যাক—

          মিত্তিরদের ঘাটে দুপুর গড়ালেই আমাদের ভিড়...ওপাড়ার উমাবৌদি দুপুর গড়ালেই স্নান করতে আসেন...স্নানদৃশ্য...অশোক একবার ডুব সাঁতার দিয়ে গিয়ে উমাবৌদির কোমড় চেপে ধরেছিল...উমাবৌদি ধরতে পারেনি, গালমন্দ করেই ক্ষান্ত হয়েছিল...শ্যামা আর রমা যমজ বোন, আমাদের বাড়িতে ভাড়া থাকত...শ্যামার সঙ্গে আমার সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল...সায়রা বানুর সঙ্গে ওর মুখের কি অদ্ভূত মিল...আমি একদিন ওকে এই চিলেকোঠায় জাপটে ধরলাম...ওর পাতলা ঠোঁট দুখানিতে গুঁজে দিলাম আমার ঠোঁট...শুরু হওয়াটা কঠিন, কিন্তু শুরু হলে কি শেষ হয়! …গোপনতা...আর এই গোপনতা কাল হল...একদিন বুঝলাম, ওর দিদির মতো  রমাও আমাকে পছন্দ করে...

—‘এনাও জল’, একটা কাচের চুরি পরা কালো হাত আমাকে এগিয়ে দিচ্ছে গ্লাসখানি, আমি অবাক হয়ে বললাম—‘একি তুমি!’

          খিলখিলিয়ে হেসে উঠল রমা—‘বাবাঃ, তুমি তো আমাকে দেখে ভূত দেখার মতো করছ....’

—‘তুমি এতো কাল হয়ে গেছ রমা...’

—‘আমি তো মরে ভূত, এখন আমি ফরসা না কালো তাতে কী এসে যায়! তাছাড়া ভূত হলে যে আমাকে কালো হতেই হবে, মৃত্যুর পর যে কোনও রঙ থাকে না...’

—‘তুমি আসলে কোথা থেকে! এতক্ষণ তো ওই ছেলেটা ছিল...’

আবার খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে রমা—‘ভাল করে দেখো আমায়, আমিই সে...’

          আমি দুহাত দিয়ে চোখটা কচলাতেই রমা উধাও। সামনে সেই যুবক দাঁড়িয়ে। অন্ধকারে বেশ বুঝতে পারছি, যুবক আমার দিকে তাকিয়ে সাদা সাদা দাঁত বের করে হাসছে—‘রমার কথা ভাবছিলেন?’

          আমি কোনও কথা বলতে পারি না। শুধুই তাকিয়ে থাকি যুবকের দিকে। মৃদু হাসে সে—‘আমিও ভাবতাম জানেন...’

—‘আপনি!’

—‘ভাবতাম একটা সময়, যখন শ্যামাকে ভালবাসতাম...’

—‘শ্যামাকে ভালবাসতেন!’

—‘আজ্ঞে। আর শ্যামাকে ভালবাসার মাঝে রমার দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে মাঝে মধ্যেই তার শরীরখানি উপভোগ করতাম...’

—‘ছিঃ...’

—‘ছি বলছেন! আপনি রমার গায়ে কোনও দিন হাত দেননি? অবিবাহিতা রমার গর্ভে যে ভ্রুণ দানা বেঁধেছিল, তার জনক কে?’

          আমার হাত পা শিথিল হয়ে যাচ্ছে। এক একটা করে শব্দ হারিয়ে যাচ্ছে, শব্দগুলি মালার মতো গাঁথছে না আর। আমি নীরব দৃষ্টিতে যুবকের দিকে তাকিয়ে...

—‘জানেন, শ্যামা আপনাকে প্রচণ্ড ভালবাসতো...রমার ভ্রুণের জনকের নাম জানার পর অতীত করে দিয়েছিল নিজের জীবনটাকে...’

