দ্য বিমল রায় ফেস্টিভাল উপস্থাপনায় বমন ইরানি
দেবযানী রায়
বিশবরেন্য পরিচালক বিমল রায়ের ৫০তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে Zee Classic এর শ্রদ্হার্গ — বিমল রায় ফেস্টিভাল। উপস্থাপনায় বমন ইরানি। দেখুন পাঁচটি দুর্মূল্য রত্ন — দো বিঘা জমিন, দেবদাস, মধুমতি, সুজাতা ও বন্দিনী, পরপর পাঁচ সপ্তাহ ধরে। তাছাড়া রয়েছে বিমল রায়ের উপর একটি তথ্যচিত্র থেকে নির্বাচিত কিছু অংশ, যাতে স্মৃতিচারণা করবেন ধর্মেন্দ্র, বৈজন্তিমালা, গুলজার ও আশুতোষ গবারিকের। শোনাবেন বিমল রায়ের সঙ্গে তাদের অভিজ্ঞতার কথা। ফেস্টিভাল এর চতুর্থ ছবি বহু পুরস্কৃত 'বন্দিনী'।
বন্দিনী
'বন্দিনী' চলচিত্রটি শ্রী বিমল রায়ের জীবনের সর্বশেষ প্রয়াস। লেখক শ্রী চারুচন্দ্র চক্রবর্তীর 'তামসী' উপন্যাসটির উপর 'বন্দিনী' কে রূপায়িত করা হযেছে। কাহিনীকার শ্রী চক্রবর্তী [বাংলা সাহিত্যে যিনি 'জরাসন্ধ' নামে খ্যাত] নিজের জীবনে জেলর হিসেবে দীর্ঘদিন কাজ করেছিলেন। এই কাজের অভিজ্ঞতার ফসল স্বরূপ তার শক্তিশালী লেখনি কারাগারের নিসঙ্গ অথচ ঘটনাবহুল জীবনকে নানান আঙ্গিকে তুলে ধরতে সক্ষম হয় ও বাংলা সাহিত্যে এক অভিনব নতুন মাত্রার সংযোজন করে। ১৯৬৩ সালে নির্মিত এই ছায়াছবি জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত সর্বশ্রেষ্ঠ হিন্দি চলচিত্র নির্বাচিত হয়। এছাড়াও ছটি ফিল্মফেয়ার পুরস্কার জিতে নেয় এই ছায়াছবি --- সর্বশ্রেষ্ঠ ছায়াছবি, সর্বশ্রেষ্ঠ পরিচালক, সর্বশ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী [নূতন] সর্বশ্রেষ্ঠ চলচিত্রকার [শ্রী কমল বসু], সর্বশ্রেষ্ঠ শব্দগ্রহণ [শ্রী ডি. বিলিমোরিয়া] ও সর্বশ্রেষ্ঠ কাহিনী [শ্রী চারুচন্দ্র চক্রবর্তী] । প্রখ্যাত সঙ্গীতশিল্পী শ্রী সচিন দেব বর্মণের সুরজালে সমৃদ্ধ এই ছায়াছবিটির জন্যে গীত রচনা করেন শ্রী শৈলেন্দ্র ও শ্রী গুলজার। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য এই যে শ্রী গুলজারের চলচিত্র জগতের সাথে সুদীর্ঘ ও সমৃদ্ধ পথচলা এই ছায়াছবি থেকেই শুরু।
কল্যাণী -- কাহিনীকারের দেওয়া এই নামই তো পূর্বাভাস দেয় চরিত্রটির। আপাতদৃষ্টিতে সমাজের সেই অপরাধিনী --- হত্যাকারিনী। কিন্তু কি অসাধারণ দক্ষতায় লেখক ও পরিচালক তুলে ধরেন তার অনন্যসাধারণ চরিত্রের বৈশিষ্ট্যগুলি। স্বকীয়তা, তেজ, মমত্ব, চেতনা ও কোমলতায় সজ্জিত এই নারীর দ্বারা হত্যাকান্ড কিরূপে সংঘটিত হওয়া সম্ভব? সমগ্র ছায়াছবিতে রয়েছে নিপুণ ভাবে তারই বিন্যাস।
একটি সাধারণ মেয়ে --- নিজগুণে যে হয়ে ওঠে অসাধারণ, সেই কল্যাণীরুপী নুতনকে নিয়েই এই গল্প। সুক্ষ, শক্তিশালী ও মর্মস্পর্শী অভিনয়ে নূতন ভরিয়ে তুলেছেন এই ছায়াছবিকে। স্নেহশীল পিতা ও জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার মমতায় লালিত এই মেয়েটির জীবনে আসে বিকাশ। আদর্শবাদী এই যুবকের প্রণয়পাশে বাঁধা পড়ে কল্যাণী। অশোক কুমার রূপী বিকাশ হয় সমভাবে আপ্লুত, অঙ্গীকারবদ্ধ হয় তারা। কিন্তু চিরাচরিতভাবে জীবনদাতার অদ্ভুত অভিপ্রায়ে প্রতিশ্রুতিভঙ্গ করে বিকাশ । শহর থেকে আর ফেরে না গ্রামে তার কল্যাণীর কাছে।