—‘নাঃ, একদম না, রমার সুইসাইড নোট আমি পড়েছি...সেখানে অন্য এক যুবকের নাম লেখা...’

সশব্দে হেসে ওঠে সে—‘সে তো আত্ম-সান্ত্বনা দেওয়ার কথা...আপনিও কি এক সময় মনে মনে ভাবতেন না, রমার আত্মহননের পিছনে সব চেয়ে বড় আপনার হাত?’

 প্রত্যোত্তর নেই। থাকবেই বা কী করে! সবটাই তো ছবির মতো স্পষ্ট। একটা অস্বস্তি ধীরে ধীরে যন্ত্রণায় পরিণত হচ্ছে। অনেক অনেক দিন পর পাপবোধ গ্রাস করছে আমাকে।

—‘অপরাধ নেবেন না স্যার, আমি আপনার থেকে অনেকটাই ছোট...এসব কথা বলার আমার কোনও উদ্দেশ্যই ছিল না, শ্যামা-রমা-রিনা-ছোটনের মা—সবই আমার জানা...আমি এসেছিলাম আপনার সঙ্গে কিছুটা সময় কাটাতে, কবিতা শুনতে...’  

আমি এবার অধৈর্য হয়ে উঠি—‘রিনা আর ছোটনের মা সম্পর্কে কী জানেন? ওদের সঙ্গেও আমার সম্পর্ক ছিল বলবেন? নাকি বলবেন, আমি ওদের খুন করেছি বা আত্মহত্যায় প্ররোচনা দিয়েছি...’

—‘আহা আপনি রেগে যাচ্ছেন কেন! জানেন না, ভূতের সামনে কোনও রাগ চলে না...’

—‘ভারি ভূত আমার...’

          আমার কথায় সে ফিক ফিক করে হেসে ওঠে—‘কিন্তু আপনি তো ভূত চর্চায় বসেছেন...’

—‘এই আপনি যান তো...আপনাকে ডাকাটাই আমার ভুল হয়েছে...জাস্ট গেট লস্ট...’

—‘একটু পরে...’

—‘আমার বাড়ি, আমার ঘর, আমি যেখানে চাইছি না, সেখানে আপনি নির্লজ্জের মতো বসে থাকবেন?’

—‘শুধু রিনা আর ছোটনের মায়ের কথা বলেই চলে যাব...’

—‘আচ্ছা বলুন আপনার যা মন চাই বলুন...’

—‘আপনার মতো রিনার কাছেও আমি যেতাম...’

—‘রিনার কাছে অনেকেই যেত, সো হোয়াট?’

—‘একদমই...অনেকেই যেত...কিন্তু আপনি বাঁধা বাবু ছিলেন বলে রিনা আপনাকে বিশ্বাস যতটা করত, অন্যদের ততটা করত না, আপনার প্রতি যতটা যত্নবান ছিল, অন্যদের প্রতি ছিল না...’

ওর কথায় না হেসে আমি পারি না—‘আপনি পাগল হয়ে গিয়েছেন, বেশ্যার আবার বাবুকে বিশ্বাস করে...সত্যিই বুঝতে পারছি, আপনি ইহজগতের বাসিন্দা নন...’

—‘ঠিকই বলেছেন, বাবুদের প্রতি বিশ্বাস রাখতে নেই...যেমনটা রিনা আপনার প্রতি রেখেছিল...রিনার কোনও সঞ্চয় ছিল না...আপনি যে গয়নাগুলি দিয়ে গিয়েছেন, ওগুলিকেই আঁকড়ে ধরে রিনা বাঁচতে চেয়েছিল...’

          শ্যামার মৃত্যুর পর বাবা আর কোনও ঝুঁকি নিতে চাননি। সবটা আঁচ করেই সম্ভবত বাবা আমাকে দিল্লি পাঠিয়ে দিলেন। বাবার বন্ধু হরিপদ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সুপারিশে একটি চাকরিও পেয়ে গেলাম। ভাল ছাত্র ছিলাম বলেই হয়ত সুপারিশের চাকরিতেও সুনাম জুটে গেল অনায়াসেই। পদোন্নতিও হল। তবে বাইরে থাকতে ভাল লাগতো না। কোম্পানি বদল করে চাকরি নিয়ে চলে এলাম কলকাতায়। নতুন অফিসেই আমার পরিচয় চঞ্চলের সঙ্গে। চঞ্চল আর আমি খুব দ্রুতই বন্ধু হয়ে গেলাম। অনেকেই বলেছিলেন, ‘চঞ্চলের সঙ্গে মিশো না ভাই...’। কিন্তু কূসঙ্গে পড়তে তো আর বেশি সময় লাগে না, আমিও তাই চঞ্চলকে আর ছাড়তে পারলাম না। প্রথম প্রথম নাইট শোয়ে সিনেমা, এরপর রেস, মদ। এর মধ্যে শেষ সংযোজন কালীঘাটের বড়গলি। স্যাঁত স্যাঁতে গলিটার শেষ প্রান্তে রিনার ঘর। রিনার এ পাড়ায় সব চেয়ে বড় চাহিদা। অপরাধবোধ, জাত্যাভিমান, সম্মানবোধ প্রথম দিন সামান্য সংশয় তৈরি করেছিল। কিন্তু রিনার আতিথেয়তায় মুগ্ধ হয়ে গেলাম। রিনার মধ্যেই খুঁজে পেলাম শ্যামাকে। অল্প কয়েকদিনে রিনাই হয়ে উঠল আমার জগত্। চঞ্চল বলেছিল, উপহার দিলে নাকি গণিকা বেশি যত্ন-আত্তি করে। প্রথমে একটা সোনার হার। এরপর বালা-চুরি-নেকলেস-আংটি, কানের দুল...

—‘হারটাতেই যা সোনা ছিল, বাকিগুলি ছিল পিতল কিংবা ব্রোঞ্জের, তাই তো?’

—‘কিন্তু...’

—‘কিন্তু কী?’

—‘আমি তো কোনও দিন বলেনি যে সেগুলি সোনার...’

—‘একদম ঠিক...আপনি বলেননি...কোনও কথা বলেননি...রিনা যখন গয়না পেয়ে খুশি হয়ে আপনারই মুখের দিকে তাকিয়ে আপনার থেকে টাকা নিতে অস্বীকার করেছে, তখনও আপনি সত্যিটা বলেননি...আপনি চুপ করে থেকেছেন...’

          আমি কোনও কথা বলতে পারি না। এক রত্তি ছেলেটার সামনে আমার মাথা হেঁট হয়ে যায়। ও বলতেই থাকে—‘রিনা বেচারি জানত না, চকচকে হলেই সব সময় সোনা হয় না...বছর পনের পর যখন ওর যৌবনের মৃত্যু ঘটেছে, কাজ করার সামর্থ নেই, দিনু স্যাঁকড়ার দোকানে একদিন বালাটা নিয়ে হাজির হয় সে...বালাটা গলিয়ে দিতেই সব কিছু জলের মতো পরিষ্কার...’

          রাত এখন কটা হবে কে জানে! বৃষ্টিটা একটু ধরেছে। আলো আঁধারির খেলা অব্যাহত। চিলেকোঠার স্যাঁত স্যাঁতে ঘরখানিতে পিন ড্রপ সাইলেন্স। এর আগেও অনেকবার রমা-শ্যামা-রিনাকে নিয়ে ভেবেছি, কিন্তু কখনও এতটা যন্ত্রণা টের পায়নি। নীরবতা, শূন্যতা আমাকে গ্রাস করছে। বুকের ভিতরে নেই নেই ভাব।

—‘স্যার...’

—‘হুঁ’

—‘শরীরটা খারাপ লাগছে নাকি?’

          আমি মুখে কিছুই বলি না, শুধু ঘাড় নাড়ি। বলতে থাকে সে—‘আমাকে ক্ষমা করবেন স্যার, এই কথাগুলো আমি তুলতে চাইনি, কিন্তু উঠেই গেল...’