গ্রামবাসীদের তীক্ষ্ণ সমালোচনার মুখে পড়া অসহায় পিতার আক্ষেপ ও নিষ্ফল ক্রোধ গভীরভাবে আঘাত করে কল্যাণীকে। বিকাশকে খুঁজতে শহরের দিকে পা বাড়ায় সে। নিজের বান্ধবীর বাড়িতে সাময়িক আশ্রয়ের পরে সে বোঝে যে তাকে প্রতি পদে মানুষের অবাঞ্চিত কৌতূহলের পাত্রী হতে হবে --- সন্মুখীন হতে হবে অহেতুক প্রশ্নের ও বিদ্রূপের। ভাগ্যবিধাতার পরিহাসে কল্যাণীর ঠাই হয় বিকাশের মানসিক রোগগ্রস্থ স্ত্রীর পরিচারিকা হিসেবে। পরিপূর্ণ সহানুভূতি ও ধৈর্যের সাথে এই কঠিন সাধনাকেও সে হাসিমুখে স্বীকার করে। কিন্তু নিরন্তর কটুবাক্য ও অশালীন আচরণ তার দৃঢ়তায় ফাটল ধরায়। অপরাধিনী ও হত্যাকারিনী হিসেবে চিন্হিত হয় সে।
কারাগারের বন্ধিজীবনেও কল্যাণী এক পরিপূর্ণ নারী হিসেবে নিজের পরিচয় দিতে সক্ষম হয়। কর্তব্যে সে দৃঢ়, মমতায় আপ্লুত, সহিষ্ণু, সেবাপরাযনা ও বুদ্ধিমতি। তার বিবিধ গুণের পরিচয় পেয়ে মুগ্ধতায় ছেয়ে যায় কারাগারের চিকিত্সক দেবেনের মন। কল্যাণীকে সেই সাথী হিসেবে পেতে চায়। কারাগারের জেলর সাহেব কল্যাণীর মর্মান্তিক ইতিহাস জানার পর ও তার সংস্পর্শে আসার পর সহানুভূতিশীল হয়ে পড়েন। দয়াপরায়ণ এই মানুষটির সহৃদয় হস্তক্ষেপে মুক্তি পায় কল্যাণী। সব ঘটনা জানার পর দেবেনের বৃদ্ধা মাও কল্যাণীকে পুত্রবধূরূপে স্বীকার করতে সম্মর্থ হন।
এত দুঃখের পর অবশেষে সূর্যোদয় কি ঘটল কল্যাণীর জীবনে? অবশ্যই, তবে তা হলো কল্যাণীর একান্তভাবে নিজস্ব ভাবধারার সূর্যোদয়। শাশ্বত হিন্দু নারীর চিরন্তন রূপরেখাকে সন্মান জানাল কল্যাণী। অসুস্হ বিকাশকেই ফের সাথী হিসেবে বেছে নিল সে, দেবেনের সাথে সুখের সংসার রয়ে গেল অধরা। কল্যাণী তাই চিরবন্দিনী। সম্পূর্ণ স্বাধীনগামী, সমস্ত বাধানিষেধ মেনেও সে বন্দিনী। সনাতন হিন্দু নারী রূপে প্রথম প্রণয়ের জ্বালে বন্দিনী। প্রগতিশীল কল্যাণী হৃদয়ের মামলায় বেহিসেবী, কিন্তু ভারতীয় নারীর প্রতিমুর্তিরূপে সেবা, ত্যাগ, ও ধৈর্যর বাঁধনে চিরবন্দিনী।
প্রসঙ্গত শ্রী বিমল রায় প্রথমে শ্রীমতি বৈজন্তিমালাকে কল্যাণীরূপে মনস্থ করেন। কিন্তু সময়াভাবে কাজটি করতে পারেননি তিনি। অতএব আসেন নূতন, ও এটি হয়ে দাড়ায় তাঁর জীবনের এক অন্যতম অভিনয়্সৃজন। নৈনি, ভাগলপুর ও য়েরবাদা জেলে চলচিত্রিয়াত এই অসাধারণ ছায়াছবিটি মানুষকে আজও মুখোমুখি করে চিরকালীন সত্যের। কারাগারের কঠিন জীবনে আসে বসন্ত, পাখির কলকাকলী মনে ধরায় টান। কঠোর বাস্তবের মুখোমুখি হয়েও, আশাহত হয়েও, মানুষ ফের বিশ্বাসে বুক বাঁধে --- নতুন করে স্বপ্ন দেখে এবং এটাই তার জীবনে চিরন্তন সত্য যে জীবন গতিশীল ও পরিবর্তনশীল, কোনো কিছুই পারে না তার অদম্য গতিবেগ রুদ্ধ করতে।
দেখতে ভুলবেন না। দ্য বিমল রায় ফেস্টিভাল উপস্থাপনায় বমন ইরানি। সিরিজের চতুর্থ ছবি 'বন্দিনী' দেখানো হলো শনিবার, সন্ধে ৮ টায়, Zee Classic এ।