—‘উঠেছে, ভালই হয়েছে...’

—‘আমারও তাই মত...কোনও না কোনও জায়গায় তো আত্মমূল্যায়ণেরও প্রয়োজন পড়ে...’

—‘আত্মমূল্যায়ণ! আমার জীবনে কী কেচ্ছা ছাড়া ভাল কিছু নেই! আমি বিনা পয়সায় পড়িয়েছি, এর দুঃখে-তার দুঃখে পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছি...আর সেসব বাদ দিয়ে আমার জীবনের কেচ্ছা, মেয়ে মানুষদেরই আপনি টেনে টেনে আনছেন...আর তারপর বলছেন আত্মমূল্যায়ণ!’

সে মুচকি মুচকি হাসে। অসহ্য বিদঘুটে গা-পিত্তি জ্বলানো সেই হাসি। খানিকক্ষণ নীরবতার পর আমি আর চুপ করে থাকতে পারলাম না—‘হাসছেন কেন, আমি হাসির কথা কী বললাম আবার!’

—‘আপনি পুরো স্কুল-ডে’জের মতো অভিযোগ করছেন মশাই...’

—‘স্কুল-ডে’জের মতো অভিযোগ!’

          সহাস্য মন্তব্য করে সে—‘একদমই...আচ্ছা আপনি বলুন, আপনার জীবনের সোস্যাল সার্ভিসের কথা বললে পাঠক কী ইন্টারেস্ট পাবে? ভূত মানেই তো সেক্স, ভূত মানেই তো সেখানে নারীর উপস্থিতি থাকবে...ভূতেদের গল্পে সাদা শাড়ি পরা মহিলার কথা পড়েননি...কিংবা ধরুন তৃতীয় শ্রেণির হিন্দি হরর মুভি, সেখানে তো ভূতেদের সঙ্গে সেক্স হয়...’

—‘আই সি, তার মানে এই মাঝ রাত্তিরে ভূত চর্চা করতে গিয়ে আমার জীবনের কেচ্ছা-কারবার টেনে আনছেন আপনি...’

—‘শুধু আমি কেন, আপনি করেননি কখনও! আমরা সবাই করেছি, সবাই করিও...ফাঁকা ঘরে মাঝ রাত্তিরে কখনও রিনা, কখনও শ্যামা, কখনও রমার কথা ভেবে নিজেকে আদর করেননি কখনও?’

—‘বুঝলাম, এবার আপনি আমার কেচ্ছা গল্প শেষ করুন...’

—‘কেচ্ছা গল্প নয়, কাহিনী...’

—‘ওই হলো...’

—‘হুঁ...তবে এবার যে ঘটনা বলব, তার মধ্যে আপনি আছেন, আপনার সঙ্গেই হয়েছে সেটা...কিন্তু আপনিই জানেন না...’

—‘ইন্টারেস্টিং...’

—‘বৈ কি...এ ঘটনার কেন্দ্রেও একজন নারী—ছোটনের মা...’

—‘ইস...এবার কিন্তু বাড়াবাড়ি হচ্ছে...’

—‘বাড়াবাড়ি!...কিন্তু ওই মহিলাকে একা পেয়েও তো আপনি ছাড়েননি...শরীরটাকে তিল তিল করে উপভোগ করেছেন...একদিন নয়, দুদিন নয়, দিনের পর দিন...’

—‘করেছি..তার বিনিময়ে আমার থেকে আজ পাঁচশো, কাল হাজার করে টাকা নিয়ে গিয়েছে সে...’

—‘অভাব তো...সে জন্য ইচ্ছে না থাকলেও না করেনি...সে সব ছাড়ুন...আমি আপনাকে এবার একটা কথা বলতে চাই...একটা তথ্য আর কি...’

—‘বলে ফেলুন...’

—‘আপনার সঙ্গে সম্পর্কটা ওর জন্য কাল হল। আপনার জন্যেও...’

—‘মানে...বুঝলাম না...’

—‘আচ্ছা, ছোটনের মা যেদিন শেষ এসেছিল, সেদিনটা আপনার মনে আছে?’

          আমি মনে করার চেষ্টা করি—‘সেদিনও সকাল থেকে বৃষ্টি। ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি। বিকেল গড়িয়েও বেয়ারা বৃষ্টি থামেনি। বাড়িতেই গোটা দিন, গোটা সন্ধ্যা। স্বামী অভেদানন্দ পড়ছিলাম। কলিং বেল বেজে উঠল। ছোটনের মা এসেছে রাতের খাবার দিতে। ওর আধ ভিজে শরীরটা দেখে আমি প্রলুব্ধ হয়েছিলাম। ওর হাত ধরে টেনে বসালাম। আপত্তি করেনি সে। হঠাত্ একটা সুগন্ধ। ঘুম ঘুম ভাব। নেশা নেশা ব্যাপার। তারপর গলাটাই একটা চাপ। দমবন্ধ হয়ে এলো আমার...’

—‘তারপর শরীর ছেড়ে বেড়িয়ে পড়লেন আপনি...কিন্তু এ বাড়ি থেকে আর বেরোতে পারলেন না...পরদিন আপনার শরীরটাকে তুলে নিয়ে গেল...একে ওকে জেরা করে শেষ মেশ হাজতবাস ছোটনের মায়ের...’

—‘কী যা তা বলছেন!’

—‘যা তা নয়, এটাই সত্যি।’

—‘তার মানে আপনি বলছেন, আমিই আসলে ভূত...’

—‘আমি কিছুই বলছি না স্যার...এটাই সত্যি...’

—‘আষাঢ়ে গল্প ফাঁদবেন না প্লিজ...আপনি এখন যান...’

          হো হো করে বিশ্রি শব্দে হেসে ওঠে সে। আমি প্রশ্ন করি—‘এটাতে হাসির কী হল?’

—‘কোথায় আর যাব বড়দা? আপনার মতো তো আমারও এ বাড়িই ঠিকানা...অন্য কোথাও যেতে পারলে তো কবে চলে যেতাম...’

—‘আবার বাজে কথা...আমার কোনওদিন কোনও ভাই ছিল না...’

—‘ওটা কালের নিয়ম...আচ্ছা বেশ, আমার ঘরে আপনি আসুন...’

ওর পিছুপিছু সিঁড়ি দিয়ে নামতে থাকি আমি...আজ আলো ঝলমল করছে এ বাড়ি...দোতলার বারান্দা মুখো ঘর... দরজায় টোকা মারতেই দরজা খুলে দেয় শ্যামা...আমি পিছু পিছু ঘরে ঢুকি...রমা আর রিনাও রয়েছে এই ঘরে...ওরা প্রত্যেকেই আমাকে দেখে ফিক ফিক করে হাসছে...দেওয়ালে লাগানো নিউড মডেলের পেন্টিংটা আর দেখা যাচ্ছে না, ধুলোমাখা...সেখানেই ভাল করে যুবককে দেখি, হুবহু আমার যুবকাবস্থা...আমি ছুটে যাই বাবা-মায়ের ঘরে...আমার মা আব বাবা এক শিশুকে নিয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে...আমার শৈশবের ছবির সঙ্গে শিশুর মুখের কী অদ্ভূত মিল...আমি শিশুটির মাথায় হাত বোলাতেই সে চোখ খোলে...শৈশব আমায় দেখে ফিক ফিক করে হেসে ওঠে...বড় ভয় হয় আমার...আমি ছুটে আসি আমার ঘরে...হাঁফাতে হাঁফাতে দাঁড়ায় আয়নার সামনে...আয়নায় আজ আমার কোনও প্রতিফলন নেই, সবটাই দেওয়ালের প্রতিবিম্ব...

.